একজন দেবতা ও কিছু স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প

2971

29735

সময়টা ভাল যাচ্ছিল না আমাদের জন্যে। আব্বার মৃত্যু সাথে বড় ভাইয়ের সীমাহীন উদাসীনতা সব মিলিয়ে পঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসা শিল্প-কারখানা ধ্বংসের মুখোমুখি চলে গিয়েছিল।

আমি তখন ঢাকায় একটা ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক হিসাবে কাজ করি। ভাল চাকরি, আকর্ষণীয় গার্ল ফ্রেন্ড সহ জীবন ছিল স্বপ্নময়। বিদেশ চ্যাপ্টার মনে হয়েছিল অতীতের কিছু।

মা তখনও বেঁচে। দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থায় তখনও মহামারী লাগেনি। ঢাকা হতে ঘণ্টা খানেকের পথ। প্রায়ই বাড়ি যাই। কোন এক উইক-এন্ডে মা দরজা আটকে সবাইকে নিষেধ করলেন কেউ যেন ঘরে না ঢোকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম বিয়ে করার তাগাদা নিয়ে আবারও সবক দেবেন এবং আমি শিং মাছের মত পিছলে যাব।

না, সে যাত্রায় বিয়ের কোন তাগাদা ছিলনা। মা যা বললেন তা শুনে আমি হতবাক। অব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্প-কারখানা হুমকির মুখে। যে বড় ভাইকে দেবতার মত বিশ্বাস করে এসেছি তিনি এখন বেপরোয়া। আয়-রোজগারের সবটার দখল নিয়েছেন ইতিমধ্যে। উনার স্ত্রী একধাপ এগিয়ে যমুনার ওপার হতে বাপের বাড়ির সবকটা অকর্মণ্যকে এখানে আনিয়েছেন। এবং ধীরে ধীরে গ্রাস করা শুরু করেছেন।

মা জানালেন, ভৈরবের দিকে আমাদের জুট মিলে যে মালিকানা ছিল সেটাও বেহাত হওয়ার অবস্থা। বিবেচনার দায়িত্বটা আমার উপরই ছেড়ে দিলেন। এবং আশ্বাস দিলেন আমি যে সিদ্ধান্ত নেই তার সাথে গোটা পরিবার থাকবে। শুরু হল জীবনের অপ্রত্যাশিত ও অপরিকল্পিত এক অধ্যায়।

চাকরি ছেড়ে চলে আসি পৈত্রিক ভূমিতে। পরিবারের সবাইকে ডেকে জানান দেই নিজের সিদ্ধান্ত। এখন হতে আমিও অংশীদার হবো পারিবারিক আয়-রোজগারে। জীবনের ভাল সময়টা বোধহয় এখানেই কাটাই। মা’র পাশাপাশি পরিবারের সবাই আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। ক্ষয়িষ্ণু একটা শিল্প-কারখানার শুরু হয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। সাথে যোগ দেন আমাদের বড়ভাইও। ভুলটা বোধহয় এখানেই হয়েছিল।

৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাকি সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি। ১৫০ জনেরও অধিক শ্রমিক কর্মচারী নিয়ে শুরু হয় আমাদের নতুন যাত্রা। পরিবারকে নিয়ে যাই নতুন এক সামাজিক ও আর্থিক উচ্চতায়।
জেলা শহরের কোলাহলে কাটানো এ সময়টা আমার জন্যে ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শ্রমিক-কর্মচারীদের দৈনন্দিন জীবন হয়ে যায় আমার জীবন। ওদের দুঃখ, কষ্ট ও আনন্দের অংশীদার হয়ে মিশে যাই জৌলুষ-হীন নতুন এক জীবনে। পাশাপাশি পরিবারের জন্যে উন্মোচিত হয় উন্নতির নতুন দিগন্ত। কদিন আগে হিল্লি দিল্লী, লন্ডন, মস্কো করা আমি বনে যাই জেলা শহরের যন্ত্রিক জীবনে।

বেশিদিন লাগেনি পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে। ঢাকা ত্যাগের কদিন আগে বন্ধুর তাগাদা ও সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ায় স্কীল মাইগ্রেশনের জন্যে এপ্লাই করেছিলাম। বাড়ি গিয়ে তা ভুলেই গিয়েছিলাম।

হঠাৎ করেই ফোনটা পেলাম। থাইল্যান্ড হতে আমার নামে একটা প্যাকেট এসেছে। আমার সামান্যতম ধারণা ছিলনা কি ছিল ঐ প্যাকেটে। প্রাক্তন অফিসের হিসাবরক্ষক নিজেই হাজির হলেন। এবং সাথে ছিল মাইগ্রেশন কোয়ালিফিকেশনের সব কাগজপত্র।

কাউকে কিছু না বলে আমি প্রায়ই ঢাকা যাই। ইংরেজি পরীক্ষা সহ বাকি কাজ শেষ করি। এবং কোন এক সুন্দর সকালে বাড়ির মিশন শেষ করে উড়ে যাই আমার নতুন ঠিকানা সিডনি অস্ট্রেলিয়ায়।

বোধহয় এমন একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন বড়ভাই ও উনার স্ত্রী। বাকি ভাইদের কাউকে কাউকে হাত করে আবারও বসে যান চালকের আসনে। এ যাত্রায় আর্থিক লেনাদেনা আগের তুলনায় ছিল প্রায় দশগুণ। মহোৎসব শুরু হয় অপচয়ের। দেনার বোঝা বাড়তে শুরু করে। একদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং অন্যদিকে ব্যাংক। ত্রিমুখী চাপে ভেঙ্গেপরে উৎপাদন কাঠামো। শুরু হয় আন্তপারিবারিক কলহ। এবং এক সময় গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের সংযোগ। পতন হয় বিশাল এক শিল্প প্রতিষ্ঠানের।

জরুরি ভিত্তিতে আমি যখন অস্ট্রেলিয়া হতে ফিরে আসি অনেক দেরী হয়ে গেছে। একসময়ের কোলাহল-মুখর শিল্প প্রতিষ্ঠান ততদিনে পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। অনেক কষ্টে বাঁচানো গেছে শিল্পের ছোট একটা অংশ। এবং সে অংশ এখনো ধুকে ধুকে টিকে আছে। যখনি এর সামনে দাঁড়াই সেলুলয়েডের ফিতার মত সামনে আসে ফেলে আসা জীবনের চারটা বছর। সামনে আসে দেবতার মত মানা বড় ভাই এবং তার শ্বশুর পক্ষের ক্ষুধার্ত হায়েনার দল।

ম্যারাথন মিটিং শেষে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে এ যাত্রায়। সবাই খুশি তা নয়, মন খারাপ হয়েছে অনেকের। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থ ছিল সবার ঊর্ধ্বে।

জেলা শহরের এদিকটায় আমার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ নিয়ে কাউকে কোন ইঙ্গিত দিইনি। কারণ দূরে থাকলেও শিল্পের চাকা ঘুরবে কিনা তার অনেকটাই নির্ভর করে আমার উপর। যে ৫০-৬০ শ্রমিক এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি তাদের অনেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। বলেছে কারখানার উত্থান পতনের কাহিনী। বলেছে তাদের জীবনের গল্প। এও বলেছে আমি ফিরে এলে এ ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠান কোন এক জাদুবলে আবারও জেগে উঠবে। আবারও শত শত শ্রমিকের পদভারে মুখরিত হবে এ প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু হায়, ওরা জানেনা আমি এখন অন্য জগতের মানুষ, এক কালের সংসার ও সামাজিক বন্ধন হতে মুক্ত ঈগল পাখি এখন বাকি দশজনের মতই চাল ডাল তেল চিনির হিসাবে মিশে গেছে…।

মোরাল অব দ্যা স্টোরি: পৃথিবীতে দেবতার চেহারায় কোন বড় ভাই নেই। আছে জীবন যুদ্ধে সহজ রাস্তা খুঁজে বেড়ানো গ্রীডি কিছু মানুষ। সাথে আছে হায়েনার চেয়েও হিংস্র কিছু জীবন সঙ্গিনী। জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে কথিত এসব দেবতা ও তার দলবল হতে দূরে থাকাই শ্রেয়।

ভাল থাকুক যৌবনের এসব অলিগলি। টিকে থাকুক মানুষ ও মানুষের ভাল-মন্দ লাগার কিছু স্বপ্ন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
একজন দেবতা ও কিছু স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১১-০৮-২০২২ | ১০:০৮ |

    জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে কথিত এসব দেবতা ও তার দলবল হতে দূরে থাকাই শ্রেয়।

    ভাল থাকুক যৌবনের এসব অলিগলি। টিকে থাকুক মানুষ ও মানুষের ভাল-মন্দ লাগার কিছু স্বপ্ন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...