জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা... ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৯

27392

বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট হতে তেল আভিভ শহর ২০ কিলোমিটার পথ। অবেলায় ট্যাক্সি ক্যাব ছাড়া দ্বিতীয় কোন মাধ্যম নেই ওখানে যাওয়ার। টুরিস্ট ব্যুরোর বুথ হতে যাবতীয় তথ্য নিয়ে রওয়ানা দিলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। গড়পড়তা সময় ও ভাড়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ায় ক্যাবিদের হাতে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাটা দূর হয়ে গেল।

ট্যাক্সি ক্যাবের লাইন অনেক সময় একটা দেশের আয়না হিসাবে কাজ করে। ট্যুরিজমের প্রতি একটা দেশ অথবা জাতির কমিটমেন্টের পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায় লাইনের স্বচ্ছতা ও ড্রাইভারদের আচার ব্যবহারে।

ঢাকা এয়ারপোর্টের কথা মাথায় রেখেও যদি অন্য কোন এয়ারপোর্টের কথা মনে করতে চাই প্রথম আসবে সোভিয়েত কালে মস্কোর শেরমেতেয়াভা এয়ারপোর্ট। ওখানে সরকারী ট্যাক্সি লাইনের ছায়ার নীচেই বাস করতো একদল প্রতারক। যাত্রীদের সস্তা ভাড়ার লোভ দেখিয়ে অচেনা কোন গন্তব্যে নিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। না জেনে ওসব ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই চরম মাশুল গুনতে বাধ্য হত সে সময়।

ভেতরে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও ট্যাক্সি লাইনে তেমন ভিড় ছিলনা। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর ডিসপাচার আমাকে খালি একটা ট্যাক্সি ধরার ইশারা দিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষার পর ড্রাইভার বেরিয়ে এসে শুভেচ্ছা বিনিময় করল। বড় লাগেজটা নিজ হাতে ট্রাংকে উঠিয়ে আমাকে ভেতরে আসার আহবান জানাল।

প্রথম দর্শনেই বুঝে নিলাম ড্রাইভারের জাতিগত পরিচয়। রুশ!
কেবল চেহারায় না, গোটা শরীরে একধরনের ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘনের ছাপ। চোখে মুখে রুক্ষতার ছোঁয়া, মুখের ভাষাও তরবারির মত ধারালো ও কর্কশ।

আমার মুখে খাঁটি উচ্চারণের রুশ ভাষা শুনে একটু ভড়কে গেল। প্রথমে মনে করেছিল আমি তাদেরই একজন এবং এদেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা। ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার সাথে সদর্পে ফিরে গেল রুশ চেহারায়। পরিচয়ের দুই মিনিটের মাথায় তুই তোকারির সাথে আলাপচারিতায় অশ্লীল রুশ শব্দ ব্যবহারের বন্যা বইয়ে দিল।

নিজের জন্যে এ ছিল মারাত্মক সাবধান বাণী। আমার জানা ছিল ইসরায়েলি নাগরিকদের একটা বিরাট অংশের আদিবাস সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য। রুশ এখানে খুবই প্রচলিত ভাষা। কথায় কথায় অপরিচিত কারও কাছে নিজের রুশ কানেকশন উন্মোচন না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

আর দশটা পশ্চিমা শহরের মতই এয়ারপোর্ট হতে তেল আভিভ যাওয়ার রাস্তা। দ্রুত গতির রাস্তাটায় কোন ট্রাফিক লাইট নেই। অনেকটাই মার্কিন ফ্রীওয়ে গুলোর মত। ২০ কিলোমিটার পথ হলেও গতির সীমাবদ্ধতার কারণে সময় লেগে গেল।

ঝাঁপিয়ে রাত নেমে গেছে তেল আভিভে। ট্যাক্সি ক্যাবের ঘড়িটায় রাত প্রায় ৯টার মত। হাতের ঘড়িটায় ইসরায়েলি সময় সেট করে নতুন আরও একটা দেশে পা রাখার মানসিক প্রস্তুতি নিলাম।

রাত মাত্র ৯টা। অথচ তেল আভিভ অনেকটাই নীরব। চারদিকে এক ধরণের ভৌতিক নীরবতা। হঠাৎ দেখায় মনে হবে ব্যস্ত একটা দিনের পর ক্লান্ত অবসন্ন মানুষ সকাল সকাল বিছানায় চলে গেছে। রাস্তার দুপাশের স্কাই স্ক্রাপারগুলোতেও কোন বৈচিত্র্য নেই। মূর্তিমান আতংকের মত নিজেদের অবস্থান জানান দিলেও তাতে নেই প্রাণের স্পন্দন। পার্থক্য কেবল শহরের বিলবোর্ড গুলো। চারদিকে হিব্রু ভাষার ছড়াছড়ি। ইংরেজির দাপটও চোখে পড়ার মত। তবে আরবি একবারেই অবহেলিত। হতে পারে কল্পনায় আমি তেল আভিভে সদ্য ফেলে আসা সান ফ্রান্সিসকোর মত ঝলমলে আলো আর মধ্যরাতের বাঁধভাঙ্গা যৌবন দেখতে চেয়েছিলাম। তাই প্রথম দেখায় কিছুটা হলেও হতাশ হলাম।

27398

দশটার উপর বেজে গেল বেন ইয়াহুদা স্ট্রীটের উপর সেন্ট্রাল হোটেলটায় পৌঁছতে। রুম আগেই বুক করা ছিল। তাই চেক-ইন ঝামেলায় অতিরিক্ত সময় বায় করার তাগাদা ছিলনা।

টিপস সহ ১৮০ সেকেল (ইউএস ডলারে ৫৬ ডলার) ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হোটেল ফটকে আসতে হতাশ হলাম। তালা ঝুলছে মূল ফটকে। সামনের সবকটা বাতি নেভানো। ভেতরটাও অন্ধকার।

আমার জন্যে দেশটা একেবারেই নতুন। রীতিনীতি দূরে থাক দেশটার সাধারণ মানুষগুলো সম্পর্কেও তেমন ধারণা নেই। ইসরায়েল বলতে এতদিন জেনে এসেছি বেনইয়ামিন নেতনিয়াহু, এরিয়াল শ্যারণ আর ইয়াহুদ বারাকের মত রাজনীতিবিদদের। তাই রাত ১০টার পর হোটেলের ঘুমন্ত মানুষগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকার কোন পথ বের করতে পারলাম না। হাতের সুটকেস মাটিতে ফেলে অনেকক্ষণ ঠায় বসে রইলাম।

রাত গড়াচ্ছিল। যেকোনো ভাবে ভেতরে যাওয়ার তাগাদাটা অজগর সাপের মত তেড়ে ফুরে উঠছিল। আমি বুকিং দিয়েই এ হোটেলে এসেছি এবং আমার আগমনের সময়ও ওদের ইমেইল করে জানিয়েছি। ইউরোপ আমেরিকার কোন হোটেল হলে ওরা দরজা খুলে আমার অপেক্ষায় থাকত। সৌজন্য বোধ বিদায় নিয়ে এবার ক্রোধ চপে বসল মগজে। আঙ্গুলের সব শক্তি এক করে কলিং বেলে টিপ দিলাম।

বেশ ক’বার টিপলাম। কারও কোন সাড়া শব্দ নেই। হোটেলের কোন লবি আছে বলেও মনে হলোনা। ভেতরে একধরণের ভয় দানা বাধতে শুরু করল। কি হবে যদি আদৌ কেউ দরজা না খোলে!
লোহার গেইট ধরে সজোরে ধাক্কা দেয়া শুরু করলাম।
খুট করে একটা আওয়াজ হল। দূরের সিঁড়িতে একটা অনুজ্জ্বল আলোর রেখা ফুটে উঠল। সাথে হালকা পায়ে সিঁড়ি ভাঙ্গার শব্দ। কেউ একজন এগিয়ে আসছে।

পরিচয় না দিলেও যা বুঝার তা আমি বুঝে নিলাম। রুশ ভাষায় অশ্লীল একটা গালি দিয়ে চেইন লাগানো তালাটা খুলতে শুরু করল। এ যাত্রায় ভাষা ব্যবহারে সতর্ক হয়ে গেলাম। আমি একজন আমেরিকান এবং সামনের লোকটা আমার ট্যাক্সের পয়সায় লালিতদের একজন, ভাবনটা সামনে আনতে সবকিছু সহজ হয়ে গেলাে।

এবার কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলাম আমার বুকিং সম্পর্কে ধারণা থাকলে দরজা খুলতে এত দেরী হচ্ছিল কেন! রুশ অরিজিন মানুষদের ভোকাবুলারিতে ক্ষমা বলতে কোন শব্দ নেই, হোক তা ইহুদি, তাতার অথবা আজেরি। তাই আমার হোটেল গাইডের মুখ হতে এমন কোন শব্দ আশা করলাম না।

কাউন্টারে তার ভাইয়ের থাকার কথা এ সময়ে, এমন একটা তথ্য দিয়ে এড়িয়ে গেল আমার প্রশ্ন। আসলে কাউন্টার বলতে তেমন কিছু নেই হোটেলে। সিঁড়ির কোনায় একটা টেবিল, পাশে একটা কফি মেশিন ও ছোট মত একটা বক্সে কিছু ব্রসিউর, এসব নিয়েই হোটেলের রিসিপশন। সস্তা হোটেল খোঁজার মূল্যটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেল, চিন্তাটা মাথায় আসতে আরও সাবধান হওয়ার তাগাদা অনুভব করলাম।

নিজকে আনাতোলি স্তেপানভিচ হিসাবে পরিচয় দিল। এটা নাকি তাদের পারিবারিক ব্যবসা। দুই ভাই পালা করে দায়িত্ব পালন করে থাকে। সাধারণত রাত ১০টার পর এদিকটায় নাকি কেউ আসেনা, তাই চোখ কান খোলা রাখে না মূল ফটকের দিকে। হাতে একটা টর্চ-লাইট নিয়ে দুজনে দোতলার সিঁড়ি ভাঙ্গতে শুরু করলাম। বাকি বোর্ডারদের সবাই ঘুমাচ্ছে তাই করিডোরের বাতি জ্বালানো আনাতোলির কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলোনা। তর্ক করার ইচ্ছা ছিলনা, তাই সবকিছু নীরবে হজম করতে বাধ্য হলাম।

রুমের অবস্থাও অনেকটা আনাতোলির মত। কোথাও কোন চাকচিক্য নেই। রাত কাটানোর জন্যে নূন্যতম যা দরকার তার বাইরে কিছু নেই। অনলাইনে বুকিং দেয়ার সময় এমন কিছু ঘটবে তার কিছুটা হলেও আন্দাজ ছিল। কারণ একটু ভাল হোটেলের ভাড়া ছিল এ হোটেলের চাইতে দুই তিন গুন বেশী।

হোটেলের কোয়ালিটি নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা ব্যথা কোন কালেই ছিলনা। কোলকাতার সদর রোডের সস্তা হোটেলের খাটিয়া অথবা বলিভিয়ার রাজধানী লা পাসের শ্রীহীন হোস্টেলের লোহার বেড, কোন কিছুতে সমস্যা দেখিনি। দিনশেষে মাথা গোজার একটা ঠিকানাই যথেষ্ট ছিল।

চলবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা... ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৯, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১১-০৪-২০২২ | ৯:০৩ |

    মুগ্ধ পাঠক হয়ে পড়ে চলেছি প্রত্যেকটি পর্ব। একরাশ শুভ কামনা আপনার জন্য। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ১১-০৪-২০২২ | ১৭:১৩ |

    পড়লাম! পড়ে উড়ে গিয়ে দেখার স্বাদ জাগে!

    GD Star Rating
    loading...