এ যেন অন্য এক পৃথিবী। ঘন মেঘমালা আকাশ আর মাটির ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে জড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় মেঘ দৈত্যদের অলস পদচারণা প্রকৃতির নৈসর্গিক স্তব্ধতাকে স্বপ্নিল ফ্রেমে বন্দী করে তৈরি করেছে বিস্ময়কর প্যানোরমা। প্রথম ক’টা মিনিট কারও মুখে কোন কথা ফুটে না। এ যেন সূরা আর সাকির অনাদিকালের মিলন-মেলা। মাচু পিচু – ইন্কাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। স্প্যানিশ দখলদারদের হিংস্রতা হতে বাঁচতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তৈরি করেছিল বর্তমান বিশ্বের আন্যতম আশ্চর্য এক স্থাপনা।
চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চূড়াগুলো বাহু লগ্না হয়ে ডুবে আছে মেঘ সমুদ্রে। ইচ্ছে করলেই এক খণ্ড মেঘ হাতে বাড়িয়ে কাছে টানা যায়, আদর করা যায়। গলার সূর উঁচু করে হাঁক দিলে সে হাঁক পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পরে, ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তীর ভাঙ্গা তরঙ্গের মত। চারদিকে এক ধরনের ভৌতিক নীরবতা, সাথে প্রকৃতি এবং মানুষের নীরব বোঝাপড়ার বিশাল এক ক্যানভাস।
ইনকা সাম্রাজ্যের বিশালতার কাছে গিজ গিজ করা পর্যটকদের ফিসফাস হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নিপুণ কারিগরের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় হাতেগড়া পাথরের প্রাসাদগুলো সময়ের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। প্রথম যে ধাক্কাটা এসে মগজে আঘাত হানে তা হল, কি করে এত উচ্চতায় এই বিশাল পাথরগুলোকে উঠানো হল! প্রযুক্তি বলে জাগতিক পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণা ঐ নিষিদ্ধ অরণ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। হাত এবং মগজের চাতুর্যপূর্ণ নৈপুণ্যে পাথরগুলোকে উঠানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা, শক্ত কাদামাটি দিয়ে আটকানো হয়েছে হাজার বছরের বন্ধনে।
একদিকে রাজপ্রাসাদ, অন্যদিকে সাধারণ ইনকাদের বসতি এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণাগার সবকিছু মিলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে পেরুর মাটিতে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আগমনের একশত বছর আগেই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কারও মতে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার হতে বাচার জন্যে ইনকারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মাচু পিচুতে। পরবর্তীতে বসন্তের মত মহামারিতে বিলীন হয়ে যায় জনসংখ্যা। পরিত্যক্ত হয়ে গাছপালা, পাহাড়ের আড়ালে চাপা পরে যায় ইনকাদের আশ্চর্য সৃষ্টি মাচু পিচু।
১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগ্নহাম ইনকা সভ্যতার উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে বেশ ক’বার এলাকাটিতে জরিপ চালান। এমনই এক আর্কিওলজিক্যাল জরিপে স্থানীয় কুয়্যেচোয়া গোত্রের ১১ বছর বয়সী বালক পাবলিতো আলভারেজ হিরামকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মাচু পিচুর ট্রেইলে। আধুনিক সভ্যতা বিস্ময় এবং হতবাক হয়ে স্বাগত জানায় হিরামের এই আবিষ্কারকে।
চারদিকে হরেক রকম ভাষা আর ক্যামেরার ক্লিক শব্দে নেশা ধরে আসে নিজের অজান্তেই। সরু এবং সংকীর্ণ পথ বেয়ে অনেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে হাঁটছে ইনকা ট্রেইল জয়ের লক্ষ্যে। এমনই এক মিশনে গেল সপ্তাহে দু’জন ইংরেজ পর্বতারোহী পা পিছলে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের মৃত্যু খাদে। কোন কিছুই মানুষের অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনার অদম্য বাসনা আটকাতে পারেনা, মৃত্যুভয় জেনেও কিশোর হতে শুরু করে বুড়োর দলও নিজকে সাক্ষী করতে চাইছে সভ্যতার এই মহা বিস্ময়ের সাথে।
বেলা গড়াতে ঘন মেঘ কুণ্ডুলি ক্লান্ত বলাকাদের মত উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। পাহাড়ের চূড়াগুলো সহসাই মুক্তি পেল মেঘের আগ্রাসন হতে। সাথে সাথে সূর্যের আলো ভাসিয়ে নিলো লোকালয়। কেউ যেন ছবি তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল ক্ষণিকের জন্যে। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানো আলোতে মায়াবী পরিবেশে হতে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে এলো জাগতিক পৃথিবীতে।
কিছুক্ষণ আগের কনকনে শীত ছাপিয়ে এবার ঝাঁকিয়ে বসল ভ্যাপসা গরম। ট্যুর গাইডের বিরামহীন বর্ণনা একসময় রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে এলো। ভাল লাগছিল না ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইন্কাদের ইতিহাস। মনে হল যাবার আগে প্রকৃতিকে নিজের মত করে কাছে না পেলে এ যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছিটকে পরলাম গ্রুপ হতে।
এবার উঁচুতে উঠার পালা। একটার পর একটা বিপদজনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে শেষ পর্যন্ত সূর্যঘড়ির চূড়ায় এসে হাঁপিয়ে পরলাম। এটাই ছিল জনবসতির সবোর্চ্চ চূড়া। সামনে, পিছনে, ডানে এবং বায়ে শুধুই মৃত্যুফাঁদ। ভারসাম্যের সামান্য হেরফের হলেই আমার আমিত্বে নামবে অমেঘো পরিণতি, ডেথ উদআউট ট্রেইস! চোখ দু’টো বন্ধ করে নিজকে হাল্কা করে নিলাম। পাখীর ডানার মত হাত দু’টো ছড়িয়ে জোড়ে চীৎকার দিতেই সে চীৎকার লক্ষ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো নিজের কাছে। কেন জানি মনে হল আমি এবং আমার ঈশ্বর এখন খুব কাছাকাছি এবং আমার চীৎকার ঈশ্বরের দরবারে পৌছাতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।
বেলা পরে আসছিল, তাই ফেরার আয়োজন করতে হল।
প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে বেরুতেই দেখা মিলল ২০ ডলারের একটা বাফের। ক্ষুধায় পেট উঁচু-স্বরে কথা বলতে শুরু করে দিল। ঢুকে পরলাম ডান বামে না তাকিয়ে। ইনকাদের পোশক পরা বেশকজন তরুণী মায়াবি হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো তাদের আস্তানায়।খুব রসিক মেজাজে ভূরিভোজনের পর উল্টো পথ ধরলাম।
পাহাড় হতে নামতে হবে বাসে চড়ে, তারপর ট্রেন। কুস্কো পৌছাতে রাত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না।
ট্রেনে বসে হঠান করেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চারদিকের শুনশান নীরবতা দেখতে ভাল লাগছিল না। নিজকে বুঝাতে পারলাম না কেন এই বিষণ্ণতা! তবে কি এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর কোনদিন দেখব না বলেই এই ভাবাবেগ? পৃথিবীর এই অঞ্চলগুলোতে আর কোনদিন পা ফেলব না বলেই হয়ত এ সাময়িক আচ্ছন্নতা। কিন্তু কে জানত দু’বছর পরেই আবার আমাকে আসতে হবে এখানে। মাচু পিচুর পাহাড় এবং মেঘদের লুকোচুরির কোন এক বাঁকে নতুন করে পরিচয় হবে এন্ডিসের দেশ পেরুর সাথে! সে অন্য এক কাহিনী, অন্য এক অধ্যায় যার সাথে এ লেখার কোন সম্পর্ক নেই।
হোটেলে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতের খাবার শেষে সকাল সকাল শুয়ে পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব সকালে বাস ধরতে হবে। পরবর্তী ঠিকানা লেক টিটিকাকা, পেরুর সীমান্ত শহর পুনো।
loading...
loading...
ইনকাদের মাচু পিচু… পেরুর এন্ডিস!
যেন ভীষণ পরিচিত এই জনপদ। একটা সময় ভীষণ আগ্রহ নিয়ে এই বিষয়ে বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার লিখা গুলোন পড়া হতো। আজও পড়লাম স্যার। বরাবরের মতো মুগ্ধ পাঠ। ধন্যবাদ।
loading...
অনেক ধন্যবাদ পাঠক হয়ে সাথে থাকার জন্যে
loading...