ক’দিন হলো ইরার সাথে জয়ের বিচ্ছেদ হয়েছে। ওদের প্রায় তিন বছরের প্রেম, জয়পুরহাটের পথ-ঘাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পার্ক-নার্সারিতে মুক্ত পাখির মতো ছুটে বেড়ানো, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য জীবনের অবসান হয়েছে। শরীরের কোনো অঙ্গ বিচ্ছেদ হলে মানুষ দেখতে পায়, অঙ্গ বিচ্ছেদের কারণে শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে, সবাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। কেউ এন্টিসেপটিক নিয়ে, কেউ এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। ডাক্তার আসে অপারেশনের যন্ত্রপাতি নিয়ে। কেউ চুক চুক করে হলেও আফসোস করে কিন’ ওদের প্রেম, পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্কের অবসান হলো, চোখের জলে গণ্ডদেশ প্লাবিত হলো, হৃদয় রক্তাক্ত হলো কেউ একবারো বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও দেখালো না। যারা জানলো তাদের দু’য়েকজন জয়কে বললো, তোমার জয়পুরহাটের ঝামেলাটা মিটেছে?
জয়পুরহাটের ঝামেলা? কথা শুনলেই জয়ের মাথায় রক্ত উঠে যায়। ওদের হৃদয় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ওদের প্রেম, ওদের স্বপ্ন, ওদের সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো আর সবাই বলে, ঝামেলাটা মিটেছে?
টুকরো টুকরো হয়ে হৃদয়ের বিচ্ছেদ হলে কেউ দেখে না। এ যেনো খুব সামান্য ব্যাপার, প্রেম প্রেম খেলা চলছিলো, আবেগের বশে বিয়েও হয়েছিলো, তালাক হয়েছে। বাহ কাজির সবুজ রেজিস্টারে দু’টো স্বাক্ষর করেই সব বন্ধন, সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, আইনের দৃষ্টিতে হয়তো সব মিটে যায় কিন’ হৃদয়ের কাছে, দু’টো স্বাক্ষর করলেই কি অতীতের সব স্মৃতি, আনন্দ, বেদনা, সব হৃদয় থেকে মুছে যায়? না, হৃদয়ের সম্পর্ক কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
কথাটা প্রথম ইরাই বলেছিলো। ইরা বলেছিলো, আমি তোমাকে ডিভোর্স করেছি শুধু একটা রেজিস্টারের দু’টো পাতায় সই করে। কাগজে সই করলেই ডিভোর্স হয় কিন’ মনে রেখো হৃদয়ের সম্পর্ক ছিন্ন হয় না।
ইরা মানুক আর না মানুক ওদের বিচ্ছেদ হয়েছে। বিচ্ছেদের ঘা এখনো দগদগ করছে, দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোর কথা মনে করে যখন তখন দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। জয়ের যখন মনে হয় ইরা আর তার কেউ না তখন কোনোভাবেই সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে না।
সেদিন জয় নওগাঁ যাওয়ার জন্য জয়পুরহাট স্টেশনের প্লাটফরমে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। একদিন ফোনে কথা বলার সময় ইরা বলেছিলো সে ট্রেনের শব্দ শুনলেই জানালা দিয়ে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সিঁড়িঘরের স্কাই লাইট দিয়ে স্টেশনের দিকে তাকালে স্টেশনের পূর্ব দিকে যে দু’টো তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে, সেই তালগাছের ফাঁক দিয়ে প্লাটফরম দেখা যায়। জয় একথা মনে করে সেই তালগাছের ফাঁক দেখে দাঁড়ালো। যদিও কয়েকদিন থেকে ইরার সাথে তার কথা হয়নি, হয়তো হবেও না কোনোদিন। তবু ইরা যদি একবার জানালার দিকে তাকায় আর তাকে দেখতে পায়, যদি দেখতে পেয়ে ফোন দেয়। ভালোবাসার মানুষকে এক পলক দেখতে পাওয়া, কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়ার জন্য যে কত ব্যাকুলতা থাকে তা যারা ভালোবাসে শুধু তারাই জানে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার সাধ মানুষের কোনোদিন হারায় না। জয় ইরার স্কাই লাইটের কথা মনে করে দূরে একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের স্কাই লাইটের দিকে তাকিয়েছিলো। কতক্ষণ মনে নেই, সিঁড়িঘরে হয়তো ইরা নেই কিন’ সেই স্কাই লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জয়ের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। সে চোখ মুছলো, তার হাতের ডান দিকে বারোঘাটি পুকুর। এই পুকুরের পাড়ে একটা চায়ের দোকান আছে, ইরার বি.এড পরীক্ষার সময় ওরা এই চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসতো, চা খেতে খেতে গল্প করতো। ইরা এই দোকানের একটা নামও দিয়েছিলো, মধুর ক্যান্টিন। জয় দু’য়েক পা করে হাঁটতে হাঁটতে মধুর ক্যান্টিনের দিকে গেলো। তার দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।
এই জয়পুরহাট প্লাটফরমে ইরার সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ইরাসহ একবার রাজশাহী যাচ্ছিলো। ট্রেন অনেক দেরিতে ছিলো, ওরা অনেকক্ষণ এই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে দু’জনে গল্প করেছিলো। রেললাইন পার হয়ে ওপারে গিয়ে পিঁয়াজি-বেগুনি খেলো। তখন সন্ধ্যা, প্লাটফরমের লাইটপোস্টে বাতি নেই, আবছা আবছা অন্ধকার। রেল লাইন থেকে প্লাটফরম বেশ উঁচুতে, প্লাটফরমে উঠতে গিয়ে জয় ইরাকে হাত ধরে টেনে তুললো, তারপর প্লাটফরম দিয়ে দু’জনে হাঁটছিলো, ইরা জয়ের কাঁধে ভর করে গা ঘেঁষে হাঁটছে। হঠাৎ করে ইরা জয়কে টেনে ধরলো, তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, আমাকে সারাজীবন এভাবে ধরে রাখবে তো?
জয় ঘুরে দাঁড়ালো। অন্ধকারে দু’জনে মুখোমুখি, পাশ দিয়ে যাত্রীরা যাচ্ছে সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। জয় ইরার থুঁতনি উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রাখলো, ইরার দীপ্তিময় দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে। জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, সারাজীবন রাখবো।
এমনি হাজারো চিন্তা করতে করতে জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
সিরাজ ফোন করেছে, জয়ের কলিগ। তার দু:সময়ের সবচেয়ে আপনজন।
জয় রিসিভ করলো, হ্যালো আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আস্সালাম, কেমন আছো জয়?
ভালো, তুমি?
ভালো আছি, তোমার তো বদলি হয়েছে।
ক’দিন আগেও জয় বদলি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলো, যেদিন ইরা বাসা থেকে চলে গেলো, তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে শুরু করলো, জয় আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছিলাম, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছো, আমি তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবো, তোমার চাকরি খাবো, তোমাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।
তখন ইরার কথা শুনে জয়ের মনে হচ্ছিলো সে আর তার নেই, এক সময়ের বন্ধুই এখন তার দিকে বন্দুক তাক করে সুট করার অপেক্ষায় আছে। সামনে পেলে গুলি করে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দিবে। তাই সেও বদলির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো কিন’ ইরার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর পরিসি’তি এখন অনেকটাই শান্ত, জয় মাথা থেকে বদলির সিদ্ধান্তটা মুছে ফেলেছিলো। ঠিক এমন সময় সিরাজের কথা শুনে জয়ের বুকটা যেনো ভেঙ্গে গেলো। সে কিছুটা আর্তচিৎকারের মতোই বললো, বদলি!
হ্যাঁ, তুমি না এতোদিন বদলির চেষ্টা করছিলে এখন আবার এমন করে বলছো কেনো?
জয় মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো, কোথায়?
রাণীশংকৈল।
ততক্ষণে ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকে পড়েছে, ইঞ্জিন ইরার দিকে তাকানোর জানালাটা ঢেকে দিয়েছে।
জয় ট্রেনে উঠলো।
চলবে…
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল।
(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ৩য়, অর্থাৎ ০৩/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)
আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন: www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন: https://www.facebook.com/profile.php?id=100000449437795
যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমার বই পড়ুন: https://sheiboi.com/Pages/BookDetails.html?/Dag/285
loading...
loading...
জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনার এই পর্ব পড়া হলো।
ধন্যবাদ প্রিয় ঔপন্যাসিক জিল্লুর রহমান ভাই। শুভসন্ধ্যায় ধন্যবাদ।
loading...
ধন্যবাদ মুরুব্বী। আমার লেখা পড়ার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
loading...
আপনার বর্ননা শৈলী একটানে লেখার শেষ মাথায় নিয়ে যায়।
loading...
ধন্যবাদ আমার লেখার দোষগুলিও ধরিয়ে দিবেন। আশা করি আমার লেখার সঙ্গে থাকবেন।
loading...
আপনার লেখা একটি বড় আকর্ষণ হচ্ছে একটানে পড়ে শেষ করা, কোথাও থামতে হয় না, বিরক্তি বা একগোয়ামি আসে না।
পরের লেখাগুলো অপেক্ষায় রইলাম।
loading...
অনেক ধন্যবাদ ভাই। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো তারপরও আমার লেখা ফেসবুকে দিলে তেমন লাইক পড়ে না বা কমেন্টস হয় না। আসলে সেজন্য আমিও অনেকটা দায়ি। আপনি জানেন কী না জানি না আমি পেশায় প্রকৌশলী। অনেক দায়িত্বের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি তাই ব্লগে বা ফেসবুকে তেমন সময় দিতে পারি না। আর ব্লগ বা ফেসবুকের বন্ধুদের একটা বড় অংশ কমেন্টস বা লাইক আদান-প্রদান করে কিন্তু আমি যেহেতু সময় করতে পারি না তাই কারো স্ট্যাটাসে লাইক বা কমেন্টস করতেও পারি না। আপনি আমার এই ব্যস্ততাকে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। আমাকে যেনো ছেড়ে যাবেন না। ভালো থাকবেন।
loading...