ষাট/পঁয়ষট্টি বছর বয়সের এক বুড়ি, সমস্ত চুল পাকা সাদা ধবধবে, পাটের মতো সাদা। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, চিবুক, গালের চামড়ায়ও অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে। সেই বুড়ি বারো শিবালয় মন্দিরের গা ঘেঁষে প্রাচীন বটগাছটার আশেপাশে, ছোট যমুনা নদীর তীরে সেই বিকেল থেকে কী যেনো খুঁজছে, কোনো মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেলে মানুষ যেমন হন্য হয়ে খুঁজে তেমনি হন্য হয়ে খুঁজছে আর বিড় বিড় করে বুলি আওড়াচ্ছে, আরে বাবা যাবে তো যাবে, নিজের ছায়াটা তো রেখে যাবে আমার জন্য। তোমাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া দর্শন বইটা দিয়েছিলাম না, পড়েছো? পড়লে তো ছায়াটা রেখে যেতে ভুল করতে না। এরকম তুমি বরাবরই করতে, আমি তোমাকে ইমদাদুল হক মিলনের বিখ্যাত উপন্যাস নূরজাহান দিয়েছিলাম, পড়োনি। সেই উপন্যাসটা আমি কিনেছিলাম কত লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমদাদুল হক মিলনের অটোগ্রাফসহ। ইমদাদুল হক মিলন লিখেছিলেন, ’’ভালোবাসা থাকলে সব হয়’’। আর সেই অটোগ্রাফ পড়েই তো আমি তোমার কাছে চলে এলাম সবকিছু ছেড়ে। অথচ তুমি সেই উপন্যাসটা পড়লেই না।
ঠিক একই কাজ করেছো হয়তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া দর্শন বইটাও। যদি পড়তে তবে ছায়াটা রেখে যেতে ভুল করতে না। আজ এসে তোমার ছায়াটা দেখতাম। তুমি জানো তোমার ছায়াটা দেখার জন্য আমি সেই কতদূর থেকে এসেছি, লুকিয়ে, সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে। ওরা আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে দিবে না বলে আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিলো, আমাকে পাহারা দিয়ে স্কুলে পাঠাতো, স্কুলের সব কলিগদের বলে দিয়েছিলো আমি যেনো তোমার সাথে কথা বলতে না পারি। আমাকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করিয়েছিলো আমি যেনো তোমার সাথে না বলি। তবুও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছি কিন্তু সেই বেয়াদব মহিলাটা বার বার করে বলেছে, দু:খিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি সেই মহিলাটাকে কাছে পেতাম তবে আমি ওকে জুতোপেটা করতাম।
একদিন তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি ফোন করছিলাম আর সেই বেয়াদব মহিলাটা বার বার দু:খিত বলছিলো। সেটা দেখে ওরা আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো, আমাকে প্রচণ্ড মার দিলো, দেখো আমার সামনের দাঁতটা ভাঙ্গা কী না। বলে বুড়ি বট গাছের সেই যুগলবন্দি লতার কাছে দাঁড়ালো। তারপর আবার বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো, যেদিন আমরা প্রথম এখানে এলাম সেদিনই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। তারপর তোমার জন্মদিন পালন করলাম এখানে। তোমার জন্মদিনের ক’দিন আগে থেকেই সে কী প্রস্তুতি আমার, তোমার জন্মদিনে কী দেবো আমি এই নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত ছিলো না। সেদিন সকাল থেকে উত্তেজনায় আমি যেনো কাঁপছিলাম। কখন মোশা স্কুল যাবে, কখন আমি স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তোমার কাছে আসবো। তুমি বার বার ফোন করছিলে, ইরা দেরি করছো কেনো? তোমার কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি তো?
আমি বললাম, না।
তাহলে দেরি করছো কেনো?
আমি তখন বেকারিতে তোমার জন্মদিনের কেক-এ নাম লিখতে দিয়ে ক্যাটস পো’তে তোমার জন্য শার্ট কিনছি, আমি তখন কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বললাম, এতো ব্যস্ত হয়োনা তো। একটু ধৈর্য ধরো। আমি আসছি।
আমি যতই রেগে যাই তুমি আমার ওপর কোনোদিন রাগ করতে না, এটা তোমার একটা বড় গুণ। তুমি হেসে বললে, একটু তাড়াতাড়ি এসো সোনা।
আমার সব কেনাকাটা ব্যাগে নিয়ে একটা অটো রিক্সায় উঠলাম। তুমি ততক্ষণ দাঁড়িয়েছিলে। আমি দেরিতে এলাম অথচ তুমি একটুও রাগ করলে না। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললে, অনেক দেরি করে ফেললে, কখন যাবে আর কখন আসবে একবার ভেবে দেখেছো। তারপর রিক্সায় উঠলে।
বটগাছের নিচে এসে আমি তোমার হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে বললাম, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
তুমি বললে, থ্যাঙ্কস।
তারপর আমি ব্যাগ থেকে জন্মদিনের কেক বের করে কেক, মোমবাতি সাজালাম। তোমার জন্য আনা শার্ট-প্যান্ট, পারফিউম আরো যত গিফট এনেছিলাম তোমার হাতে দিলাম। তোমার চোখে-মুখে সে কি আনন্দ দেখেছি আমি। তোমার চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করছিলো। তুমি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলে, ইরা কেনো এতোকিছু করতে গেলে, কতকগুলো টাকা খরচ করে ফেললে আননেসেসারি।
তোমার চোখের পানি দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেলো, আনন্দে, গর্বে। গর্ব এজন্য যে, যে লেখকের শত শত ভক্ত যখন ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাসসহ বিভিন্ন ব্লগ এবং মোবাইল ফোনে জন্মদিন উইশ করছে সে লেখকের জন্মদিন পালন করছি শুধু আমরা দু’জন। আমার সেদিন নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো। তোমার সেই জন্মদিনটা আমার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলির একটি।
এই বটগাছের নিচে সেদিন তুমিই আবিস্কার করেছিলে এই যুগলবন্দি লতাগুল্ম, কেমন বুকের মধ্যে জড়িয়ে আছে একটা লতা আরেকটা লতাকে। এমনি তুমিও আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে। তোমার বুকের সাদা লোমগুলো আমি কাশফুল বলতাম, আমি কাশফুলে মাথা রাখতাম আর তুমি বুকে জড়িয়ে রাখতে আমাকে, আহ কী সুখ! কী অনাবিল শান্তি তোমার কাশফুলে মাথা রেখে। অথচ দেখো তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম বলে মোশা আমাকে মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিলো। ও তুমি ভেবেছো বয়সের কারণে আমার দাঁত উঠে গেছে। বলে সে আবার হি হি করে হেসে উঠলো, পাগল, আমার আর কত বয়সই হয়েছে। এই তো, এই তো সেদিনই তুমি আমার সাথে ছিলে তখন আমার বয়স ছিলো সাইত্রিশ বছর। এখন কত আর হবে আটত্রিশ উনচল্লিশ। তুমি না বলতে, ইরা তুমি কোনোদিন বুড়ি হবে না, তুমি চিরসবুজ, চিরতরুণীই থাকবে, আমি তাই আছি। তুমি একবার এসো এই বারো শিবালয়ে, এই ছোটযমুনার তীরে।
বারো শিবালয় আমাদের ভালোবাসার, আমাদের পছন্দের জায়গা, তোমার ব্যস্ততম চাকরি, আমার শিক্ষকতার ফাঁকে, আমরা ছুটে আসতাম বারো শিবালয়। এই বটগাছের নিচে, গোল করে বাঁধানো গোড়ায় আমরা বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, তুমি আমার চোখের ভাষা, মনের ভাষা সব বুঝতে। আমি যখন বাসায় মন খারাপ করে বসে থাকতাম, মনে মনে তোমাকে খুব মিস করতাম ঠিক তখনই তোমার ফোন যেতো। উ: কী যে ভালো লাগতো আমার। তুমি বিশ্বাস করো তোমার মতো করে আমাকে কেউ কোনোদিন ভালোবাসেনি আর বাসবেও না। তুমি এসো সোনা আমার, এসো। বলে ইরা যুগলবন্দি লতার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলো।
আসবে না, তুমি না বলতে ইরা যখন আমাকে খুব মনে পড়বে তখনই এখানে এসো, আমাকে পাবে, কই তুমি তো তোমার কথা রাখোনি। আমাকে দেখো, আমি ঠিকই তোমার কথা রেখেছি। ও, তুমিও এসেছো, বলে ইরা ছোট যমুনার তীর দিয়ে ভাটির দিকে যেতে লাগলো বিড়বিড় করে স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে, এইতো, এইতো আমরা এ-ইখানে দাঁড়িয়ে অনেক সেলফি তুলেছিলাম। আমি তোমার বুকে মাথা রেখেছিলাম, তুমি আমার থুতনি উঁচু করে ধরে আমার চোখে চোখ রেখেছিলে, কী আছে তোমার চোখে বলোতো, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কোনোদিন রেগে থাকতে পারতাম না, আর তোমার হাসি, বলে ইরা পাগলের মতো হো হো করে হেসে উঠলো, তোমার হাসি নিয়ে তুমি একটা গল্প করেছিলে, তোমার বাবা, মানে আমার শ্বশুর মশাই’র হাসিও নাকি খুব সুন্দর ছিলো, আমার শাশুড়ি নাকি সেই হাসির নাম দিয়েছিলো ভূবন মোহিনী হাসি। তুমিও উত্তরাধিকার সুত্রে বাবা’র সেই হাসিই পেয়েছিলে। তোমার হাসি দেখে প্রেমে পড়বে না এমন বেরসিক মেয়ে দুনিয়াতে আর একটাও নেই। তাই তোমার হাসিটাকে আমি খুব ভয় পেতাম, তোমাকে হারানোর ভয়, তোমাকে আমি বলতাম, এই তুমি কিন্তু কোনো মেয়ের সামনে হাসবে না।
তুমি জিজ্ঞেস করতে, কেনো?
তুমি হাসলে আমার ভয় লাগে, তোমার হাসি দেখে কেউ বুঝি তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলো।
তুমি বলতে, ছি: তুমি এমন কথা ভাবছো কী করে বলোতো, আমি তো তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে কখনো কল্পনাই করতে পারি না।
এবার হঠাৎ করেই ইরা গম্ভীর হয়ে গেলো, তারপর একটা লাজুক হাসি হেসে বললো, এই তুমি আবার কারো প্রেমে পড়োনি তো? ছি: এসব আমি কী ভাবছি, তুমি না আমাকে কথা দিয়েছো আর কারো সাথে তুমি জড়াবে না, এটাই তোমার শেষ প্রেম। তুমি খুব প্রতিশ্রুতিবান, তুমি যেদিন আমাকে যেটা বলেছো ঠিক সেটাই করেছো, তুমি আমাকে কথা দিয়েছো আমি মন থেকে ডাকলে তুমি আসবে, তুমি দেখো, তুমি না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো। কথা ছিলো আমরা বছরের শেষ দিনটা, শেষ গোধূলীটা এখানে কাটাবো…
চলবে …
(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ২য়, অর্থাৎ ০২/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)
loading...
loading...
শেষে একটি আনন্দ সংবাদের মধ্য দিয়ে জীবনের শেষ গোধূলী’র জয়যাত্রা করেছেন।
আমার কাছে লিখাটির এই পর্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো লেগেছে।
ভাষা সময় এবং সরস বর্ণনায় হৃদয়ের যে আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে
এককথায় অসাধারণ। আমার বিশ্বাস সাফল্য আপনার আসবেই।
শুভেচ্ছা প্রিয় জিল্লুর রহমান ভাই। সাথে আছি চালিয়ে যান।
loading...
আমার লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ মুরুব্বী। অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। এ পেশার সঙ্গে লেখার সম্পর্কটা বিপরীত ধর্মী। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কিন্তু প্রচারের অভাবে কাংখিত প্রসার ঘটছে না। এবিষয়ে আপনার কোনো পরামর্শ থাকলে জানাবেন। দোয়া করবেন মুরুব্বী।
loading...
প্রচার আসলে কিভাবে আশা করছেন জানি না, তবে আমরা যারা মফস্বলে থাকি আমাদের জন্য একটু কষ্টকর বৈকি। এগিয়ে যান।
loading...
গল্প ভাল লাগল, বিশেষ করে বলার স্টাইল।
৫৩ গল্প নিয়ে ৫৩ বছ্রের পরিকল্পনা ইন্টারেস্টিং। শুভ কামনা জানবেন।
loading...
ঠিক বলেছেন তিপ্পান্ন গল্প নিয়ে তিপ্পান্ন বছর বয়সে প্রকাশিত হবে কিন্তু এই তিপ্পান্ন সংখ্যা নির্ধারণের পেছনে যে করুণ, হৃদয়স্পর্শী, বেদনাদায়ক কাহিনী আছে তা জানতে পারবেন আমার তাসের ঘর উপন্যাসে। আগামী বইমেলায় প্রকাশিত হবে আশা করছি। আমার লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
loading...
বেশ ভাল লেগেছে পড়তে।
আপনার অন্য লেখাগুলি পড়ার প্রত্যাশা জেগে উঠল। আশা পোষ্টগুলোতে পাবেন।
শুভ কামনা আপনার প্রতি।
loading...