পৃথিবীর এ প্রান্তে আমার প্রথম রাত। দ্বিধা, সংশয় আর বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ইসরায়েল নামের দেশটায় সহজে পৌঁছতে পারবো এর কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। সংশয় থাকলেও ভয় ছিলনা। সীমান্ত হতে ফিরিয়ে দিলে তেমন কিছু হারানোর ছিলনা আমার।
ইসরায়েল নামের একটা দেশ দেখার আকর্ষণ কি আমাকে এখানটায় টেনে এনেছে! বোধহয় না। তেল আভিভ, হাইফা, রিশহন যিলিওনের মত ইসরায়েলি শহরগুলোতে হয়ত আর দশটা শহরের মত জীবন আছ।, তবে সে জীবন আমার মত গোবেচারা টাইপের একজন টুরিস্টকে টানার জন্যে যথেষ্ট মনে হয়নি। আমি এসেছি আসলে প্যালেষ্টাইনিদের দেখতে। পশ্চিমা অর্থ ও পেশী শক্তির কাছে পরাজিত একটা জাতির জীবনকে কাছ হতে দেখার আগ্রহ নিয়েই এখানে আসা।
রাত গড়াচ্ছিল। টিক টক শব্দে ভ্রমণের ঘড়ি কখন মধ্যরাত পাড়ি দিয়েছে টের পাইনি। গরম পানিতে লম্বা একটা গোসল দিয়ে শরীর মন হতে ঝেড়ে ফেললাম ভ্রমণের ক্লান্তি। ধবধবে সাদা বিছানাটাকে এ মুহূর্তে দেখাচ্ছিল লাস্যময়ী নারীর তুলতুলে শরীরের মত।
না, ঘুমের কাছে নিজকে সপে দেয়ার সময় না এটা। পেটের ক্ষুধা ক্যান্সারের মত চেপে বসেছে গোটা শরীরে। মগজ প্রায় বিকল। যেকোনো মূল্যে কিছু একটা দিতে হবে পেটে। পোশাক পালটে রওয়ানা দিলাম লবির দিকে।
আনাতোলি স্তেপানভিচকে দেখে একটু অবাক হলাম। রাত অনেক হয়েছে অথচ ছোট টেবিলটায় বসে হাবিজাবি কি যেন লিখছে। আমাকে দেখে রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে চোখ তুললেন।
কোন ভণিতা না করে জানতে চাইলাম হোটেলের ক্যান্টিন হতে খাওয়ার মত কিছু পাওয়া যাবে কিনা। রাত হয়ে গেছে, এসময় ক্যান্টিন খোলা থাকার কথা না। তাই অনুরোধের ভাষায় বিনয়ের কোন অভাব রাখলাম না।
হোটেলের কোন ক্যান্টিন নেই, ভাবলেশহীন আনাতোলির চেহারায় সামান্যতম বিনয় ছিলনা। আমিও নাছোড় বান্দা। পেটে কিছু দিতেই হবে, তা না করলে সারারাত জাগতে হবে। বুঝিয়ে বলতে কিছুটা নরম হল হোস্টের চেহারা। হাতে একটা চাবি ধরিয়ে অনুরোধ করল ফেরার সময় যেন শব্দ না করি। সিঁড়ির বাতি মূল সুইচ হতে বন্ধ থাকবে, তাই এ নিয়েও যেন হৈচৈ না করি তা মনে করিয়ে দিলেন।
মধ্যরাতের তেল আভিভ! হোটেলের মূল দরজা খুলে রাস্তায় পা রাখতে ঠাণ্ডা বাতাস চোখে মুখে প্রশান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিল। বেন ইয়াহুদা স্ট্রীট একেবারেই ফাঁকা। মাঝে মধ্যে দ্রুত গতির দুয়েকটা গাড়ি মনে করিয়ে দিচ্ছিল এ শহরেও জীবন আছে। ট্রাফিক বাতিগুলো পালা করে লাল সবুজ বাতির আভা ছড়াচ্ছে।
আমি হাঁটছি আর হন্যে হয়ে সন্ধান করছি মুখে দেয়ার মত খাবারের। আগেই লক্ষ্য করেছি পুলিশের গাড়িটা আমাকে ফলো করছে। তিনবার চক্কর দেয়ার পর ব্রেক কষলো আমার পাশে। কোন সমস্যায় আছি কিনা জানতে চাইলো। সংক্ষেপে তুলে ধরলাম মধ্যরাতে তেল আভিভের রাস্তায় পদচারণার পটভূমি। দুই ব্লক দূরে একটা নাইট ক্লাবের দিকে ইঙ্গিত করে জানাল ওখনাটায় কিছু একটা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে থেমে থেমে। নিশ্চয় ভূমধ্য সাগর খুব একটা দূরে না। বেশকিছুটা দূর হতেই বুঝা যাচ্ছে নাইট ক্লাব বন্ধ হতে চলছে। কাছাকাছি আসতে ফটকের বাউন্সার জানালো তাদের ফুড অপশন ১২টার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। কাউন্টারে হাল্কা কিছু স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা থাকলেও এ মুহূর্তে সেটাও বন্ধ। বাড়তি কোন ঝামেলা এড়াতে আমাকে হোটেলে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দিল।
মগবাজার মোড়ের হোটেলগুলো কি এখনো খোলা আছে? হিসাব করলে ঢাকায় নিশ্চয় এখন সকাল। হোটেলগুলোর জীবন শুরু হতে যাচ্ছে কেবল। এ মুহূর্তে গরম দুটো পারোটা আর খাসির পায়ার বিনিময়ে ইসরায়েল সফর বিকিয়ে দিতেও দ্বিধা করতাম না। বসবাসের অযোগ্য তালিকার শীর্ষে থাকা ঢাকাকেই মনে হল পৃথিবীর সবচাইতে খাদ্য-বান্ধব শহর!
আমি আসলেই ক্ষুধার্ত। তেল আভিভে এ মুহূর্তে পেটে দেয়ার মত কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লবিতে কফি মেশিন চালু আছে। ওখান হতে বড় এক কাপ কফি নিয়ে রুমে ফিরে রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আনাতোলির উপদেশ মেনে বেড়ালের মত নিঃশব্দে ফিরে গেলাম নিজ রুমে।
আজ আর ঘুম আসবেনা। হঠাৎ করেই মনে হল এ শহরে করার মত কিছু নেই আমার। দেখার তেমন কিছু থাকলেও আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। সকালে আরও এক প্রস্ত গোসল দিয়ে নাস্তা শেষ করে জেরুজালেমের দিকে রওয়ানা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
– চলবে।
loading...
loading...
চমৎকার এগিয়ে চলেছে লিখাটি। বরাবরের মতো মুগ্ধ পাঠক হয়ে মনযোগ দিয়ে আপনার লিখা পড়ি। ভালো লাগে অচেনা অজানা দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে। চলুক।
loading...