– ব্রেকফাস্ট ইন তেল আভিভ-
অনেকদিন হয়ে গেল পাখিদের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে না। তাসমান পাড়ের সিডনির ফ্লাটটা ছিল সাগরের খুব কাছে। ওখানে কান পাতলে হরেক রকম পাখিদের গান শোনা যেত। অবশ্য বেলা গড়ানোর সাথে এনযাক প্যারেডের গাড়ির স্রোত গ্রাস করে নিতো মিহি সুরের কিচির মিচির গান। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার পর অনেকদিন মিস করেছি বীচের পাশে রোদময় ঝলমলে সকাল গুলো।
বেন ইহাহুদা স্ট্রীটের উপর সেন্ট্রাল হোটেলটার কোন শ্রী ছিলনা। সাদামাটা মোটেলের মত। প্রথম দেখায় আমাদের মগবাজারের কোন হোটেলের সাথে গুলিয়ে ফেললে অন্যায় হবেনা। তবে সব বিচারে ক্লান্ত, শ্রান্ত পরিব্রাজকদের সস্তায় রাত কাটানোর আয়োজন ছিল সন্তোষজনক। অনলাইনে হোটেল খুঁজতে গিয়ে ডাউন টাউনের কাছাকাছি এর চাইতে সস্তা কোন হোটেল খুঁজে পাইনি। তাই হোটেলটার ভালমন্দ নিয়ে অভিযোগ করার কারণ ছিলনা।
সেই হোটেলেই ঘুম ভাঙ্গল পাখিদের ডাকে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে মনটা হাল্কা হয়ে গেল। দুটো কবুতর বসে আছে রেলিংটায়। থেমে থেমে শব্দ করছে। ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কাঁচের ওপাশে আমাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই উড়াল দিল। হয়ত ভয় পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর নতুন দুজন অতিথি এসে ফিরে গেল পুরানো কাজে।
রাতের ঘুম খুব একটা লম্বা হয়নি। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি এখনো অন্ধকার। হঠাৎ করেই অংকটা মাথায় এলো যা এয়ারপোর্টে নেমে কষে নিয়েছিলাম। আমার শহরের চাইতে ৯ ঘণ্টা এগিয়ে ইসরাইলের সময়। সে হিসাবে এখন ভোর প্রায় ৪টা। দুয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। রাস্তা পরিষ্কার করার ট্রাকটাকে দেখলাম বেশ সময় নিয়ে পরিষ্কার করছে।
বাইরে তাকালে মনে হবে ঢাকার কোন গলির কার্বন কপি। পাশের জরাজীর্ণ দালানের অনেক জায়গায় পলিস্তরা খসে খসে পরছে। ছাদের উপর পুরানো দিনের এন্টেনা। জানালার পর্দাগুলোও স্যাঁতস্যাঁতে। শুধু বাকি ছিল মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি ভেসে আসার।
ভোরের আলো ফুটতেই রাতের খিদাটা মোচড় দিয়ে উঠল। অপেক্ষা করার সময় ছিলনা। নিশ্চয় এতক্ষণে দোকান-পাট খুলে গেছে। হয়ত হোটেল গুলোতে ব্রেকফাস্ট গ্রাহকদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। বেরিয়ে পড়ার এটাই ছিল উত্তম সময়। আরও একপ্রস্ত গোসল শেষে পরিষ্কার জামাকাপড় পড়ে লবির দিকে রওয়ানা দিলাম।
আবারও হতাশ হলাম। হোটেলের মুল ফটক তখনো তালা দেয়া। রেসিপশনে কেউ নেই। আনাতোলি স্তেপানভিচকে কোথায় দেখতে পেলাম না। অজান্তেই মুখ হতে অশ্রাব্য একটা গালি বেরিয়ে এলো। লবির কফি মেশিন হতে আবারও এক কাপ কফি নিয়ে ফিরে এলাম রুমে।
ভ্রমণের ক্লান্তি ও পেটে সাহারা মরুর ক্ষুধার কারণে রাতে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। সকালে তা বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে গেলাম। ফোন ও ল্যাপটপের চার্জ কমে আসছে। বড়জোর ঘণ্টা-খানেক চলবে। এরপর রি-চার্জ না করলে দুটোই নিস্তেজ হয়ে পড়বে।
সমস্যাটা নতুন নয়। এর আগেও পৃথিবীর অনেক দেশে মুখোমুখি হয়েছি। তবে প্রতিবার তার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছি। কিন্তু এ যাত্রায় ব্যপারটা একবারের জন্যেও মাথায় আসেনি।
রি-চার্জের জন্যে এডপটার দরকার। এখানকার পাওয়ার কর্ডের সাথে আমেরিকান কর্ডের মিল নেই। কানেকশনের জন্যে চাই এডপটার। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না করা গেলে আমার গোটা সফরটাই অন্ধকারে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল।
৮টার দিকে দ্বিতীয় চেষ্টায় বেরিয়ে পরলাম হোটেল হতে।
তেল আভিভ। যে কোন মানদণ্ডে আধুনিক একটা শহর। চারদিক চকচক করছে সবকিছু। নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থাও যে কোন আধুনিক শহরের মত। রুম হতে দেখা পুরানো বাড়িটা মনে হল একটা যাদুঘর। নিজের মত করে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা হতে পারে সক্ষম-হীন কোন পরিবার শেষ অবলম্বন হিসাবে আঁকড়ে ধরে রাখছে বাড়িটা। এক কথায় পাশের কোন বাড়ির সাথেই মিল নেই।
সময় গড়ানোর সাথে বাড়ছে মানুষের কোলাহল, গাড়ির মিছিল। জেগে উঠেছে তেল আভিভ।
হোটেলের ঠিক উলটো দিকে বেশকটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো। খোলার আয়োজন চলছে কেবল। দরজায় সময় পরখ করতে গিয়ে হতাশ হলাম; ৯টার আগে একটাও খুলবে না।
সময় করে ব্রেকফাস্ট করতে চাইলে আমাকে আরও ঘণ্টা-খানেক সময় ব্যয় করতে হবে কোথাও। সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম নতুন রেস্টুরেন্টের সন্ধানে।
গর্জনটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। কিছু মানুষের পোশাকও ইঙ্গিত দিচ্ছিল সন্দেহটার। নিশ্চয় সামনে কোথাও সমুদ্র। আপাতত সবকিছু উঠিয়ে রেখে ওদিকটায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। জমে থাকা সময় কাটানোর উপযুক্ত জায়গা! কয়েক ব্লক হাঁটার পর আন্দাজ করে নিলাম কোন দিক হতে বইছে এ বাতাস।
কিছুটা এগুতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। সমুদ্র! শহরের রাস্তা গুলো ঢালু হয়ে ওদিকেই যাচ্ছে আমার মত। দুপাশের স্কাই স্ক্র্যাপার গুলো বলে দিচ্ছে জীবন এখানে অনেক দামী। হাতে যথেষ্ট অর্থ না থাকলে এমন এলাকায় বাসকরা সম্ভব নয়। এক কথায় বিত্তবানদের এলাকা।
প্রথম দেখায় তালগোল পাকিয়ে যায় সবকিছু। মগজের সবকটা কলকব্জা একবিন্দুতে এসে স্থির হয়ে যায়। ভূমধ্য সাগরের রাশি রাশি ঢেউ! সাথে নীলাভ আভা। তীরে এসে আছড়ে পরে মিশে যাচ্ছে বালুকা বেলায়। কলোম্বিয়ার সান্তা মার্তায় দেখা ক্যারিবিয়ান সাগরেরই যেন কার্বন কপি। ঢেউ ভারত মহাসাগরের মত উত্তাল না হলেও তাতে আছে এক ধরণের মায়াবী আবহ। সহজে চোখ ফেরানো যায়না।
বীচের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম খুব একটা ভিড় নেই। দুয়েকজন বয়স্ক মানুষ তাদের প্রাতঃকালীন জগিং করছে। বিকিনি পরা মহিলারাও জড়ো হচ্ছে। একজন ভারতীয় মহিলাকে একটু অবাক হলাম। দৃষ্টিকটু পোশাক পরে শামিল হওয়ার চেষ্টা করছে মুল কাফেলায়।
২৪ ঘণ্টারও কম সময় এ দেশে। এরই ভেতর একটা উপসংহার টানলে বোধহয় ভুল হবেনা। এ দেশের মেয়েরা বিপদজনক সুন্দরী। কেবল গায়ের রঙ আর চেহারাই নয়, শরীর সঠিক রাখার মাপকাঠিতেও ওরা এগিয়ে। ছেলেদের সৌন্দর্য বিচার করার দায়িত্ব আমার নয়। কিন্তু এদের দিকে তাকালেও মনে হবে ঈশ্বর হয়ত নিজ হাতে তৈরি করেছেন।
বীচের পাশেই দেখা মিলল মাকডোনাল্ডের। পরিচিত দোকানের গন্ধ পেয়ে ওদিকে রওয়ানা দিতে দেরী করলাম না। খোলা থাকলে নাস্তা ওখানেই সেরে নেয়া যাবে ভেবে স্বস্তি পেলাম। কিন্তু হতাশ হলাম। ভেতরে কোন আলো নেই। একেবারেই অন্ধকার। দেখে মনে হল মেরামত চলছে। খাবার যেন অধরা হয়ে গেল তেল আভিভ শহরে।
ঘণ্টা-খানেক সময় কাটিয়ে হোটেলে ফেরার রাস্তা ধরলাম। ওখানের রেস্টুরেন্ট গুলো এতক্ষণে খুলে যাওয়ার কথা। দরদাম অথবা প্রকারভেদ খুঁজে দেখার মত অবস্থা ছিলনা। ঢুকে পরলাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে।
মেনু হিব্রু ভাষায়, তাই বুঝতে অসুবিধা হল। তবে তালিকার পাশে ছবি থাকায় কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারলাম।
সাজগোজে পরিপক্ব সুপার আবেদনময়ী মেয়েটা ভুবন-জুড়ানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এদিকটায় এই প্রথম বুঝি?’
আমিও সহজ ভাবে উত্তর দিলাম। ‘একেবারে ব্রান্ড নিউ। চব্বিশ ঘণ্টারও কম।
সময় নিয়ে রান্না করলো। প্লেট যখন টেবিলে রেখে গেল আমার চোখ ছানাবড়া। বিশাল আয়োজন। ছোট একটা বাস্কেটে চার টুকরো পাউরুটি। টমেটো সসে ডুবানো দুটো ডিম ভাজি। শসা ও টমেটোর সালাদ। সাথে অলিভ ওয়েল। এবং ফ্রেশ এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। তেল আভিভের প্রথম ব্রেকফাস্ট। এক কথায় ইসরায়েলে আমার প্রথম খাবার।
loading...
loading...
তেল আভিভের ব্রেকফাস্ট।
সম্ভবত এই সিজনে দীর্ঘ ধারাবাহিকটি আপনার মাধ্যমে পড়ার সুযোগ হলো। গুড লাক।
loading...
এ প্লাটফর্মে সুযোগ করে দেয়ার জন্যে আপনাকেও ধন্যবাদ।
loading...