বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দুয়েক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে। মনে হল স্বপ্ন দেখছি! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে সপ্ত ডিঙ্গায় চড়ে উড়ছি আমি, সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া।
জ্যাকেটটা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউ-না কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ। ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। এ মুহূর্তে বিশ্রাম দরকার আমার, সাড়া জীবনের বিশ্রাম। কিন্তু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর হাড্ডি কাঁপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাঁড়াল বাস এবং বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্যটাকেও কেমন যেন ক্লান্ত মনে হল। পুরানো চিন্তাটা আবারও ঘুরপাক খেতে শুরু করল মগজে, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে আমাকে। এ মুহূর্তে কোন ভাবেই ক্লান্ত হওয়া চলবে না।
দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিস্ফোরিত হল ট্যুর গাইড। সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পার। দুএক জন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা। বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভুলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ।
পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফিরে এলো। লাগেজ খুলে জায়গা মতো হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে, শুধু জীবন হতে খসে গেছে ৩টা ঘণ্টা। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিষ্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা সত্যেও নামতে হল বাস হতে। পরিষ্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা।
আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র। বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দুএক জন যাত্রীর।
বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গতি নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হতো বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত!
এবার আমার প্রশ্ন করার পালা। ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে। কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাঁপল না। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানষিকভাবে পঙ্গু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দিলাম।
আরও আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করল আমাদের বাসটা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার কোন হদিস পাওয়া গেলনা। যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল, মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও স্বল্প সময়ে লা-পাস পোঁছানো সম্ভব হবে।
আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না। মনে মনে ঠিক করলাম লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে নামছি না আর। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষণ সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেল এন্ডিসের রহস্যময় বাঁকে।
তন্দ্রা মতো আসছিল। কিন্তু সামনে একটা নড়বড়ে সেতুর কারণে বাসটাকে থামতে হল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল সেতুর চেহারা দেখে। দৈত্যের তাণ্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দূর হতে যতটা দুর্বল মনে হয়েছিল বাস্তবে ততটা দুর্বল মনে হলোনা।
কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। শরীরটাকে ঠেলেঠুলে কোন রকমে বাসে ওঠালাম এবং আবারও ধপাস করে বসে পরলাম আগের জায়গায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা। চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষণ। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরীরের উপর।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি টের পাইনি। চোখ খুলে জানালার বাইরে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সারাদিনের ক্লান্তি। মাঠ আর মাঠ। ঠিক বুক বরাবর চলে গেছে কাচা পাকা ট্রেইলটা। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত এন্ডিসের চূড়াগুলোর নৈসর্গিক প্যানোরমা, অন্যপাশে অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দুএক জন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে এন্ডিসের দুর্গম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা।
নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খণ্ড খণ্ড জমিতে ভুট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চিল আর কায়োটির দল। জানালার বাইরে সূর্যটাকে আগ্নেয়গিরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখাচ্ছে। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামান্য খুলতেই এন্ডিসের শোঁ শোঁ হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সিটে বসা অস্ট্রেলিয়ান স্বামী-স্ত্রী বিনীত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে।
ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস। ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আঁটকে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে, সামনে বিপদ!
আসলেই বিপদ, সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল অনেকটা জীবন্ত কঙ্কালের মত। আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকার হতাশা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্যুর গাইড এসে জানাল চাইলে নীচে নামতে পারি।
দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো জ্যাকটা ভেঙ্গে গেছে ! বাস হতে নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। মনে হল এ ওঠানামা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে।
নিজেকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাঁধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে। এবং হাত পাওয়ালা দুএক জন আদমকে দেখা গেল ঘুরাফেরা করতে।
ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপুরী হতে নতুন একটা জ্যাক আনবে বলে। সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সে রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষণে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষণ। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল। পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি।
হঠাৎ করে চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। দু’টা বাসের সব যাত্রীদের স্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদ-কালীন সময়ের প্রস্তুতি নিয়েই যেন ভ্রমণে বের হয়েছে। সবাই পেট পুরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমবো বলে।
১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলি গামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল এন্ডিসের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষণ করতেও বাধ্য হয় অনেকে। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখণ্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লোমহর্ষক ঘটনার খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে?
আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমত আমরা এন্ডিসের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়। মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়। তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, – এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজকে বোঝালাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।
শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। অনেকেরই দাঁত নেই, নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দরিদ্রতার সাথে রুক্ষ প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে এন্ডিসের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যেত না।
শত বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বেশ কটা ছবি তুল্লাম। সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে এলাম আঙ্গিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। পানি মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে। নিথর হিম শীতল ঠাণ্ডা! সময়টা মন্দ কাটল না এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও।
এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুলে বিরল মুহূর্ত গুলো ধরে রাখার চেষ্টা করল অনেকে। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর ধোঁয়াটে আবহাওয়ার ফাঁক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এলো স্বপ্নের সে রাজপুত্র। হাতে বিশাল একটা জ্যাক। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়ারা বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।
loading...
loading...
এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে …
অসাধারণ স্মৃতিগাঁথা পড়লাম। আগেও আপনার লিখার ভক্ত ছিলাম; এখনও আছি।
loading...
অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
loading...