বহুদিন পর গ্রামে এসেছে মনির। ঢাকা থেকে আট ঘণ্টার যাত্রাপথে কিছুটা ক্লান্ত। বাস ভ্রমণে পাশের সিটের যাত্রী প্রথম দিকে বেশ প্রফুল্লচিত্তে গল্প শুরু করে। মোটাসোটা চল্লিশোর্ধ্ব মানুষ। গায়ে পোশাক জড়িয়ে নিজেকে ছোটখাটো একটা টিলা বানিয়ে বসে।
– খুব শীত পড়েছে।
– হুঁ, খুব শীত।
– কুয়াশা কাটলে শীত কমবে।
মনির চুপ। লোকটা আবার বলে, গাড়ি-ঘোড়া বেড়ে গেছে। শুধু জ্যাম আর দুর্ঘটনা।
– ঘোড়াও বেড়েছে নাকি!
লোকটা খিলবিল করে হেসে ওঠে। এ যুগের ঘোড়া হলো বাইক, বুঝলে। দেখ না বাইকে সাওয়ার হয়ে কীভাবে ঘোড়ার মতো ছুটে চলা…
যখন কুয়াশা কেটে শীতের সকালের মিষ্টি রোদ বাসের জানালা ভেদ করে গায়ে পড়ে তখন সহযাত্রী ঘুমে বিভোর। একেকবার মনিরের গায়ের ওপর ঢলে পড়া। একেকটা চাপ। মনির তার দৈহিক চাপে কোণঠাসা। এই বুঝি বাসের লোহালক্কড় ভেঙে বাইরে ছিটকে পড়ে। শেষমেশ একেবারে অসহ্য হয়ে বলে, আরে ভাই কী শুরু করেছেন?
লোকটা বিড়বিড় করে তাকায়। মৃদু শব্দে বলে, ঘুম।
– রাতে ঘুমাননি!
– না। সে সময় একজন হকার পেপার নিয়ে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসে- গরম খবর। এই পেপার। পেপার নিন। গরম খবর। কাছাকাছি আসতেই লোকটা ঘুম ভাঙা লাল চোখে খেঁকিয়ে ওঠে, এই ব্যাটা, ভাগ। শীতে বাঁচিনা উনি এসেছে গরম খবর নিয়ে। শীতকালে সব শীতল খবর। তোর পেপারও দেখ ঠাণ্ডা। হকার পেপারগুলো এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে লোকটার কানের কাছে এসে বলে, ভাগ মানে!
– কানের কাছে ঘ্যা ঘ্যা করিস না, যা।
– গাড়ি কি আপনি কিন্যা লইছেন?
– আবার মুখের ওপর কথা বলিস?
– ক্যান, আপনে কি মন্ত্রী! শপথ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন?
– আমি মন্ত্রী হলে তোর কি বেঁচে থাকা হতো?
– হেইডার জন্যই তো আপনে মন্ত্রী না। ছাগল।
– কী বললি!
– হাত চালাইনি। নাকের ওপর বইলা দিমু কইলাম।
অবস্থা ক্রমান্বয়ে সাংঘর্ষিক হতে চলে। মনির থামায়। কিছু মনে করো না, যাও ভাই। ছেলেটা কথা শোনে। ও যাওয়ার আগে একটা পেপার নেয়। প্রথম পাতার খবর- শিশু ধর্ষণের চেষ্টা, না পেরে হত্যা। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। পৃথিবীর পশুগুলো কি এতটা নিকৃষ্ট? পাষাণ! ভাবনাগুলো সঙ্গে নিয়েই গন্তব্যে পৌঁছানো। বাড়িতে উপস্থিত হতেই একঝাঁক স্বজন ঘিরে ধরে। বেশ রাত পর্যন্ত চলে খোশগল্প। বাড়িতে এলে জুলয়াসের সঙ্গেই থাকা হয়। চাচাতো ভাই। সমবয়সী হওয়ায় বন্ধুর মতো। সবাই চলে যেতেই জুলয়াস ফিসফিসিয়ে বলে, চল রস খেয়ে আসি। একেবারে টাটকা।
– চুরি?
– কাল না হয় পয়সা দিয়ে দেব।
টাটকা রস খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। আচ্ছা চঞ্চল আর ঝিলটনকে খবর দে। এত রাতে দু’জন যাওয়া রিস্কি। ওদের মোবাইল করতেই রাজি হয়ে যায়। বহুদিন পর চার বন্ধু টাটকা রস খাবে। মজাই আলাদা। কনকনে শীত উপেক্ষা করে ওরা রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে যায়। শহরে শীত খুব একটা অনুভব করা না গেলেও গ্রামে এখনও শীতের প্রকোপ, দাপট বোঝা যায়। বেশ খানিকটা ঘুরে খেজুর বাগানে পৌঁছে। বিলের ধারে সারি সারি খেজুর গাছ। হীম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস। সিদ্ধান্ত হয়, চঞ্চল গাছে উঠবে। নিচে হেল্প করার জন্য থাকবে মনির। রস নামানো হলে সেটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জুলয়াসের কাছে পৌঁছে দেবে মনির। জুলয়াস পৌঁছে দেবে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ঝিলটনের কাছে। ব্যস। এভাবে জমা হবে টাটকা রস। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়। সবার আগে ঝিলটন অন্ধকার ভেদ করে এক আগন্তুককে এগিয়ে আসতে দেখে। পাশেই গাছের আড়ালে নিজেকে লুকায়। মতি কাকা! খবরটা ওদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ হয় না। জুলয়াস মতি কাকার দিকে এগিয়ে আসে। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঝিলটন।
মতি মিয়া অন্ধকারে বসে ছিল। বিলের মতো ফাঁকা অল্প পানির জলধারার পাড়ে বসে থাকা তার প্রতিদিনের কাজ। রাতের প্রহরী। অন্ধকারে মানুষের মতো কিছু একটা দেখে এগিয়ে যান। সেও তাকে দেখে এগিয়ে আসে। মতির গায়ের ভেতর কাঁটা দিয়ে ওঠে। কাছাকাছি এসে মতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ওকে? মাথায় উঠে গেছে।
– কী! ওরে বাবা। এত রাতে কী মাথায় উঠে গেল রে বাবা। কে আছিস বাঁচা…
না, ঝিলটন নয়। ঠিক সে সময় বিলের ভেতর ঝপাৎ করে শব্দ হয়। জুলয়াস এক মুহূর্ত দেরি করে না। আড়াআড়ি বিল পেরুলেই বাড়ি। সোজা সেও বিলের মাজা পানিতে নিজেকে আছড়ে ফেলে। চিৎকার, বিলের ভেতর ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে কেঁপে ওঠে মনির। একই সঙ্গে সুনসান নীরব রাতে বিকট শব্দে রসের ঠিলে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে। গুঁড়িয়ে যায়। তারপরই পড়ে আস্ত চঞ্চল। মনিরও একই গন্তব্য ঠিক করে। সোজা পথে যত দ্রুত বাড়ি পৌঁছানো যায়। মাজা পানি মাড়িয়ে সমানে দ্রুত এগিয়ে যায় মনির। কিছুটা সামনে ঝিলটন ও জুলয়াস। একটু পরেই পেছনে শোনা যায় পানিতে আছড়ে পড়া ঝপাৎ শব্দ। মিনিট দশেকের ভেতর বিল পেরিয়ে একে একে চরজন জড়ো হয়। মনির কাঁপতে কাঁপতে বলে, রস খাবি না, টাটকা রস? জুলয়াস আড়ষ্ট গলায় বলে, টাটকা ঠাণ্ডায় মরে গেলাম। সব নিথর হয়ে যাচ্ছে। আর কোনো দিন রস খাব না। ওপারে টর্চলাইটের আলোর সঙ্গে ভেসে আসে অনেক মানুষের চিৎকার- ধর ধর। ডাকাত। মুহূর্তে সব কষ্ট উবে যায়। শেষে টাটকা পিটুনিতে প্রাণটাই না চলে যায়।
প্রকাশিত – দৈনিক সমকাল, ১৪.০১.১৯
loading...
loading...
টাটকা রস টাটকা ঠাণ্ডা শীর্ষক অণুগল্পটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হবার অভিনন্দন প্রথমে। তারপরে বলি … এমন অভিজ্ঞতা আমার বা আমাদের অনেকের জীবনেও ঘটেছে। শেষ এই বয়সে এসে ভাবতে বসলে হেসে উঠে মন।
পারিবারিক জীবনে আগের বন্ধবান্ধবদের সংখ্যাও কমে গেছে। আজকাল গল্প করার মতো মানুষও খুঁজে পাই না। জানিনা কেন, অনেকেই এড়িয়ে চলেন। নস্টালজিক এই মন এভাবেই যেন মরে যায়। কত স্মৃতি কত অনুভব। জীবন ছোট হলেও এর পরিবৃত ইতিহাস নেহায়েত ছোট নয়।
শব্দনীড়ে নতুন করে স্বাগতম মি. অয়েজুল হক। শুভ সকাল।
loading...
আপনার লেখা গল্প পড়তে পড়তে চলে গেলাম, ছোটবেলার স্মৃতিতে। আনন্দের সাথে কত খেজুরে রস আর জোলা খেজুরে গুড় খেয়েছি, তা মনে পড়ে গেল। মন চাইছে শীত থাকতে থাকতে গ্রামে গিয়ে খেজেরের সর আর গুড় খেয়ে আসি। কিন্তু তা সম্ভব নয়। শহরেও সর পাওয়া দুষ্কর !
আপনাকে শীতের শুভেচ্ছা সহ অজস্র ধন্যবাদ।
loading...
নস্টালজিক হলাম আপনার লেখায়। শব্দনীড়ে স্বাগতম দাদা ভাই।
loading...
ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো অয়েজুল ভাই।
loading...