অসাধারণ সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও সাধারণের সাহিত্য
হুমায়ুন আহমেদ-এর একটা বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শুরু করি ।
“পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে, কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে।”
আর এই খুব কম মানুষদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি পেরেছেন। শুধু পেরেছেনই না, তিনি অনেক ভালোভাবেই পেরেছেন। কারন তিনি শুধু নিজের মধ্যকার ঘুমন্ত দৈত্যকেই জাগিয়ে তুলেননি। জাগিয়ে তুলেছেন সাহিত্য বুঝেন না এমন সাধারণ মানুষের মনে সাহিত্যের বোধ। হুমায়ূন পূর্ববর্তী যুগে বাংলা সাহিত্য ছিল উচ্চ শিক্ষিত ও বোদ্ধা শ্রেণীর মানুষদের দখলে। সাহিত্য চর্চা ছিল একই সাথে অহংকার ও বিলাসিতা করবার মত বিষয়। হুমায়ূন সাহিত্যকে তুলে দিয়েছেন স্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ মানুষের হাতে। এই দখল মুক্তির প্রচেষ্টা সহজ ছিল না নিশ্চয়। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই হুমায়ূন করেছেন অত্যন্ত সহজ ভাবে। কারন তিনি ছিলেন জাদুকর। সাহিত্যের জাদুকর। তিনি যেমন সাহিত্যকে করে তুলেছেন সাধারণ মানুষের মানবীয় অনুভূতিতে পরিপূর্ণ তেমনি অতি সাধারণ মানুষকেও করে তুলেছেন সাহিত্যের রস আস্বাদনে উন্মুখ, আলোচক ও সমালোচক। মোট কথা সাহিত্যকে তিনি সাহিত্য হিসেবে নয় বরং মানুষের জীবনানুভূতি হিসেবে তুলে ধরেছেন।
আমার মতে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন অনুভূতি কেন্দ্রিক দার্শনিক। কোন দার্শনিকের প্রশংসায় হয়তো “অনুভূতি কেন্দ্রিক” এমন বিশেষণ ব্যবহার করা হয় না। তবে আমি এখানে একটু ভিন্ন ভাবে বলছি কারন দর্শন বলতে যা বুঝায় সেই মাপকাঠিতে তিনি ব্যতিক্রম। তার দর্শন, জীবন দর্শন। জীবনকে তিনি শুদ্ধতা ও নৈতিকতার আলোকে ব্যাখ্যা করেননি শুধুমাত্র। দায়িত্ব ও কর্তব্য ভাঁড়ে জর্জরিত করেননি জীবনের স্বল্প সময়কে। উন্নতির মাপকাঠিতে জীবনকে যান্ত্রিক ও নিষ্প্রাণ করে তুলেননি তার লিখনিতে। বরং জীবন যেমন, জীবন আসলে তেমন ভাবেই সুখের এই কথাই আড়ম্বর করে বুঝিয়েছেন বারংবার তার লিখনিতে। বুঝিয়েছেন জীবনকে আসলে মূল্য দিতে হয়। উপভোগ করতে হয় নিজের মত করে। সাজাতে হয় সাধ্যের মধ্যে পছন্দের উপকরন দিয়ে।
জ্যোৎস্না বিষয়ক লেখকের দুটি লেখাংশ দিয়ে এই বিষয়টাকে আমার মনে হয়েছে আপনাদের কাছে সবচেয়ে সহজ ভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব।
“প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই। গৃহত্যাগী হবার মত জোছনা কি উঠেছে? বালিকা ভুলানো জোছনা নয়। যে জোছনায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে – ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ। নব দম্পতির জোছনাও নয়। যে জোছনা দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন – দেখো দেখো চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর। কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জোছনা নয়। যে জোছনা বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে। কবির জোছনা নয়। যে জোছনা দেখে কবি বলবেন – কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ। আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি। যে জোছনা দেখা মাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে। ঘরের ভিতর ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর। প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব- পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে। চারদিক থেকে বিবিধ কণ্ঠে ডাকবে-আয় আয় আয়।”
এখানে কবি এক গভীর জ্যোৎস্না বিলাশে মগ্ন। জ্যোৎস্নার মত এমন একটা বিমূর্ত সৌন্দর্যের বিষয়কে লেখক তার অতি প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনার মধ্য দিয়ে এমন মূর্ত করে তুলেছেন যেন একমাত্র গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নাই পারে একজন মানুষকে তার জীবনের প্রকৃত সুখের সন্ধান দিতে। যে সুখ জীবনে একবার পেলে একজন মানুষ গৃহত্যাগী হয়েও পেতে পারে ত্রিভুবনের সমগ্র সৌন্দর্য ও সুখের দেখা। তার আর জীবনে চাওয়ার বা পাওয়ার কিছুই যেন অবশিষ্ট থাকেবে না যেন। যদিও এমন হয়তো কেউ কোনদিন পায়না। তবুও সেই গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য অপেক্ষার যে অনন্ত সময় তা সত্যি সুখের নিশ্চয়ই !
অন্য আরেকটি লেখাংশে সেই অপূর্ব জোছনায় সাড়া দিতে না পাড়ার কষ্ট থেকে তিনি লিখেছেন-
“কোন কোন রাতে অপূর্ব জোছনা হয়। সারা ঘর নরম আলোয় ভাসতে থাকে। ভাবি, একা একা বেড়ালে বেশ হতো। আবার চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। যেন বাইরের উথাল পাথাল চাঁদের আলোর সঙ্গে আমার কোন যোগ নেই। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জাম গাছের পাতার সর সর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা হা করে উঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কি বিপুল বিষণ্ণতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি।”
এখানে লেখকের বিষণ্ণতা পাঠকের মনকে নাড়া দেয়। কিন্তু কি এক জাদুকরী শক্তিতে পাঠক তার নিজের অনুভুতিগুলিকে হারিয়ে অথবা নিজের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট গুলিকে হারিয়ে ধারন করেন জ্যোৎস্নার মত মায়াময় এক অপার্থিব সৌন্দর্যের অধরা হাতছানি এবং শূন্যতার অনুভূতি। এবারও পাঠক ভুগতে থাকেন ভিন্ন রকম এক সুভ্র সৌন্দর্যের সুখের অসুখে। এটাকে পাঠক যেভাবেই উপলদ্ধি করুক না কেন, তা প্রকৃত অর্থে সুখেরই।
(পোস্টের কলেবর বড় হয়ে যাওয়ায় এই লেখাটা এখানে অসম্পূর্ণ, আরও পর্ব হতে পারে)
loading...
loading...
একজন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি ছিলেন জাদুকর। সাহিত্যের জাদুকর। তিনি যেমন সাহিত্যকে করে তুলেছেন সাধারণ মানুষের মানবীয় অনুভূতিতে পরিপূর্ণ, তেমনি অতি সাধারণ মানুষকেও করে তুলেছেন সাহিত্যের রস আস্বাদনে উন্মুখ, সমালোচক।
সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর আমাদের শব্দনীড় এর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
loading...
এই লেখায় আপনার মন্তব্যের পরেও কিছুটা যোগ করা হল স্যার। প্রথম মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।




loading...
অসংখ্য ধন্যবাদ মি. আনিসুর রহমান। লিখার কলেবর বৃদ্ধি করার জন্য।
যথার্থই বলেছেন …
“হুমায়ূন আহমেদ জীবনকে শুদ্ধতা ও নৈতিকতার আলোকে ব্যাখ্যা করেননি শুধুমাত্র। দায়িত্ব ও কর্তব্য ভাঁড়ে জর্জরিত করেননি জীবনের স্বল্প সময়কে। উন্নতির মাপকাঠিতে জীবনকে যান্ত্রিক ও নিষ্প্রাণ করে তুলেননি তার লিখনিতে।
বরং জীবন যেমন, জীবন আসলে তেমন ভাবেই সুখের এই কথাই আড়ম্বর করে বুঝিয়েছেন বারংবার তার লিখনিতে। বুঝিয়েছেন জীবনকে আসলে মূল্য দিতে হয়। উপভোগ করতে হয় নিজের মত করে।
সাজাতে হয় সাধ্যের মধ্যে পছন্দের উপকরন দিয়ে।”
___ এখানেই অন্য সকল গুণী সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর পার্থক্য।
loading...
অশেষ ধন্যবাদ স্যার দ্বিতীয় বার লেখাটি যত্ন নিয়ে পড়ার জন্য । আপনি ঠিকই বলেছেন, এখানেই অন্য সকল গুণী সাহিত্যিকদের সাথে হুমায়ূন আহমেদের পার্থক্য।


loading...
বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করার জন্য ধন্যবাদ স্যার।
loading...
স্বাগতম মি. আনিসুর রহমান।

loading...
হুমায়ূনের সফলাতা হল তিনি পাঠক তৈরি করেছেন। বইমুখী একটা জোয়ার তোইরি করেছেন। আমাদের দেশে সেটা ছিল না।
কিন্তু সে জোয়ার আবার মনে হয় ভাটার দিকে যাচ্ছে।
loading...
আমারও তাই মনে হয় । তবে তেমনটি হলে আসলেই তা দুঃখজনক !
loading...
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যপার হল আমাদের মধ্যে কি রকম পাঠহীনতা চলছে তা শব্দনীড়ের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। এমনিতেই জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে সম্ভবত গভীরতা প্রকৃতগত ভাবেই কম। গভীরতাহীন হুজুগে নাচা একটা জাতি বই পড়ে কিছুটা হলেও আগাতে পারত। আমাদেরকে যেন ভূতে পেয়েছে। তাই ভুতের মতই আমরা পেছনে যাই।
loading...
আমরা সবাই কবি ও লেখক । আমরা চাই আমাদের লেখা সবাই পড়ুক। কিন্তু আমরা আমরা কারো লেখা পড়ি না। কারন আমরা সত্যিই জানি না যে ভালো বই এবং বেশি বেশি বই না পড়লে ভালো কবি ও সাহিত্যিক হওয়া যায় না। এই কথাগুলো সবার ভালো নাও লাগতে পারে কিন্তু এটাই সত্য । শুধুমাত্র কবি সাহিত্যক হিসাবে নয়।যে কোন একজন সচেতন মানুষের উচিত প্রচুর বই পড়া। জাতি হিসাবে গভীর বিষয়াবলীতে আমাদের চিন্তার গভীরতা কম হলেও হালকা বিষয় নিয়ে আমরা অনেক গভীর মাতামাতিতে ব্যাস্ত। তাই সবাই সামনে আগায় আর আমরা আগাইয়া পেছনে। আপনার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। অনেক ধন্যবাদ আমাদের সমস্যার গভীরে আলোকপাত করার জন্য ।
loading...