স্মৃতির গলিতে একঘণ্টা...

3

সময় নদীর মতই বয়ে যায়…কেবলই বয়ে যায়। নদী এদিক ওদিক ধাক্কা খেলেও সময়কে ধাক্কা দেয়ার কেউ নেই। এ যেন অনন্ত কালের চলা। এ চলার শুরু ও শেষ কোথায় কারও জানা নেই।

সময় গুনে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে ৪৫ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। সেন্ট পিটার্সবার্গে সে বছর শীত নেমেছিল ক্ষমাহীন রূঢ়তায়। হিমাংকের নীচে ৪৫ ডিগ্রী। সাথে উত্তর মেরুর শীতল বাতাস। রাস্তাঘাট অচল। স্কুল কলেজে মনুষ্য পদচারণা নেই অনেকদিন। আমি ও আমরা ডর্মের জানালায় বসে কেবল প্রহর গুনি কবে বরফ গলা শুরু হবে।

আবুল ফজল মোহম্মদ আকা এএফএম ভাই আমাদেরই একজন। বয়সে দুই বছরের বড় হলেও এক বছর পরে এ দেশে আসায় আমার জুনিয়র হয়ে গেছেন। অবশ্য এ নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের সমীকরণে কোন দাগ লাগেনি।
বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকার কোন এক গ্রামে।
যে কোন বিচারে ভদ্র ছেলে। আমরা সবাই যখন যৌবনের উদ্দাম ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি এএফএম ভাই তখনও পরে আছেন সিলেটের কোন এক কলেজ আঙ্গিনায়। কট্টর না হলেও ধার্মিক। সোভিয়েত দেশের নির্বাসিত ধর্মের লাল চক্ষু উপেক্ষা করে প্রায়ই জায়নামাজে বসে পরেন সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে।
বাংলা বলেন সিলেটী সুরে। রান্নাবান্নায় পাকা হাত। খারাপ অভ্যাসের ভেতর এক সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা। মদ মেয়ে মানুষের দিকে সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকান।
আমরা সবাই যখন একাধিক মেয়ের শিডিউল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি এএফএম ভাই তখন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। সে পৃথিবীতে সাদা মেয়ে মানুষ নেই। লম্বায় কিছুটা খাটো হওয়ায় কোন মেয়ের সাথে আলাপ করতে দ্বিধায় করতেন যদি রিজেক্ট করে দেয়!

শীতের প্রচণ্ডতা উপেক্ষা করে সে রাতে আমরা বের হয়েছিলাম। নেভা নদীর কোল ঘেঁষে একটা রেস্তোরা আছে। সপ্তাহান্তে ওখানে যৌবনের হাট বসে। সে হাটে অনেক সদাই হাত বদল হয়।
এএফএম ভাইকে অনেকটা জোর করে ওখানটায় নিয়ে যাই। সাথে গেলেও ভদকার বদলে গ্লাসে অরেঞ্জ জুস নিয়ে উপভোগ করেন নৈশ জীবন। ভাল করে দেখলে মনে হবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। এ নিঃসঙ্গতার মূলে যে নারী সহচর্য তা বুঝতে অসুবিধা হয়না।

পাতাল রেলে চড়ে ডর্মে ফিরছি। অন্য সময় হলে যাত্রীর পদভারে মুখরিত হয়ে উঠত ট্রেনের বগি। কিন্তু এ সময়ের শীত অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে শহুরে জীবন হতে, যার অন্যতম শনিবারের ব্যস্ততা।

বগির প্রায় সবকটা সীট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা কেন এএফএম ভাইয়ের পাশ বসল এ নিয়ে আমরা সবাই কৌতূহলী হয়ে পরলাম। ঘটনা প্রবাহ কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
সামনের শনিবার বিকেল ৫টায় পাতাল রেলের নির্দিষ্ট এক ষ্টেশনে অপেক্ষায় থাকবেন এএফএম ভাই এভাবেই পরিচয় পর্বের সফল সমাপ্তি ঘটে। ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা নাতাশার সাথে সম্পর্কের শুরু এভাবেই।

দৃশ্যপটে উদয় হল নতুন এক এএফএম ভাইয়ের। নিঃসঙ্গতার বলয় হতে বেরিয়ে তিনি এখন অদম্য এক তরুণ। সুখের সাগরে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছেন অচেনা সব নগর বন্দরে।

বহুল কাঙ্ক্ষিত শনিবার দৃশ্যপটে হাজির। এএফএম ভাই সেদিন আর ক্লাসে যাননি। ডর্মে বসেই উপভোগ করছিলেন আগত সুখের শিহরণ।
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরলেন।
সুখনিদ্রার পর চেহারায় নাকি অলৌকিক পরিবর্তন আসে। সবকিছু প্রেমময় হয়ে উঠে। চেহারার পাশাপাশি শরীর মনও কাব্যিক হয়ে উঠে। এএফএম ভাই এ বিষয়ে এত গভীর জ্ঞান রাখেন এ ছিল আমাদের জন্যে বিস্ময়কর এক আবিষ্কার।

দুষ্টুমিটা প্রথম আমার মগজে জন্ম নেয়। পল্লবিত হয়ে একে একে সবাইকে গ্রাস করে নেয়।
ঘুমচ্ছেন এএফএম ভাই। সময়মত ঘুম ভাঙ্গার জন্যে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছেন। একঘণ্টা আগে বিছানা ছেড়ে প্রস্তুতি নেবেন মাহেন্দ্রক্ষণের। অপেক্ষার সমাপ্তি হতে যাচ্ছে ভেবে তিনি ছিলেন উচ্ছ্বসিত।

এলার্ম ঘড়িটা একঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে আসি এএফএম ভাইয়ের রুম হতে। এ নিয়ে আমাদের বাকি সবার হাস্য রসের শেষ নেই।
সময় ঘনিয়ে আসার সাথে কোথায় যেন অপরাধ-বোধ জন্ম নিতে শুরু করে। একজন মানুষের এতদিনের অপেক্ষাকে এভাবে হাল্কা করে দেয়ার ভেতর তৃপ্তি নেই ভাবনাটা মাথায় ঢুকতে আবারও ঢুকে পরি রুমে।
তবে শয়তানি বুদ্ধি একেবারে বিদায় নিয়েছে সেটাও না। এ যাত্রায় এলার্ম একঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে কেটে পরি।

এএফএম ভাই সব প্রস্তুতি সমাধা করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে রওয়ানা দিলেন গন্তব্যে। আমরাও এডভেঞ্চার কোন পথে গড়ায় তা জানার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি।

আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে এলেন এএফএম ভাই। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। জীবনে ও পথে আর পা বাড়াবেন না এমন একটা প্রতিজ্ঞা করে মুখ লুকালেন।
অপরাধ-বোধটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। সহজ সরল এএফএম ভাইয়ের এহেন চেহারা দেখে নিজকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অকপটে সব স্বীকার করে ক্ষমা চাইলাম। বিছানা হতে টেনে নামিয়ে গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার তাগাদা দিলাম। ৫টা বাজতে তখনও কিছু সময় অবশিষ্ট ছিল।

রাত প্রায় ২টার দিকে ফিরে এলেন। শীতের তীব্রতার কাছে হার না মেনে কি করে এত সময় কাটিয়েছিলেন তা আজও আমার জন্যে রহস্য হয়ে আছে।

এএফএম ভাই ও নাতাশার সাথে দেখা হয়েছিল ৩২ বছর পর তাসমান পাড়ের এক দেশে। ছেলেমেয়ে নাতিপুতি নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছেন।
বাকি সব স্মৃতি রোমন্থনের পর ভয়ংকর শীতের সে সন্ধ্যার স্মৃতি টেনে আনলাম…
‘আচ্ছা আবু ফজল মোহম্মদ ভাই, সেদিন সন্ধ্যায় ঘড়ির ঘণ্টা এক ঘণ্টা পিছিয়ে থাকলে জীবন আপনার কোন বন্দরে ঠাঁই নিত ভেবে দেখেছেন কি?
সে প্রশ্নের উত্তর ছিল একান্ত ব্যক্তিগত যা পাবলিক করা যায়না। তবে জীবন যে একটা জটিল সমীকরণ মেলানোর প্রেক্ষাপট তা অকপটে স্বীকার করলেন। আরও স্বীকার করলেন নাতাশার আগমনে জীবন সুখের সায়রে ভেসে গেছে এমনটা নয়। হয়ত ঘড়ির কাটা উলটো দিকে না ঘুরালেই ভাল হত।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
স্মৃতির গলিতে একঘণ্টা..., 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০৩-২০২৩ | ১৯:১৩ |

    সময় নদীর মতই বয়ে যায়… কেবলই বয়ে যায়। নদী এদিক ওদিক ধাক্কা খেলেও সময়কে ধাক্কা দেয়ার কেউ নেই। এ যেন অনন্ত কালের চলা। এ চলার শুরু ও শেষ কোথায় কারও জানা নেই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...