আমতলায় ভূতের ভয়

images

১৯৭১ সালের চৈত্র মাস। আমি এবং আমার তিন সহপাঠী মিলে আমরা ঠিক করলাম, খাল সেচে মাছ ধরব। এমনি এক মহান পরিকল্পনা নিয়ে এক দিন হাওরে গেলাম। একটি খালের কিছু অংশ নির্ধারণ করে, দুই দিকে বাঁধ দিয়ে সেচনী দিয়ে পানি সেচা শুরু করেছি। এমন সময় হঠাৎ চেয়ে দেখি আমাদের এক সহপাঠীর বাবা, উনার নাম ছাবু মিয়া, তিনি এসে উপস্থিত। আমরা উনাকে দেখে প্রথমে ভয়ে একটু চমকে উঠি। কিন্তু চাচা আমাদের ভয় ভাঙ্গিয়ে বললেন- “ও ছেলেরা আমি তোমাদেরকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত, সাড়া বাড়ন্তী গ্রাম পাঞ্জাবীরা দখল করে নিয়ে গেল আর তোমরা এখানে মাছ ধরার জন্য পানি সেচ করছ! চল সবাই বাড়িতে চল ওসবের দরকার নেই। বাড়িতে তোমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে”।
ছাবু চাচার কথা শুনে আমরা সবাই হাসতে হাসতে অস্থির। তিনি যে অত্যন্ত রসিক মানুষ সে কথা আমরা সবাই জানি। তার একটা বিশেষ গুন ছিল, কথা বলে কান্নারত মানুষকে হাসাতে পারতেন। ছাবু চাচার হুকুমে তাৎক্ষণিক ভাবে আমরা সব কিছু ফেলে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পথে যেতে যেতে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদেরকে এমন করে অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কারণ কি? তখন চাচা বললেন,
আসল কথাটি হলো, আমাদের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়ীতে পাঞ্জাবী এসেছে! তাই আশপাশ গ্রামের সবাই আতঙ্কিত। কে জানে, কখন কোন গ্রামে হঠাৎ কোন মসিবত এসে যায়!
এ ভাবেই ছাবু চাচার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িতে আসা মাত্র দেখতে পেলাম গ্রামের কিছু হিন্দু লোক তাদের মূল্যবান জিনিস পত্র বাবার নিকট জমা রাখতে এসেছে, যদি বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয় সেই লক্ষ্যে। কাশি বাড়ির জলধর নাথের ছেলেরা তাদের নৌকাটাও আমাদের পুকুরের মধ্যে ডুবিয়ে রাখছে।

বিকাল বেলা বাড়ির দক্ষিণে অন্যান্য ছেলেদের সাথে খেলতে যাব, এমন সময় পথের দিকে তাকাতেই দেখি আম তৈল গ্রাম থেকে এক হিন্দু পরিবার সোজা আমাদের বাড়িতে ঢুকছে, সাথে সাদা রঙের খুব সুন্দর একটা পোষা কুকুরও ছিল। দেখলাম বাড়িতে ঢুকেই বাবার সাথে কি যেন আলাপ করছে। একদম শেষের কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা সবাই বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে যাবে, তাই ঐ কুকুর যেন তাদের চলার পথে বাধার কারণ না হয়। সে জন্য ওকে আমাদের বাড়িতে রেখে যেতে চায়। বাবার সম্মতি পেয়ে তখন রশি দিয়ে সুপারি গাছের সাথে কুকুরকে বেধে রেখে তারা চলে গেল। হঠাৎ বিনামূল্যে এমন সুন্দর একটা কুকুর পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম। মালিক চলে যাওয়ার সাথে সাথেই কুকুর যে ঘেউ ঘেউ ডাক শুরু করল তা একবারও বন্ধ হচ্ছে না। আমরা ওকে আদর করে খাবার খেতে দিলাম, চেষ্টা করলাম যাতে ঘেউ ঘেউ ডাক বন্ধ করে একটু শান্ত হয়, এতে হয়ে গেল হিতে বিপরীত। সে আরও বেশী করে ঘেউ ঘেউ করে ডাকা শুরু করল, এবং তার চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রু বইতে লাগল। সে দিন মালিকের জন্য কুকুরের এই আর্তনাদ কতটা হৃদয়বিদারক ছিল তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ওর মুখের কথা বুঝতে না পারলেও মনের কথাটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়ির সবাই ওর একটানা ডাকে বিরক্ত হয়ে গেল, তখন বাবা লোক দিয়ে কুকুরটা ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পাওয়া মাত্র ওর মালিক যে দিকে গিয়েছিল ঠিক সে দিকেই ওদের সন্ধানে দৌড়ে চলে গেল, তবে কোথায় গেল সে খবর আর জানা হয়নি। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে যাব, এমন সময় হারিকেন হাতে নিয়ে আমার খালু এসে উপস্থিত। রাত্রি বেলা হঠাৎ করে খালু কেন আসলেন? এতে সবাই উদ্বিগ্ন, আমারও জানতে ইচ্ছা হল। খালু বললেন, মাসুদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। মাসুদ আমার খালাত ভাই। আইএ পাশ করে সবে মাত্র বিএ ক্লাসে পড়া শুরু করেছেন। এমন সময় সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। এইজন্যে সবাই একটু চিন্তায় পরে গেল।

হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরছে। তাছাড়া ছাত্রদের উপর তাদের আক্রোশটা যে খুব বেশী, এ ব্যাপারটা সবাই বুঝে ফেলেছে। হানাদার বাহিনীর নজরে পরে গেলেন কি? এসব দুশ্চিন্তা নিয়ে পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। আমার খালু পেশায় প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার, উনার নাম আব্দুল বারিক রইছ, তবে এলাকার মধ্যে রইছ মাষ্টার নামেই পরিচিত। তিনি অত্যন্ত সম্মানী এবং ধার্মিক লোক ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পাশাপাশি তাহাজ্জুদের নামাজও নিয়মিত আদায় করতেন। দুই সপ্তাহ পরে মাসুদ ভাইয়ের খবর পাওয়া গেল, তিনি ভারতের শিলচরে আছেন। তখন খালু উনার চাচাত ভাইকে সাথে নিয়ে, মাসুদ ভাইয়ের সন্ধানে হানাদার বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে কোন ভাবে ভারতের শিলচরে পৌঁছেন। সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে মাসুদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মাসুদ ভাইকে অনেক বোঝালেন, অনুরোধ করলেন খালা কান্নাকাটি করছেন তাও বললেন অর্থাৎ একজন পিতা তার ছেলের মত পরিবর্তনের জন্য যত প্রকার প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় এর সবটাই প্রয়োগ করলেন কিন্তু মাসুদ ভাই এতে কোন সাড়া দেননি। তিনি তার প্রতিজ্ঞায় অটল রইলেন। তার একটাই কথা, যে দিন দেশ স্বাধীন হবে আর যদি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি,তখন বাড়িতে ফিরে আসব ইনশাল্লাহ। আপনারা চলে যান শুধু দোয়া করবেন, আমরা যেন এ দেশ স্বাধীন করতে সফল হই। এটা আমাদের ব্রত দয়া করে এর বেশি আর কিছু বলবেন না। নীরবে এসেছেন নীরবেই ফিরে যান আর বাড়ি গিয়ে কাওকে কিছু বলবেন না, মনে করবেন আমাদের মাকে বাঁচাবার জন্য আমাদের এই যুদ্ধ। খালুর সব চেষ্টাই হয়ে গেল অরণ্যে রোদন। নিরাশ হয়ে দুঃখ বেদনা ভরা মন নিয়ে ফিরে এলেও মনে মনে নিশ্চয় একটু সান্ত্বনা পেলেন যে আমার ছেলে দেশের জন্য কাজ করছে, ওকে আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম খোদা তুমি ওদের সহায় হও। খালু বাড়িতে ফিরে এলেন। আশ্বিন মাসের শেষ দিকে আমি এবং আমার এক মামাত ভাই খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাদের বাড়ি দামিয়া গ্রামের মূল রাস্তার উত্তর পাশে। বাড়ির দক্ষিণের দুই তৃতীয়াংশ জাগার মধ্যে পূর্ব এবং পশ্চিমে দুটো ঘর, উত্তরের এক তৃতীয়াংশে বিভিন্ন গাছ গাছালিতে ভরা, দেখতে জঙ্গলের মত, এর এক পাশে খড় রাখার জন্য ছোট একটা ঘর আছে।

খালাদের সংলগ্ন পশ্চিমের বাড়ি রাজা মিয়ার। এর আধ মাইল পশ্চিমে চর্মকার বাড়ির (মুচি) শ্মশান। ওখানে কয়েকটা অশ্বত্থ গাছও আছে তার মধ্যে একটা গাছ অনেক পুরনো। শুনেছি ঐ জায়গা খুবই ভয়ংকর। অনেকেই ভয় পায়। শ্মশানের অশ্বত্থ গাছে অনেক ভুতের বসবাস। রাত্রি বেলা এলাকার লোকজন ভূতের ভয়ে ঐ গাছের নিচ দিয়ে চলাফেরা করে না। বিকাল বেলা আমার বয়সের খালাত দুই ভাই সহ আমরা চার পাঁচ জন বাইরে খেলতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় খালা আমাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। উঠানের উত্তর পাশে যেতে পারবেনা, বাহিরে অন্য জাগায় গিয়ে খেলাধুলা কর। শুনে খালাকে বললাম কেন? তিনি বললেন- আমাদের খড়ের ঘরের পাশে বড় আম গাছে ভূতে বাসা বেধেছে।
ভূত! একথা শুনে আমি চমকে গেলাম।
খালাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কখন এবং কিভাবে ঐ গাছে ভূত আসল। খালা বললেন! প্রায় এক মাস হয়, পশ্চিম বাড়ির রাজা মিয়ার সাথে এসেছে। রাজা কোন এক কাজে একদিন জিনার পুর গিয়েছিল রাতে বাড়ি ফেরার সময় ভুলে চর্মকার বাড়ির (মুচি) শ্মশান দিয়ে হেঁটে আসছিল, তখন অশ্বত্থ গাছের ভূতের ছায়া তার উপর পরে আর ওতেই ভুত তার সঙ্গী হয়ে যায়। ওর সাথে সাথে এখানে চলে আসে। এর কয়েক দিন পরেই ঐ ভূত তাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে গাছের ডালে লটকিয়ে মেরে ফেলে। শুনে আমরা বললাম তা হলে ঐ ভূত রাজার বাড়িতে থাকবে কিন্তু আপনাদের আম গাছে কেন? খালা বললেন সে বাড়িতে ভূতের বসবাসযোগ্য উপযুক্ত তেমন কোন বড় গাছ পায় নাই, তাই আমাদের বড় আম গাছটি ওদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত বলে বেশি পছন্দ হয়েছে। আর তখন থেকেই তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঐ গাছেই জীবন যাপন শুরু করছে। খালাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম-
এসব জানলেন কিভাবে? ভুত কি আপনি নিজের চক্ষে দেখেছেন, বা ওর সাথে কথা হয়েছে!? তিনি বললেন, দেখতে পারি নাই বা কথাও হয়নি, তবে জাহিদ মোল্লাকে এনেছিলাম, তিনি ইস্তেখারার মাধ্যমে সরাসরি ভুতের সাথে আলাপ করে বিস্তারিত বিবরণী আমাদেরকে জানিয়েছেন।

আমাদের কারো কোন ক্ষতি করবেনা বলে উনাকে আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু ছোট ছেলেরা সে দিকে খেলাধুলা বা গোলমাল করলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে আর তখনি রেগে গিয়ে গাছে লটকিয়ে রাখবে এই সব কথা বলে সাবধান করে দিয়েছে। এসব শুনে সত্যিই আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। রাতে ঘুমানোর আগে আমাদের মধ্যে কিছু কিসসা কাহিনী যথারীতি হয়ে থাকে, কিন্তু ঐ দিন ঘুমের প্রস্তুতি সভার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল “আম গাছের ভূত সমাচার”। কেউ বলছে ভূত দেখতে কি রকম, কালো না ধলো? আহা! যদি কোনোমতে এক বার দেখতে পারতাম! আরেকজন বলছে রাতে ভূতের কথা আলাপ করলে ওরা অনেক দূর থেকেও তা শুনতে পারে। আমি তখন বললাম শুনলে কি হলো, দেয়ালের ভিতর কি ভূত কখনও আসতে পারে? সে রাতে এভাবেই ভুত প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরি। শেষ রাতে ঘুম ভাঙলে শুনলাম খালা এবং খালু তাহাজ্জুদ নামায পরে মাসুদ ভাইয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে দোয়া করছেন। দুই দিন পরে যার যার বাড়িতে চলে আসলাম। ওই সময় শ্রীমঙ্গলের তেলিয়াপারায় হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। আমরা বাড়ি থেকে কামান আর মেশিন গানের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেতাম।
দিন যায় রাত আসে। মানুষের জীবন একটা অনিশ্চয়তার মাঝে কাটছে আর এভাবেই এসে গেল ১৬ই ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়ে নতুন একটা রাষ্ট্রের সূচনা হল। মুক্তি যোদ্ধা যারা বেঁচে আছেন প্রত্যেকই যার যার বাড়িতে ফিরে আসছেন, কিন্তু মাসুদ ভাইর কোন খবর এখন পর্যন্ত নেই। সবার মনে একটাই সন্দেহ, উনি কি জীবিত আছেন? হঠাৎ একদিন মাসুদ ভাইদের গ্রামের এক মুক্তি সেনা এসে বলল, মাসুদ ভাই বেঁচে আছেন, তবে স্বাধীন হওয়ার সময় তিনি বগুড়া জিলায় ছিলেন, তাই আসতে একটু সময় লাগবে। সত্যই এর দুই দিন পরেই তিনি বাড়িতে ফিরে আসলেন।এই খবর শোনার সাথে সাথেই সকল আত্মীয় স্বজন মাসুদ ভাইকে দেখতে খালার বাড়িতে যান, আমি নিজেও গেলাম।

মাসুদ ভাইর সাথে সকলের কুশল বিনিময় চলছে। উনার গুলিবিদ্ধ পায়ের ক্ষত দেখাচ্ছেন, যুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন, তার যুদ্ধের নানা কাহিনী শোনাচ্ছেন! সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমার বয়সি যারা ছিল তাদের কিন্তু এসব শোনার মোটেই আগ্রহ নেই। আমরা শুধু ভূতের খবর জানার কৌতূহল নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন যে খালাকে জিজ্ঞাসা করতে পারব! সেই সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছি। দুপুরের আগে চা চক্রের আসরে আবার আলাপ আলোচনা জমে উঠল। এমন সময় এক সুযোগে খালাকে জিজ্ঞাসা করলাম-
-আম গাছের ভূতের খবর কি?
খালা এবার হেসে দিলেন, বললেন- ভূতরা সবাই ছেলে পিলে নিয়ে চলে গেছে!
শুনে একটু থমকে গেলাম! কিভাবে গেল? তাছাড়া জাহিদ মোল্লাকে নাকি বলেছিল সারাজীবন ওখানেই থাকবে।
খালা বললেন- অন্য একজন মোল্লা এনেছিলাম যার তাবিজের শক্তি খুব বেশি, তাই ঐ ভুতেরা এখানে টিকে থাকতে পারে নাই।
জানতে চাইলাম- ঐ মোল্লার নাম কি?
খালা বললেন- নাম হল মুক্তিবাহিনী।
আবার বললাম- ভুত গুলি কি শ্মশানে চলে গেছে?
খালা বললেন- ওখানে যায় নাই, তবে এক দম সোজা পাকিস্তান চলে গেছে।
-পাকিস্তান কেন?
-ওদের আসল বাড়ি হল পাকিস্তানে।
শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম! পাকিস্তানের ভূত এদেশে কি ভাবে আসল?
তিনি বললেন- ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে ঐ ভূত গুলি এদেশের মাটিতে এসে মানুষের উপর বিভিন্ন প্রকার শোষণ ও নির্যাতন করছিল, ওদের দমন করতে আমাদের মুক্তিবাহিনী গঠন হয়।
-ওরা কি আবার আসবে?
-না! এ মাটিতে কখনও আসতে পারবেনা।
-যদি আসতে চায়?
-চাইলেও পারবেনা, চোখ অন্ধ হয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরবে।
এবার খালার চেহারা মলিন হয়ে গেল, চোখ দিয়ে পানি আসছে, আমাদেরকে আদর করে ডেকে বললেন-
-আমার সোনামণিরা, আমি এত দিন তোমাদেরকে একটা মিথ্যা ভয়ের মধ্যে রেখে ছিলাম, এবার সত্যি কথাটা বলি শোন, আসলে ভূত বলতে কিছুই নেই, আম গাছেও ভূত ছিলনা, শ্মশানে ও ভূত নেই। রাজা মিয়াকেও ভূতে মারে নাই। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সে নিজেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যখন ভুতের কথা বলেছিলাম তখন আমার বাড়িতে ঐ আম গাছের পাশে খড়ের ঘরে চার জন মুক্তিবাহিনীকে থাকার জন্য আশ্রয় দিয়েছিলাম। তারা প্রায় বিশ দিনের মত ঐ ঘরে ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে গেরিলা অপারেশনের জন্য বেরিয়ে যেত এবং ভোর হওয়ার আগেই এখানে ফিরে আসত। আমি এবং তোমাদের খালু ব্যতীত অন্য কেউ এ কথা জানত না। তাদেরকে রান্নাঘর থেকে নিয়মিত খাবার দিয়েছি কিন্তু আমার নিজের সন্তানরাও টের পায়নি। তোমাদের বয়স কম, মনটাও কাঁচা, যদি কোনক্রমে তোমরা দেখে ফেলতে, তখন হয়ত অন্য লোকেরা জেনে যেত, আর এভাবেই মুখে মুখে খবরটা হানাদার বাহিনীর কানে পৌঁছে যেত, তখন ওরা এসে আমাদের সবাইকে মেরে বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে কারবালা বানিয়ে দিত। এ জন্যই আমি সে দিকে যাওয়া থেকে তোমাদের বারণ করেছিলাম।

সেদিন আমার খালার এমন একটা অসাধারণ দুঃসাধ্য কাজের বর্ণনা শুনে উপস্থিত সবাই অত্যন্ত ভীতিজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন- কোন ভরসার ভিত্তিতে এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বভার নিয়েছিলেন?
খালা বললেন- তা অবশ্যই জানি, বিষয়টা ছিল খুবই স্পর্শকাতর এবং বিপদজনক, কিন্তু আমার নিজের ছেলেও মুক্তি যুদ্ধে গিয়েছিল, সে তখন দেশের কোন জাগায় কি অবস্থায় ছিল জানিনা, হয়ত আমার মত কোন মা তাকেও একই ভাবে সাহায্য করবে, এই ভেবে আমার হৃদয়ের সকল ব্যাথা বেদনার অনুভূতি নিয়ে আমার নিজ সন্তানের মুখ মনে করে আমি তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। পক্ষান্তরে ওরা যুদ্ধ করছে দেশের জন্য, তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা প্রতিটি মানুষের নাগরিক দায়িত্ব।
সে দিন খালা ভূতের উদাহরণ দিয়ে যে তাত্ত্বিক কথা গুলা বলেছিলেন এগুলার তাৎপর্য এখন যে ভাবে বুঝতে পারি তখন কিন্তু পারিনি। ওই যুগের একজন সাধারণ পল্লীবধূ যার যৎসামান্য লেখা পড়া হয়ত ছিল কিন্তু উনি যে কত সাহসী, দূরদর্শী এবং জ্ঞানী ছিলেন তা চিন্তা করলে আশ্চর্য হয়ে যাই। আমার খালার কথা মনে হলে এখন বুঝি এদেশের কত মা বোন এমনি করে নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা না ভেবে কত কি দিয়ে গেছেন যা আমরা কেও কোনদিন জানতেও পারব না, তাদের সবাইকে জানাই শ্রদ্ধা ও সম্মান।

আমাদের স্বাধীনতার জন্য এ দেশের হাজার হাজার মা বোনের কত যে অবদান আছে, সে খবর কি কেউ রাখে? বা জানতে পেরেছে কোনদিন? এর প্রেক্ষিতেই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আগেই লিখে গেছেন, “কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে”, কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা? আমরা বাঙালি, আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, পতাকা, জাতীয় সংগীত! তাই জাতীয় পরিচয় নিয়ে যখন বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন মনে হয় একাত্তর সালের চলে যাওয়া সেই ভূতের ছায়া এখনও বাংলার মাটিতে রয়ে গেছে, এই ভূতের ছায়া কবেই যে এই মাটি থেকে বিদায় নিবে সেই সুদিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মোঃ খালিদ উমর : ০৩-০৪-২০১৭ | ২০:২৯ |

    রেতের বেলা ভয় পাইলে কিন্তু আমার কোন দোষ নাই!

    GD Star Rating
    loading...
    • সমছু মিয়া : ০৩-০৪-২০১৭ | ২১:০৩ |

      লন্ঠন জ্বালিয়ে থাকবেন তাই ভয় পাবেন না!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ০৩-০৪-২০১৭ | ২০:৪৭ |

    ভুত নয় তবু শৈশবের ভৌতিক ভয়। অসাধারণ ভুতের গল্প। না না গল্প বলা ভুল হলো। এমন হাজারো সত্য গল্প লুকিয়ে আছে আমাদের দেশের নানান প্রান্তরে।

    “কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে”, কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা? আমরা বাঙালি, আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, পতাকা, জাতীয় সংগীত!” https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • সমছু মিয়া : ০৩-০৪-২০১৭ | ২১:১০ |

      সালাম মুরুব্বী ভাই। ভাল আছেন?
      সত্যিই এমন অনেক গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের আশেপাশে।

      GD Star Rating
      loading...
    • মুরুব্বী : ০৩-০৪-২০১৭ | ২১:১৫ |

      সালাম এর প্রত্যুত্তর জানবেন। ভালো আছি স্যার। ধন্যবাদ। Smile

      GD Star Rating
      loading...
  3. আনু আনোয়ার : ০৪-০৪-২০১৭ | ০:৪২ |

    সুন্দর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। সাথে ভূতের আবহ, ভাল লাগল।

    GD Star Rating
    loading...
    • সমছু মিয়া : ০৪-০৪-২০১৭ | ১৮:২১ |

      শুনে খুশি হলাম ভাই। ভাল থাকবেন।

      GD Star Rating
      loading...
  4. মামুনুর রশিদ : ০৪-০৪-২০১৭ | ৭:২১ |

    “…এদেশের কত মা বোন এমনি করে নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা না ভেবে কত কি দিয়ে গেছেন যা আমরা কেও কোনদিন জানতে পারব না, তাদের সবাইকে জানাই শ্রদ্ধা ও সম্মান।”

    গল্পের বুণন নিখুঁত এবং সুশ্রী- সর্বোপরি সুখপাঠ্য; শুভেচ্ছা জানাই।

    GD Star Rating
    loading...
    • সমছু মিয়া : ০৪-০৪-২০১৭ | ১৮:২১ |

      শুভেচ্ছা আপনার জন্যেও ভাই। ভাল থাকুন।

      GD Star Rating
      loading...