আমি কি গান গাব যে ভেবে না পাই-
উতল-ধারা বাদল ঝরে। সকল বেলা একা ঘরে। সত্যিই গত কয়েকদিন ধরে এমন অঝোর বৃষ্টি। সারাদিন। কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো মুষলধারে। মাঝেমধ্যে এক একটি দমকা হাওয়া যেন মনের মধ্যে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যায়। ভেতরটা মুচড়িয়ে ওঠে। হু হু করে। দক্ষিণের জানলাটা খোলা। ঠান্ডা বাতাসে একটা আরামে চোখ বুঁজে আসে। পূবের জানলা দিয়ে সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে সেই রেলস্টেশন অব্দি। খুব বেশি দূরেও নয়। সারাদিন ট্রেনের শব্দেই ঘড়ির কাজ হয়ে যায় প্রায়। আজকাল ট্রেন বেশ সময় ধরেই চলছে দেখছি। এখান থেকে রেলস্টেশনটা দেখা যায় না ঠিক। কিন্তু দক্ষিণের জানলা দিয়ে ঐ দূরে ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়াটা দেখা যায় চেষ্টা করলে। ট্রেনের চলে যাওয়ার সাথে প্রিয়জনের চলে যাওয়ার একটি মিল আছে যেন। মনে হয় একই রিদিমে অনেকটা দূরত্ব সাথে নিয়ে চলে গেল যেন। ঠিক যেমন চলে গিয়েছিল পিয়ালী। সে অনেক দিন আগের কথা। এখন এই আধা শহরেই পাকাপাকি একটি বন্দোবস্ত করে নিয়েছি প্রায়। প্রায় এই জন্যেই যে জীবনে চিরস্থায়ী কিছুই নয়। আজ আছি। কাল কি হবে জোর দিয়ে কে বলতে পারে। পরশুর কথা তো দেব নঃ জনান্তি! এই বৃষ্টি ভেজা অলস দিন। কি বলবো আমিই জানি না। কি কথা আমার যা অন্য কাউকে বলা যায়। কিন্তু কাউকে না কাউকে যে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে হয়। বিশেষ করে এমন দিনে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আজকাল আর কথাই খুঁজে পাই না। অথচ অনর্গল কথা বলার একদিন ছিল। সেসব যেন ধুসর স্মৃতি আজ। এই বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে মনটাও কেমন উতলা হয়ে ওঠে। পুরানো স্মৃতির সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যেতে চায় অনেক অতীতে। তবু প্রশ্ন জাগে জীবন কি সত্যিই অতীত হয় কখনো? কেই বা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে?
এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়-
সত্যিই তাই এ আমার জীবনেরই ইতিহাস যেন। কতযুগ আগের কথা। এরকমই এক উথাল পাতাল বৃষ্টিভেজা বিকাল। ইউনিভার্সিটির ক্লাসে আমরা দুজন। ভাষা শিক্ষার ক্লাস ছিল। বৃষ্টির মধ্যে কেউই আসতে পারেনি। শুধু আমরা দুজন বাদে। সে ছিল মোবাইল ফোন আবিষ্কারের আগের যুগ। খুব কম মানুষের বাড়িতেই তখনো ল্যাণ্ডফোন। আমাদের ভাষাশিক্ষার ক্লাসের অধ্যাপকও হয়তো আটকিয়ে গিয়েছিলেন সারাদিনের বৃষ্টিতে। কিন্তু সেই বৃষ্টিও আমাকে আটকাতে পারেনি। পারেনি কারণ সেই ক্লাসেই প্রথম দেখা মিতালীর সাথে। তাই একটি দিনও ক্লাস মিস করার উপায় ছিল না। আসতেই হতো। কিন্তু মিতালীও কি তাই এসেছিল? নিশ্চয়ই তাই। না হলে আর কেউ না এলেও শুধু আমরা দুজনেই বা কেন অমন অঝোর বৃষ্টির বিকালে গিয়ে উপস্থিত হবো। ইউনিভার্সিটির বিশাল বিশাল জানলার কাঁচের ওপারে তখন বৃষ্টি আর সবুজ গাছপালার যুগল নৃত্য। ভেতরে আমাদের চঞ্চল চোখের দুইকুলে। মিতালীর মতো সুন্দরী আমি সত্যিই আর দেখিনি। সব কিছু বাদ দিলেও অমন দুটি চোখ। যে কোন মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। আমার তো রোজই ঘুরতো। ভাষা শিক্ষার ক্লাসের অধ্যাপকের কথা উড়ে যেতো মাথার উপর দিয়ে। শুধু অবাক হয়ে দেখতাম মিতালী কি অবলীলায় নতুন একটি ভাষাকে দ্রুত তালে রপ্ত করে নিচ্ছে! সেই থেকে মিতালীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার শুরু। সেদিনের সেই বৃষ্টির বিকেলেই তাই ঠিক করে ফেলি, আর স্বপ্ন নয়। এবার স্বপ্নকে নামিয়ে আনতে হবে বাস্তবতায়। এমন মধুর লগ্ন সহজে আসবে না আর।
কিছু বলবো বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে
হয়তো এটাই জীবন। এইভাবেই জীবনের নাগরদোলায় আমাদের ওঠা নামা। দূর থেকে দেখলে হাসিই পায়। কিন্তু যারা ওঠে নামে তাদের যে সবসময় অবিমিশ্র ভালোই লাগে তা নাও হতে পারে। সেদিন মিতালীর মনেও রং ধরিয়েছিল ঝরঝর বরিষণ। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই সহপাঠির কাছেই তার ভালোবাসার গল্পগুলি মেলে ধরেছিল। আমার মধ্যে ভরসা করার মতোই একজন মানুষকে খুঁজে পেয়ে অনর্গল উপুর করে দিয়েছিল তার মনের আদিগন্ত। তৃপ্তি পেয়েছিল। ঠিক যে ট্রেনটা ধরার জন্যে আপনি ব্যাকুল হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন, সেটি আপনাকে না নিয়েই স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলে যেমন অসহায় দশা হয়, আমারও সেদিন সেই দশা। বাইরে আদিগন্ত উথাল পাতাল বৃষ্টি। ইউনিভার্সিটির জানালার কাঁচ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে জলপ্রপাতের মতো। ভিজে যাচ্ছি আমিও। আমার স্বপ্নগুলোও তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে ধ্বসে যাচ্ছিল গলে গলে। সেও তো রক্তজল করা কষ্ট না কি। একমনে কত কথাই বলে যাচ্ছিল মেয়েটি। কত তার স্বপ্ন। কতরকম পরিকল্পনা। হয়তো সেই প্রথম আমি আঁচ করতে পারছিলাম নারীর মন। কতরকম বিচিত্র তার নকশা। কতরকম বিচিত্র তার বুনন। কিন্তু ভরা বর্ষার নদীর মতোই যেন অবাধ তার গতি। একবার জল পেয়ে গেলে আর যেন দুকুল মানে না। সবিকিছুই ভাসিয়ে নিয়ে অভিমুখ তার সাগরসঙ্গমে। ভাষাশিক্ষার ক্লাসে সেই আমার শেষদিন। মনে মনে অধ্য়াপককে শুভকামনা জানিয়েই রওনা দিয়ে ছিলাম বাড়ি ফেরার পথে। সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে।
যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়
সে শ্রাবণ বড়ো নিঃসঙ্গ। চারদিকে কান পাতলে শুধুই বৃষ্টির গোঙানি তখন। মেঘের তোরে যেন ধুলিস্মাৎ সব স্বর্ণালী স্বপনের রামধনু আশা। জলকাদা মাখামাখি শহরের গোলকধাঁধায় ভাষাহীন ব্যাথার নিরব প্রতিধ্বনি। রোজকার খবরের কাগজের মতোই নিরানন্দ পৃথিবী রোজকার ভেজারাতে উঁকি দিয়ে যায় জানলায়। নিবিষ্ট অন্ধকার জমে উঠতে থাকে দিনলিপির সব সাদা সাদা পাতা জুড়ে দুই মালাটের জীবনে। পথ চলতি রাস্তায় বেহঁশ গাড়ীর চাকায় জলকাদা ছিটকিয়ে ভিজে যাওয়ার মতো অসহনীয় সে অবস্থা। তবু স্মৃতিময় ঝরে পড়া স্বপ্নের আবেশ নিয়ে অলস সময়ের হাতছানি। চারিদিকে কেউ নাই। কিছু নাই। তবু মিতালীর সেই দুটি চোখ রয়ে গিয়েছে তখনো। যে চোখ তার সহপাঠীকে ভরসা করে ছিল। সেই স্মৃতিটুকু খড়কুটোর মতো ধরে নিজের দিকে চেয়ে নতুন ভাষা খোঁজা কেবল। মানুষের মন বেশিরভাগ সময়েই অবুঝ শিশুর মতো খেলা করে জীবনের চারকোণে। নিজের কাছেই তার যত বায়না। আর চাওয়ারও শেষ নাই, আশার ভাঁজে ভাঁজে।
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো
গিয়েছিলাম বেড়াতে। পাহাড় ছিল। টলটল জলের নদী পাশ দিয়ে। মনে হয় হেঁটেই পার হয়ে যাওয়া যাবে। সঙ্গীসাথী কেউ নাই। একাই। বেশ কিছু ছুটি জমে গিয়েছিল সরকারী দপ্তরের। একটু ছুটি চাইছিলাম। নিরবে নিভৃতে নিজের সাথে বসার জন্যে।
সেও এমনই শ্রাবণ মাস। রোদ বৃষ্টির লুকোচুড়ি খেলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির একটা মৌতাত আছে। যতটুকু গায়ে মেখে নেওয়া যায়। একাই বসেছিলাম নদীর ধারে পাহাড়ী ঢালে। সামনে সবুজে সবুজ। আর মেঘে ঢাকা বৃষ্টির আকাশ। না কোন কবিতার কথা মনে ছিল না। বেসুর গলা নিজের বশেই ছিল। ভাবাবেগের স্রোতও ভাটির টান, সেও অনেক দিন। শুধুই নিরিবিলি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মুখোমুখি নিজের সাথে একা। দেখা হল ঠিক সেই সময়। নদীর জলে পা ডুবিয়ে নদীতে নামার জন্যে ব্যালেন্স ঠিক রাখার চেষ্টায়। আমি ছিলাম সামান্য বাঁদিকে। কখন যে কেউ সামনে এসে গিয়েছে খেয়াল করতে পারিনি। যখন পারলাম ততক্ষণে সে টাল সামলাতে না পেরে নদীর জলে হাবুডুবু। তারপর অনেকটা চিত্রনাট্যেরই মতোন। হবু শ্বশুর শাশুড়ীর অনেক আশীর্বাদ আর তাঁদের ডাকাবুকো মেয়ের স্পর্শ নিয়ে ফেরা একটা আস্ত গোটা রাত। বাঁধ ভাঙা বন্যার জলের তোড়ের মতো উচ্ছাসে উদ্দাম।
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে
সত্যই তাই প্রায় নাচতে নাচতেই পিয়ালীর সাথে কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। বেঁচে থাকা যে এমন মনোহর হতে পারে, সেটা জেনেছিলাম ওর কাছেই। যেমন ডাকাবুকো তেমনি উচ্ছল। সবেতেই ওর বিস্ময়। আর সবেতেই ওর আনন্দ। ঠিক যেন প্রকৃতির মতোই। মনে হয় না কোথাও কোন দুঃখ আছে। ছিল। থাকবে কোনদিন। গোটা জীবনের অর্থটাই যেন বদলে দিয়ে গেল। কি বিপুল উৎসাহ। কোন কাজেই পিছপা নয়। হাজার পরিশ্রমেও কোন ক্লান্তি নাই। বিরক্তি নাই। আর সারা মুখে সেই দুকুল ছাপানো হাসি। না পিয়ালী, আমি আজ এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় তোমার ঢাক পিটাতে বসিনি মোটেও। তুমি যা তুমি তাই। যারা তোমাকে চিনতো তারাই তা জানে। কাউকে ডেকে ডেকে শোনানোর কোন প্রয়োজন নাই আমাদের কারুরই। জীবনের আনন্দ যে চলার ছন্দের মধ্যেই এ কথা প্রথম শেখা তো তোমার কাছেই। সেই ছন্দটাকেই চলিষ্ণু রাখাটাই প্রতিভা। বলেছিলে তুমি। সেদিন যখন তোমার সাথে প্রথম আলাপ। তোমার মায়ের অজস্র বকুনির উত্তরেই। সেই হয়তো আমার জীবনের প্রথম সহজপাঠ।
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
কবি বলেছিলেন; ‘জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। কিন্তু আজ এতদিন পেরিয়ে এসেও আমি তো জানি। জানি কেন এমন পাগল করা বৃষ্টিও আমাকে আর ভেজাতে পারে না আগের মতো। আসলে ভিজতে চাওয়ার মতো মনটাই যে হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের মতো। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যাবে না কোনদিন। মিসিং ডায়েরী করার সময়ও বুঝতে পারিনি, যা হারিয়ে যায় সে আর ফিরে পাওয়া যায় না হয়তো কোনদিন। গিয়েছিলাম আবার পাহাড়ে। সে হিমালয়ের সবুজ অরণ্যের অনেক গহন ভেতরে। গিয়েছিলাম শুধু দুজনেই। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে খেয়াল চাপলো তার বৃষ্টিতে ভেজার। আমিও যে নিষেধ করেছিলাম তেমনটাও তো নয়। কিন্তু পিয়ালী, বারণ করলেই কি তুমি শুনতে? আমিও তো তখন তোমারই মতো। তোমার আনন্দেই বিভোর। কি যে জাদু করেছিলে! গোটা জীবনটাই যেন একটা উদযাপন হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি ইচ্ছেই এক একটি উৎসব। বাঁধন ছেঁড়ার সাধন শুধু। শুধু জানতাম তুমি আছো আমি আছি।
আমার প্রিয়ার ছায়া
আকাশে, আজ ভাসে, হায় হায়!
বৃষ্টিসজল বিষন্ন নিশ্বাসে, হায়!
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্য়াদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে। হায়!
বারি-ঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশ-হারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেযে মনের কথা হারায়।
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে, হায়।
শ্রীশুভ্র
loading...
loading...
লিখাটি পড়ে মুগ্ধতা প্রকাশ ছাড়া আর যেন কোন শব্দ জুটছে না মি. শ্রীশুভ্র ।
loading...
দাদা, অনেক ভালো লাগছে আপনাকে এখানে পেয়ে। আশা রাখি নিয়মিত আপনার লেখা পড়তে পারবো। ভালো থাকবেন
loading...