রাজশাহী রেল স্টেশন থেকে রিক্সায় দুজনে প্রিয়ন্তীর মেস পর্যন্ত এলো কিন্তু প্রিয়ন্তীর মুখে কোন কথা নেই। গম্ভীর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। চোখ দু’টো টলমল করছে, বার বার করে সুশান্তর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, তার মন বলছে সুশান্তকে এখনি সবকিছু বলবে কিন্তু মুখ আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর মনের অবস্থা বুঝে জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে?
সুশান্ত তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
বল।
এখন না, বিকেলে নিরিবিলি কোথাও বসে বলব।
সুশান্তর মুখ শুকিয়ে গেল, খারাপ কিছু নয় তো।
খারাপ তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মনটা শক্ত করতে হবে।
প্রিয়ন্তী এখনি বল না, আমার খুব ভয় করছে।
প্রিয়ন্তী গম্ভীর গলায় বলল, ছেলেমানুষ এত ভয় পেলে কি চলে?
ততক্ষণে রিক্সা প্রিয়ন্তীর মেসের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়ন্তী রিক্সা থামতে বলল, আমি নেমে যাচ্ছি তুই বিকেল পাঁচটায় গেটে এসে আমাকে মিস্ কল দিস।
আচ্ছা ঠিক আছে।
বিকেলে দুজনে বের হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কোথায় যাবি?
তোকে বলেছি না, নিরিবিলি কোন জায়গায়।
এত কী কথা যে নিরিবিলি জায়গা দরকার?
খুব জরুরী না হলে তো তোকে এভাবে বলতাম না সুশান্ত।
তাহলে ভদ্রা পার্কে চল।
তাই চল।
সুশান্ত বলল, এই রিক্সা ভদ্রা পার্কে যাও।
অন্যদিন হলে রিক্সায় বসে প্রিয়ন্তী অনেক কথা বলতো, তার যেন কথার শেষ নেই। কথার মাঝে মাঝে একটু করে হাসতো। তার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে, যাকে বলে সদা হাস্য মুখ ইংরেজীতে স্মাইলিং ফেস কিন্তু আজ সেই হাস্যজ্জ্বল মুখের ওপর একটা গাঢ় কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে। সুশান্ত যতদিন থেকে প্রিয়ন্তীর সঙ্গে মেলামেশা করছে ততদিনে সে একবারও প্রিয়ন্তীকে আজকের মতো চিন্তিত দেখেনি তাই আজ প্রিয়ন্তীর এই অস্বাভাবিকআচরণ তাকে চিন্তিত করে তুলল। সে বার বার প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু প্রিয়ন্তী অনঢ়।
রিক্সা ভদ্রা পার্কের গেটে এসে দাঁড়ালো।
দুজনে রিক্সা থেকে নেমে ভিতরে ঢুকলো। পার্কে উত্তর দিকটায় গাছপালা একটু ঘন, সবাই নিরিবিলি কথা বলার জন্য পার্কের এই উত্তর দিকটাকেই বেছে নেয়। সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী দুজনে পার্কের গেট দিয়ে ঢুকে উত্তর দিকে গিয়ে ঘাসের ওপর বসল।
কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। প্রিয়ন্তী কথাটা সুশান্তর কাছে কিভাবে উপস্থাপন করবে ভাবছিল।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে?
প্রিয়ন্তী শুষ্ক হাসি হেসে বলল, না, তেমন কিছু না।
তাহলে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমাকে বল?
আসলে তোকে বললে তুই কি মনে করবি বুঝতে পাচ্ছি না।
প্রিয়ন্তী মনে হয় তোর সঙ্গে আমার কেবল আজকেই পরিচয় হলো যে কিছু বলতে গিয়ে সংকোচ করছিস। কোন সংকোচ না করে বলে ফেল, যদি কোন সমস্যা হয় দুজনে সমাধান করতে হবে।
থ্যাংক ইউ সুশান্ত, আমি তোর কাছে এমন একটা কথাই আশা করছিলাম।
কী হয়েছে এখন বল তো?
প্রিয়ন্তী পার্বতীপুর তার দিদির ঠাকুরপো বিদ্যুতের কথা সুশান্তকে বলল।
সুশান্ত সবকিছু শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তার মুখে কোন কথা নেই, তার হৃৎপিণ্ড যেন দ্রুত গতিতে চলছে, তার হৃৎপিণ্ডের ধড়াস ধড়াস শব্দ প্রিয়ন্তীকে আতংকিত করে তুলল।
সুশান্ত বলল, তুই কি বিদুৎকে বিয়ে করবি?
প্রিয়ন্তী রেগে গেল, তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, তুই এমন কথা বলতে পারলি? তুই জানিস না তোকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করব না।
সরি প্রিয়ন্তী, তাহলে এখন কী করবি?
প্রিয়ন্তী আরো রেগে গেল, এখন কী করতে হবে তাও আমাকে বলে দিতে হবে, এজন্য অনেকদিন আগেই আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যদি কোনদিন কোন সাহসী ভুমিকা নিতে হয় তবে নিতে পারবি কি না?
পারবো, আমাকে কী করতে হবে তুই বল?
আমাকে বিয়ে করতে হবে।
করব।
তাহলে আয়োজন কর।
আমাদের বাড়িতে বলব।
না, বাড়িতে বললে কোন পক্ষই বিয়েতে রাজি হবে না।
কেন? আমি বিয়ে করতে চাইলে তারা রাজি হবে না কেন?
সুশান্ত এত সরল হলে চলে না, তুই বাড়িতে বললে পণের কথা জিজ্ঞেস করবে আর পণ পাবি না বলে তোকে আমাকে বিয়ে করতে দিবে না।
তাহলে এক কাজ করি, আমি আজকের রাতটা ভেবে দেখি, আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করি তারপর যা হয় কাল করব।
সব বন্ধুদের সঙ্গে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, তোর খুব ঘনিষ্ঠ দু’য়েকজন বন্ধুকে বললেই হবে।
আচ্ছা।
কী করলি আমাকে রাতেই জানাবি?
ঠিক আছে।
রাতেই মোবাইলে সব কথা হলো। সবকিছু শুনে প্রিয়ন্তী খুশি হলো, সুশান্ত এতদিনে তোর বুদ্ধি খুলেছে। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন প্রিয়ন্তী তার দু’বান্ধবী আর সুশান্ত তার দু’বন্ধুকে নিয়ে মন্দিরে যাবে, সেখানে তাদের বিয়ে হবে। তাদের বিয়ের ব্যাপারটা আপাততঃ গোপন থাকবে কিন্তু একটা ব্যাপার প্রিয়ন্তীর মাথায় ঢুকল না। মাথায় সিঁদুর পরলে বিয়ের ব্যাপারটা গোপন থাকবে কী করে?
মন্দির থেকে ফেরার পর সিঁদুর মুছে ফেলবি।
প্রিয়ন্তী বুকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেল, সিঁদুর মুছে ফেলবো, হিন্দু মেয়েদের সিঁদুরই সব। আমরা দুজনে যে পুরো সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছি তা তো শুধু সিঁদুরের জন্যই, আর সিঁদুরটাই মুছে ফেলবো!
আচ্ছা ঠিক আছে তুই যখন চাচ্ছিস না তখন না হয় সিঁদুর পরবি না।
তা কি করে হয় তুই আমাকে বিয়ে করবি আর সিঁদুর পরাবি না।
সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী আগে মন্দিরে যাই, বিষয়টা ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ করি তারপর না হয় সিদ্ধান্ত হবে।
তবে খেয়াল রাখিস সুশান্ত তোর পরিয়ে দেয়া সিঁদুর আমি মুছতে পারবো না।
সিঁদুর পরানো নিয়ে সুশান্ত আর প্রিয়ন্তীর মধ্যে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল তা কেটে গেল। সুশান্তর এক বন্ধু ঠাকুরকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে কি যেন বলল, কিন্তু ঠাকুর তার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। এখন তো কার্তিক মাস হিন্দু ধর্মে সংস্কার বলে অনেক কিছু আছে, সবকিছুকে অবহেলা করলে সমাজের অমঙ্গল হবে।
পরে অবশ্য ঠাকুর বিয়ে পড়ালেন ঠিকই কিন্তু বললেন, আগামী মাসে আরেকবার এসো আমি বিয়ে পড়িয়ে দিব।
এই বিয়ের না থাকলো কোন সামাজিক স্বীকৃতি, না থাকলো কোন রাস্ট্রীয় স্বীকৃতিউভয়ে পরষ্পরকে স্বামী-স্ত্রীরমর্যাদায় আসন দিলেও প্রিয়ন্তীর চলাফেরা থাকলো ঠিক আগের মতোই শাঁখা সিঁদুর ছাড়া অবিবাহিত মেয়ের মতোই। দুজনে বসবাস করতে লাগল ঠিক আগের মতোই, সুশান্ত তার মেসে আর প্রিয়ন্তী তার মেসে।
সুশান্তর সঙ্গে প্রিয়ন্তীর দ্বিতীয়বার বিয়ের ঘটনাটা অন্যরকম আইন সম্মত কিন্তু তাতেও সমাজের স্বীকৃতি নেই। সমাজের স্বীকৃতিযেন একেবারে সংস্কারে বাঁধা। সমাজে মানুষের অধিকারের চেয়ে সংস্কারের মূল্য অনেক বেশি।
চলবে..
এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ভিজিট করুন:আমার ঠিকানা
loading...
loading...
মোটামুটি বেশ খানিক বিরতির পর উপন্যাসের অংশবিশেষ পড়লাম।
ধন্যবাদ প্রিয় জিল্লুর রহমান ভাই। আশা করবো ভালো আছেন।
loading...
আমার লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ মুরুব্বী। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি পেশায় প্রকৌশলী। তাই কয়েকটা কাজের e-GP এর নোটিশ করতে হলো। তাই এবার একটু দেরি হলো। আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
loading...
‘মনটা শক্ত করতে হবে’, ভয় শীঘ্রই কেটে যাবে। বিকেল গড়িয়ে এলো, দু’জনে রিলিবিলি বসলো। মনের একান্ত গোপন অভিপ্রায় ব্যক্ত হলো। ক্রমান্বয়ে উপন্যাসের পুরোটা চিত্তাকর্ষক আঙ্গিকে শেষ হলো। মুগদ্ধতা র’লো।
জিল্লুর ভাইকে আন্তরিক সালাম র’লো।

loading...
আপনাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ ভাই। আশা করি উপন্যাসটির শেষ পর্যন্ত থাকবেন।
loading...