বিদায় বেলা-শেষ পর্ব

Joypurhat Rail Station
বদলির আদেশ পাবার পর জয়ের যাবার প্রস’তিও সম্পন্ন হলো। জয় এই দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেক জায়গায় চাকুরি করেছে, অনেক ঘাটে তরী ভিড়িয়েছে কিন’ কোথাও নোঙ্গর ফেলেনি। কোথাও তার হৃদয় গেঁথে যায়নি। অথচ জয়পুরহাটে শুধু তার হৃদয় গেঁথেই গেলো না, হৃদয় খণ্ডিত হলো, রক্তাক্ত হলো। তার এই রক্তাক্ত হৃদয় থেকে এখনো সবসময় রক্ত ঝরছে, দু’চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু ঝরছে।
জয়পুরহাটে জয়ের চার বছরের চাকুরি জীবন, তিন বছরের প্রেম, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য জীবনের অবসান হলো। সে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কিনে স্টেশনের প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা অনেকদিন তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কষ্ট পাবে ভেবে সে তার আগেই ইরাকে ওর বাসে তুলে দিয়েছে। আজ যদি ইরার সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতো তবে হয়তো ইরা এই প্লাটফরমে তাকে বিদায় জানাতো।
জয় সেই তালগাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তার সেই কল্পনার জানালার দিকে। হয়তো ইরাও তাকিয়ে আছে। ইরার সঙ্গে তখন সেপারেশন হয়েছে কিন’ ডিভোর্স হয়নি। তখন একদিন ইরা বলেছিলো, ট্রেনের হর্ন শুনলেই তার বুকটা কেঁপে ওঠে, মনে হয় এই বুঝি ট্রেন এলো আর তুমি বুঝি ট্রেনে চড়ে দিনাজপুর চলে গেলে। আবার কখনো মনে হয় বিকেল হলেই প্লাটফরমের দিকে তাকিয়ে থাকি, যদি তোমাকে এক পলক দেখতে পাই। যে ইরা প্রতিদিন ট্রেনের শব্দ শুনলেই জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো সে যখন জানবে তার হৃদয় রক্তাক্ত করে, হৃদয় টুকরো টুকরো করে জীবনের শেষ ট্রেনটি চলে গেছে তখন এতো বড় কষ্ট ইরা সইবে কী করে?
ইরা, ইরা বুঝি এখনো জানালার কাছে বসে প্লাটফরমের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দু’চোখ সজল হলো। আজ ট্রেন এক ঘণ্টা দেরিতে আসবে। প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্লাটফরমে আবছা আবছা অন্ধকারে তার মনে হলো একটা অস্পষ্ট ছায়া তার পাশে এসে দাঁড়ালো। নিজের অজান্তে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ইরা, আমার ইরা।
সেই অস্পষ্ট ছায়াটি জয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তার কানে একটা করুণ আর্তনাদ ভেসে এলো, চলে যাবে!
কথাটা জয়ের বুকে প্রচণ্ড আঘাত করলো।
ইরা অভিমানের সুরে বললো, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না।
ভালোবাসি না মানে?
ভালোবাসলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে না।
আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাইনি ইরা তুমি তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো। এখন আর থাকা না থাকার মধ্যে তফাৎ কী।
তাই বলে তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে! ডিভোর্স হয়েছে কিন’ হৃদয়ের সব স্মৃতি তো মুছে যায়নি, হৃদয়ের সম্পর্ক তো আর ছিন্ন হয়নি। একটা কথা মনে রেখো হৃদয় কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
দূর থেকে ট্রেনের আলো জয়ের চোখে পড়তেই সে চমকে উঠলো। না তার আশে পাশে তো কেউ নেই।
ট্রেন আসতে দেখে স্টেশনে চাঞ্চল্য দেখা দিলো। যাত্রীরা ছুটোছুটি শুরু করলো। জয় ট্রেনে উঠলো। এই জয়পুরহাট রেল স্টেশন, বারোঘাটি পুকুর, বৈরাগীর মোড়, এই সব অতি চেনা জায়গায় তার আর কোনোদিন আসা হবে না। ভাবতেই বুকে একটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
জয়ের সিট পড়েছে পূর্বদিকের ঠিক জানালায়। এই জানালা থেকে ইরার জানালা চোখে পড়ছে। একটা অস্পষ্ট নারী মূর্তি যেনো জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, এটাই কী আমার ইরা? নিশ্চয়ই ইরা জানালায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা বলেছিলো ট্রেনের শব্দ শুনলেই সে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।
জয়ের গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, ইরা, আমার হৃদয় জুড়ে আছে ইরা, তোমাকে রেখে আমি চলে যাচ্ছি, হয়তো চিরদিনের জন্য, তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। যাকে কয়েকদিন না দেখলে আমি অসি’র হয়ে যেতাম, দু’য়েক ঘণ্টা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ না হলে আমার কানের কাছে মোবাইল ফোনের শব্দ বেজে উঠতো, তার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না, তার কণ্ঠস্বর আর কোনোদিন আমার কানে ভেসে আসবে না।
ট্রেন ছাড়ার করুণ বাঁশি বেজে উঠলো। ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে চললো জয়ের হৃদয়হীন দেহ নিয়ে গন্তব্য দিনাজপুরের দিকে, পিছনে পড়ে রইলো তার প্রেম, তার হৃদয়, তার বুক ভেঙ্গে যেনো হু হু করে কান্না বেরিয়ে এলো। নিজের অজান্তে হৃদয় চিরে বেরিয়ে এলো, ইরা, আমার ইরা, বিদায়,। চিরবিদায়।
সমাপ্ত

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ৩য়, অর্থাৎ ০৩/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)
আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন: www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন: https://www.facebook.com/profile.php?id=100000449437795
যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমার বই পড়ুন: https://sheiboi.com/Pages/BookDetails.html?/Dag/285

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. ফকির আবদুল মালেক : ১১-০৩-২০১৭ | ৭:১০ |

    আপনার লেখা এই গল্পটি পড়লাম।

    বাকিগুলো পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

    GD Star Rating
    loading...
    • জিল্লুর রহমান : ১৯-০৩-২০১৭ | ২১:৫৭ |

      ধন্যবাদ বন্ধু। আশা করি আমার সব লেখা পড়বেন।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ১১-০৩-২০১৭ | ৭:৪১ |

    শেষ লাইনটা পড়ে বুকের মধ্যে হুহু করে উঠলো।
    বিদায় এর মধ্য দিয়েই বিদায় বেলা’র শেষ পর্বটি শেষ করলাম।

    এখন অপেক্ষা। ভালো থাকবেন প্রিয় জিল্লুর রহমান ভাই। শুভ সকাল।

    GD Star Rating
    loading...
    • জিল্লুর রহমান : ১৯-০৩-২০১৭ | ২২:১৫ |

      আমার লেখা পড়ে আপনার বুকের মধ্যে হু হু করছে জেনে মনে হচ্ছে এটা লেখা হয়েছে। দোয়া করবেন মুরুব্বী।

      GD Star Rating
      loading...
  3. একজন নিশাদ : ১১-০৩-২০১৭ | ১৩:১৭ |

    অনেকটা সময় নিয়ে পড়লাম, ভাল লাগল প্রিয় জিল্লুর ভাই।

    GD Star Rating
    loading...