
জাজাফী
প্লাস্টিকের ত্রিপলে ঢাকা তাবুতে ফিরে যেতে যেতে একটিবারও রাজুমা পিছনে ফিরে তাকায়নি। সে জানে পিছনে ফিরে তাকিয়ে কোন লাভ নেই। সেখানে তার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই।তাকে দেখে কেউ গুটি গুটি পায়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে না। আমরা ভেজা চোখে যদিও তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এই ভেজা চোখ একটু বাদেই শুকিয়ে যাবে। একটু বাদেই গোটা পৃথিবী ভুলে যাবে রাজুমার কথা। আগুনে পুড়তে থাকা ঘরের আগুন নেভাতে ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা প্রাণপন চেষ্টা করে একসময় আগুন নিভিয়ে ফেলে।নেভানো আগুন থেকেও বেশ কিছুটা সময় ধোয়া ওঠে এবং এক সময় সেই ধোয়াটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পোড়া গন্ধও একদিন দুদিন করে করে হারিয়ে যায়।কিন্তু রাজুমার বুকের মধ্যে যে আগুন লেগেছিল তা নেভানোর মত কোন দমকল বাহিনী আজও পৃথিবীতে জন্ম নেয়নি। যে আগুন রাজুমার বুকের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে তা কোন দিন নিভবে না। অবিরাম জ্বলতে জ্বলতে একদিন হয়তো রাজুমা নামের মেয়েটিও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তখনো সে পোড়াগন্ধটুকু বুকের মধ্যে টের পাবে।
তাবুর বাইরে একটি ছোট্ট টুলের উপর বসেছিলাম আমি। সামনে একটি ফাকা টুল পড়ে আছে। একটু আগে সেই টুলে বসে ছিল রাজুমা নামের সাতাশ বছর বয়সী এক নারী। দশমিনিট মত তার সাথে কথা হয়েছিল। সেই দশটা মিনিট আমার কাছে মনে হয়েছিল দশ জনমের সমান। কথা শেষে তাকে বলার মত কোন ভাষাই আমার ছিল না। সে উঠে চলে যাওয়ার পরও তাই আমি ধাতস্ত হতে পারিনি। টুল ছেড়ে ওঠার মত শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে গেছে। নয়তো আমার পা দুটি মাটির সাথে এমন ভাবে আটকে গেছে যে আমি আর উঠতে পারছিনা। কিংবা মনে হচ্ছিল আমার শরীরের ওজন এতো বেড়ে গেছে যেন হিমালয়ের সমান ভারি হয়ে গেছে। সেই ভারিশরীর বয়ে নেবার মত শক্তি তখন আর আমার ছিল না। আরাকানের এক নিভৃত পল্লীতে ছিল রাজুমার ছোট্ট ঘর। সেই ঘর আলো করে রেখেছিল তার দুবছর বয়সী একমাত্র ছেলেটি যে এখন আর নেই। চাদের মত আলো নিয়ে যে ছেলেটি ঘর আলোকিত করতো সে আজীবনের মত হারিয়ে গেছে যেমন করে হারিয়ে গেছে তার সাধের ঘরটি।ঘর চলে গেলে আরো একটি ঘর পাওয়া যায় কিন্তু যে আলোরধারা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল তাকে সে কি করে ফিরে পাবে। চোখের সামনে দাউদাউ করে আগুনে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে তার ছোট্ট কুটির সেই সাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার একমাত্র সন্তান। যে ছোট্ট ছেলেটি তার কোলে রোজ রাতে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকতো। তার বুকের দুধ চুকচুক করে খেতো আর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কত জানা স্বপ্ন দেখতো রাজুমা।
এক সকালে রাখাইন পল্লীতে হানা দিল বুনো হায়েনার দল। দেখতে মানুষ হলেও তারা আসলে মানুষ না। রক্তের নেশায় তারা তখন উন্মাদ হয়ে আছে। রাখাইন পল্লীতে ঢুকে হায়েনারা কোন গরু ছাগল মহিষের উপর হামলা করেনি কারণ তারা তখন মানব রক্তের হোলি খেলায় মত্ত। তারা তখন নারীদেহ নিয়ে মত্ত। সুনামীর মত এসে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল। কিন্তু সুনামীর সাথে তাদের ছিল আকাশ পাতাল ব্যবধান। সুনামী যখন আঘাত হানে তখন ঘরবাড়ি নষ্ট হয়, অনেকের জীবন চলে যায় কিন্তু সম্মানটুকু থাকে। কিন্তু রাখাইন পল্লীতে যে বুনো হায়েনার দল হানা দিলো তারা ছিল আরো নিকৃষ্ট। পুব আকাশে হয়তো তখনো ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি তখন তারা দুয়ারে দুয়ারে বুটের আঘাত করতে শুরু করলো। সেই বুটের আঘাতে কেপে উঠলো পুরো ঘর, পুরো রাখাইন পল্লী। অস্ত্রের মুখে বের করে আনলো ঘুমন্ত নারী পুরুষ শিশু কিশোরদের। ছেলে মেয়ে আলাদা করলো তার পর সবার সামনে ছেলেদের গুলি করে হত্যা করলো। ছোট্ট ছেলে মেয়েরা দেখলো তাদের চোখের সামনে তাদের বাবাকে তাতের বড় ভাইকে চাচা দাদাকে হায়েনারা গুলি করে মেরে ফেলছে। প্রিয় মানুষের মৃত্যু দেখেও তারা টু শব্দটি করতে পারছেনা যদিও তাদের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানেই সব শেষ নয়। পুরুষ সদস্যদের মেরে ফেলার পর নারীদেরকে ঘরে নিয়ে পাশবিক নিযার্তন করেছে। কখনো কখনো ছোট্ট ছেলে মেয়ের সামনেই তাদের মাকে বড় বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। পৃথিবীর আকাশ বাতাস তখন কেপে উঠলেও বুনো হায়েনাদের একটি পশমও নড়েনি। তারা উন্মত্ততায় খুনের নেশায় মেতে উঠেছে।
পঙ্গপালের মত রাখাইন পল্লী থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে অগণিত নারী পুরুষ শিশু কিশোর। কিন্তু সেই পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে রাজুমার ঠাই হয়নি। সে সেই সুযোগটুকু যখন পেয়েছে তখন তার নিজের বলে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই তার ঘরের দরজাতেও বুটের আঘাত পড়েছে। ঘুম ঘুম চোখে তার স্বামী যখন দরজা খুলছে তখন সেই তার দেড় বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামীর পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে। ভোরের আলো দেখার আগেই সে দেখেছে তার স্বামীর মৃত্যু। তার পর তাকে টেনেহিচড়ে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল। স্বামীর মৃতদেহ তখন উঠোনের এক কোণায় পড়ে আছে। সেদিকে তাকাবার মত সময়ও রাজুমার হয়নি। চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে কুড়ে ঘরখানা। একটু আগেও স্বামী সন্তান নিয়ে যে ঘরে আরামের ঘুম ঘুমিয়েছিল রাজুমা এখন সেটা জ্বলছে চোখের সামনে। একটু আগে যে মানুষটি তার স্বামী ছিল সে এখন মরে পড়ে আছে। তখন সে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে তার একমাত্র ছেলেটিকে। দুধের শিশুটি জানতেই পারেনি তার জন্মদাতা পিতা চিরকালের মত ঘুমিয়ে গেছে।
একদিকে স্বামীর মৃত দেহ অন্যদিকে চোখের সামনে জ্বলতে থাকা বসতবাড়ি। রাজুমা নামের মেয়েটি যখন বুকের সাথে একমাত্র সন্তানকে জড়িয়ে দিশেহারা হয়ে আছে তখন হায়েনাদের এক সদস্য ওর বুক থেকে একমাত্র সন্তানকে ছিনিয়ে নিল। তার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ছুড়ে ফেলে দিল আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে কলিজার টুকরো ছেলেটি জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হতে থাকলো কিন্তু রাজুমার কিছু করার থাকলো না। সে তখন মাটিতে শোয়া এবং তার বুকের উপর হায়েনারা পালা করে ওঠানামা করছে। এভাবে কতক্ষণ চলেছে সে জানেনা। পোড়া গন্ধে একসময় সে জেগে উঠলো। পাশবিক নিযার্তনের সে জ্ঞান হারিয়েছিল বলেই স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র সন্তানকে আগুনে পুড়তে থাকা দৃশ্য দেখার কষ্ট থেকে রেহায় পেয়েছে। চোখে মেলে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষন আগেও যেখানে থাকার ঘর ছিল এখন সব শুন্য। সেখানে শুধু কিছু কয়লা ছাই পড়ে আছে। সে তখন দিশেহারা।হঠাৎ তার সন্তানের কথা মনে পড়লো। থেতলে যাওয়া শরীরটাকে কোনমত টেনে ছাইগাদার কাছে নিয়ে সে তার সন্তানকে খুঁজলো। কিন্তু তাকে সে খুঁজে পেলো না। তার বুকের মানিক তখন ছাইভস্ম হয়ে মৃদু বাতাসে উড়ছে দিগন্তে। আশেপাশে তাকিয়ে স্বামীকে খুঁজলো কিন্তু তাকেও পাওয়া গেল না। হয়তো সন্তানের সাথে সাথে সেও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। হায়েনারা হয়তো ওর স্বামীর মৃত দেহ ছুড়ে মেরেছে জ্বলন্ত আগুনে।
স্বামী নেই, একমাত্র সন্তানও নেই সেই সাথে নারীত্বের যে সম্মান, সম্ভ্রম সেটাও কেড়ে নিয়েছে মায়ানমারের নরপিশাচ সেনাসদস্যরা। বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার সবই সে হারিয়েছে। এ জীবন রেখে আর লাভ কি? একটু দূরে তখনো ঘরের কিছু অংশ দাউদাউ করে জ্বলছিল। শরীরটাকে টেনে সে সেই আগুনে ঝাপিয়ে পড়লো কিন্তু পারলো না। কে যেন তাকে থামিয়ে দিল। তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো রাহেলার মা। রাখাইন পল্লীতে প্রতিবেশি ছিল।কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রাজুমা। তাকে শান্তনা দেবার মত ভাষা ছিলনা রাহেলার মায়ের। তারও আপন বলতে আর কেউ জীবিত নেই। সবাইকে মেরে ফেলেছে হায়েনার দল। বয়স হয়ে যাওয়ায় তার উপর পাশবিক নিযার্তন করতে পারেনি ওরা। বুকের সাথে রাজুমার মাথা ঠেকিয়ে তাকে শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজতে থাকেন তিনি। কিন্তু বলার মত কোন কথাই তার মূখে আসে না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাজুমার কান্নাও থেমে যায়। তাকে ধরে পথে বেরিয়ে পড়ে রাহেলার মা। কতশত মাইল পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ সীমানায়।
ছোট্ট তাবুতে একটু আগে যে মেয়েটি ফিরে গেল সেই মেয়েটিই হলো রাজুমা। যার কোল থেকে একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়ে চোখের সামনে ছুড়ে মারা হয়েছিল আগুনে। তার পর স্বামীর মৃতদেহের পাশে মাটিতে চেপে ধরে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তার চোখে তখন অবিরাম শ্রাবণধারা। সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে কলিজার টুকরা সন্তান, শরীরের উপর চলছে পাশবিক নির্যাতন, পাশে পড়ে আছে মৃত স্বামী।
আমার সাথে কথা বলে তাবুতে ফিরে যাওয়ার পরও আমি ওই তাবুর দিকে অপলোক তাকিয়ে আছি। গুয়ান্তানামো বে’র অত্যাচারের কথা শুনেছি, আবু গারিবের নিমর্মতার কথাও শুনেছি কিন্তু রাজুমার গল্প সম্পুর্ন আলাদা। আর কোন দিন হয়তো রাজুমার সাথে দেখা হবেনা কারণ ওর সাথে দেখা করার মত সাহস আমার নেই। দেখা হলে কি করে ওকে প্রশ্ন করবো তুমি কেমন আছ? এই প্রশ্ন করতে পারবো না বলেই ভয়ে আর কোন দিন ওর সাথে দেখা হবে না। এখনো ওর বুকে পোড়া গন্ধ, জ্বলতে থাকা আগুনের ধোয়া আরাকানের গোটা আকাশকে ছেয়ে দিয়েছে। হয়তো আরাকানের জ্বলতে থাকা গ্রাম একদিন শান্ত হয়ে যাবে। সব আগুন, ধোয়ার কুন্ডলী থেমে যাবে কিন্তু রাজুমার বুকের আগুন কোন দিন নিভবে না। ওর বুক থেকে যে ধোয়ার কুণ্ডলী বের হতে শুরু করেছে তা কখনো শেষ হবার নয়।
—জাজাফী
২৩ অক্টোবর ২০১৭
loading...
loading...
সহস্র রাজুমা'র জীবনের বাস্তবতা। দুঃসহ এই পৈশাচিকতায় বিনা প্রতিবাদে কাটে এদের সকাল সন্ধ্যা। একবিংশ শতাব্দীর এক অবহেলিত জনপদের নীরব স্বাক্ষী এরা।
loading...
এ কাহিনী অন্ধকার যুগকেও হার মানায়৷ নিশ্চয় মজলুমের পাওনা আল্লাহ একদিন মিটিয়ে দিবেন৷ সেদিন জালেমরা তাদের ভুুল বুঝবে কিন্তুু আফসোস ছাড়া আর কোন লাভ হবে না৷ আল্লাহ রাজুমাদের চুড়ান্ত বিজয় দান করুন৷ এ দেশ ও মাটি তাদের সাথে আছে৷
loading...