১৯৮২ সাল। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। কলেজের পিকনিক হয়, হবে করে করেও প্রথম বছর পেরিয়ে গেলো। আমাদের ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবী সবার মনের মধ্যেই ইচ্ছের সাত রং পাখার প্রজাপতিটা মরতে শুরু করলো। সবায় চায় পিকনিক কিন্তু কোন শিক্ষক এগিয়ে এসে দায়িত্ব নেয় না। শেষে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে আমাদের কেমেস্ট্রি স্যারকে রাজি করালাম। স্যার রাজি হয়ে প্রমাণ করলেন রসায়নের টিচার বলেই হয়ত তার যথেষ্ট রস আছে এখনো। আমরা স্যারের নামে ধন্য ধন্য রব তুললাম। পিকনিকের স্থান নির্বাচিত হলো যশোরের পিকনিক কর্ণার। যারা পিকনিকে যাবে বলে কনফার্ম করেছে তাদের বুকের মধ্যে প্রতিদিনই একটা চিকন আনন্দ নূপুর পায়ে নেচে বেড়াচ্ছে। আমরা যাবো ট্রেনে করে। আমরা সবাই খুব খুশী বিশেষ করে ছেলেরা। লম্বা ট্রেন ভ্রমনে ক্লাসের মেয়েদের সাথে খুনসুটির এক মহা সুযোগ পাওয়া যাবে। স্যার সবাইকে নিয়ে মিটিং করলেন। বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন দুই-তিন জনের একটি একটি গ্রুপ করে। আমি আর মুসা মিলে এক গ্রুপ এবং আমাদের দায়িত্ব পরলো পিকনিকের খাসী কেনার এবং দুইটা খাসীর দেখভাল করে পিকনিক স্পট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এক কথায় আমরা হলাম খাসির কেয়ার টেকার।
নির্ধারিত দিনে আমরা সবাই জয়পুরহাট রেল স্টেশনে। কলেজের সামনেই রেলস্টেশন। যথা সময়ে পার্বতীপুর-খুলনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি এসে দাঁড়ালো প্লাটফর্মে। সবাই সবার মতো করে উঠে পড়লো ট্রেনে। সবার শেষে আমি আর মুসা পরম আদরের সাথে সর্ব শক্তি দিয়ে কোলে করে খাসী দুটিকে উঠলাম ট্রেনে কিন্তু এর মধ্যে যা হবার তাই হলো। কোলে করে ট্রেনে উঠবার সময় অতি আদরে আদোরিত হয়ে ব্যাটা খাসী আমার গায়ে দিলো হিসি করে। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সারা গায়ে ছাগলের পেচ্ছাবের গন্ধ। বন্ধুরা কেউ পাশে বসতে নেয় না। পাশে বসা তো দূরের কথা, বান্ধবীরা তো আমাকে দেখলেই মুখে ওড়না চেপে ধরে। আমার সকল আশায় গুড়েবালি। যে বান্ধবীর পাশে বসবো বলে এতদিন মনে মনে ভেবেছি, ছবি এঁকে রেখেছি সেই কিনা গিয়ে বসলো স্যারের পাশে। হায়রে কপাল। হায়রে ছাগল, এতো আদর করে কোলে করে ট্রেনে উঠালাম আর সেই তুই কিনা দিলি আমার গায়ে পেচ্ছাব করে। কপাল আমার।
যাক, যথা সময়ে যশোর পৌঁছালাম। মাইকের দায়িত্বে যারা ছিলো তারা মাইক লাগিয়ে তাদের পছন্দ মতো গান বাজতে লাগলো। কখনো কখনো মনের না বলা কথাগুলো গানের ছলে নিজের পছন্দের মানুষটিকে বলার চেষ্টায় কেউ কেউ নিজেকে ব্যস্ত রাখলো। রান্নার আয়োজন শুরু করেছে একদল। কসাই এনে খাসি জবাই শেষ করেছি। কসাই উপর দায়িত্ব দিয়ে আমি আর মুসা কাউকে না জানিয়ে চুপ করে চলে এলাম রিক্সা নিয়ে সোজা সিনেমা হলে। এ-এক কঠিন নেশা তখন। নতুন সিনেমা কোন ভাবেই মিস করা যাবেনা। তা যা কিছুর বিনিময়ে হোক। আর তা যদি হয় সোহেল রানা আর সুচরিতার সিনেমা। আমরা মনে মনে হিসেব করে নিয়েছি রান্না-বান্না শেষ হতে কমপক্ষে ঘন্টা দুয়েক লাগবে। ইনশাল্লাহ আমরা তার আগেই ফিরে এসে এক সংগে খাবো কিন্তু সুচরিতার নাচ আর সোহেল রানার ফাইটিং আমাদের হিসেবে কখন যে গড়মিল করে দিয়েছে তা টের পাইনি।
যখন টের পেলাম তখন সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। ভয়ে ভয়ে ফিরলাম পিকনিকে। এসে দেখি খাওয়া-দাওয়া শেষ। সবাই সব কিছু গুছিয়ে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। আমাদের দুজনের প্রতি কারো কোন উৎসাহ নেই, কারো কোন কিছু জানবার আগ্রহ টুকুও চোখে পরলো না। এমনকি যে খুব কাছের বন্ধু সেও নির্বিকার। স্যারও কিছুই বলছে না। মনে সাহস আনবার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক সে সময় এক বন্ধুর ইশারা জানিয়ে দিলো ঝড়ের পূর্বাভাস। এবার স্যার আমাদের দু’জনকে কাছে ডাকলেন। ভাবলাম হয়ত কিছু বকা দিয়ে আমাদের জন্য উঠিয়ে রাখা খাবার খেতে দেবেন। যত অপরাধ-ই করিনা কেনো ছাগল দুটিকে তো আমরাই এত সেবা যত্ন দিয়ে নিয়ে এসেছি। এখনো আমার গায়ে পেচ্ছাবের বিকট গন্ধ যার জন্য আজ সারাদিনে বান্ধবীর সান্নিধ্য পেলাম না। না পাই, আপাতত খাবারটা পেলেই চলবে। পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। কিন্তু না, স্যার সব প্রত্যাশার গলা টিপে ধরে মাংশ রান্নার বড় দুটি হাড়ি দেখিয়ে বললেন- তোমারা দুজন ঐ দুটি হাড়ি খুব ভালো করে পরিষ্কার করে ডেকোরেটরকে দিয়ে সোজা স্টেশনে এসো। স্যারের এই নির্মম আদেশ পেয়ে এবার আমি সত্যি সত্যিই টের পেলাম আমার শরীরে ছাগলের পেচ্ছাবের বিকট দুর্গন্ধ। আমি বমি করে দিলাম সেই গন্ধে আর ক্ষমা করে দিলাম সেই সব বান্ধবীদের যারা আমাকে দেখলেই মুখে ওড়না চেপে ধরছিলো।
খাসির মাংশ রান্না করা হাড়ি পরিষ্কার করে কাঁদতে কাঁদতে স্টেশনে এলাম অনাহারে, রাগে, দুঃখে, অভিমানে। ট্রেন এক ঘন্টা লেট। মনে মনে স্যারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছি আর প্ল্যান করছি দুজন মিলে, কি করে স্যারকে একটা ছ্যাঁকা দেয়া যায়। আবার ভয়ও পাচ্ছি। ওলট-পালট কিছু করলে স্যার যদি প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দেয়, তাহলে তো সব শেষ। ঠিক তখনি স্যারের ডাক। কাছে গেলাম ভয়ে ভয়ে। আড়ালে নিয়ে গেলেন। আরো ভয় পেলাম। স্যার এবার পকেটে হাত দিলেন। তারপর আমাদের দুজনকে তিনশো প্লাস তিনশো ছয়শো টাকা দিয়ে বললেন-সমানে বড় হোটেল আছে, গিয়ে যা ইচ্ছে হয় খেয়ে আয় তাড়াতাড়ি। স্যার হাসতে হাসতে আরো বললেন-হোটেলে যাবি কিন্তু, সিনেমা হলে নয়। ১৫০ টাকা পিকনিকের চাঁদা দিয়ে পেলাম ৩০০ টাকা। মূহুর্তেই আমাদের সব রাগ-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে মুছে গেলো আর আমার শরীরে ছাগলের বিকট পেচ্ছাবের গন্ধ যেন সন্ধ্যার ধুপের গন্ধ হয়ে বান্ধবীদের নাকে চেপে রাখা ওড়না সড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মনের আনন্দে হাঁটতে লাগলাম হোটেলের দিকে।
পিকনিক-২০২২ এসে আজ ৪০ বছর পর স্মৃতিরা আমায় কাঁদিয়ে গেলো, ভাসিয়ে নিলো অন্যরকম সুখে। জানিনা, স্যার আজ কোথায়, কেমন আছে। বন্ধুরা আজ কোথায় কেমন আছে। মুখে ওড়না দেয়া বান্ধবীরা আমার কোথায় আছে কেমন আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনাদের মাঝে আমি আমার স্যারকে খুঁজি, বন্ধুকে খুঁজি, খুঁজি মুখে ওড়না চেপে রাখা বান্ধবীদের। এবার আমার পিকনিকে যাওয়া হয়নি। পৃথিবীর কোন এক নির্জন ছায়াতলে বসে তোমাদের খুঁজে পেতে চাই হাঁসতে চাই, কাঁদতে চাই, ভাসতে চাই স্মৃতির ভেলায়। পিকনিকে যেতে চাই।
loading...
loading...
এবার আমার পিকনিকে যাওয়া হয়নি। পৃথিবীর কোন এক নির্জন ছায়াতলে বসে তোমাদের খুঁজে পেতে চাই হাঁসতে চাই, কাঁদতে চাই, ভাসতে চাই স্মৃতির ভেলায়। পিকনিকে যেতে চাই।
___ প্রত্যাশা পূরণ হোক প্রিয় লিখক। অশেষ শুভকামনা।
loading...