আকাশ পথে লম্বা জার্নির এই এক অসুবিধা। এক সময় মনে হবে এ পথ কোন দিন শেষ হওয়ার নয়। চলছি তো চলছিই। ব্রেকফাস্টের পর লাঞ্চ আসে, লাঞ্চের পর ডিনার, মাঝখানে চা-কফি পর্ব। দিন গড়িয়ে রাত নামে। সময়ের হেরফেরে সে রাত শেষ হতেও সময় লাগে না।
ফ্লাইট হোস্টেসদের এলোপাথাড়ি চলাফেরা, কিছু কিছু যাত্রীদের কারণে অকারণে হোস্টেসদের বিরক্ত করা, সর্বোপরি ফ্লাইট ফ্লোরে জমতে থাকা আবর্জনার স্তূপ একসময় মগজে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মনে হয় এসব দৃশ্য আমি অনন্তকাল ধরে দেখছি। সহযাত্রীদেরও মনে হয় কতকালের চেনা।
ইন-ফ্লাইট মুভি দেখায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না কাছের সীট হতে ভেসে আসা ম্যারাথন কান্নার কারণে। বয়স হয়ত ১ মাসও হয়নি, এমন একটা শিশুকে নিয়ে আকাশ জার্নি করার কোন জাস্টিফিকেশন খুঁজে পেলাম না। বিশেষকরে জার্নি কাফেলায় যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক একাধিক শিশু থাকে।
কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পাইনি। পাশের সীটের মেয়েটা এক মিনিটের জন্যেও বইয়ের পাতা হতে চোখ সরায়নি। মাঝখানের সীটটা খালি, শরীর আলগা করে হেলান দিয়ে বসতে ঝিমুনি এসে গেল। কখন চোখ বুজে ঘুমাতে শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। বাইরে দিন কি রাত সেটা বুঝারও উপায় ছিলনা। জানালার উপর পর্দা এঁটে গভীর রাত মেইনটেইন করছিল ফ্লাইট হোস্টেসরা।
যাত্রীদের চঞ্চলতাই বলে দিচ্ছিল আমরা খুব একটা দূরে নেই। শেষবারের মত খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পরলো হোস্টেসরা। দুদিকের বাথরুমে লম্বা লাইন ধরে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছে যাত্রীরা। জানালার ঢাকনা সরিয়ে বাইরে তাকাতে নিকস কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। মনিটর ম্যাপে চোখ ফেরাতে ধারণা পেলাম আমাদের বর্তমান অবস্থান। আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ।
তারিখ ও দিনের কোন হদিস ছিলনা। হাতের ঘড়িও সময় দেখাচ্ছিল আমেরিকার মাউন্টেন জোনের সময়। এবার আমি নিজেই অনুরোধ করলাম জানালার পাশের সীটটার জন্যে। সহযাত্রী সানন্দে ছেড়ে দিল তার নিজের সীট।
জানালার বাইরে রাতের আকাশ। নিকষ কালো অন্ধকার। এদিক সেদিক দুয়েকটা তারা মিটমিট করছে। নীচের দিকে তাকাতে নিশ্চিত হয়ে গেলাম ল্যান্ড করতে যাচ্ছি আমরা।
রাত নেমে এসেছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। স্বরলিপি-হীন এক ধরণের আবেগ এসে মগজে চেপে বসল। যে দেশটার জন্যে সারা জীবন ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই লালন করিনি সেখানেই নামতে যাচ্ছি। জীবন কি জিনিস বুঝে উঠার অনেক আগ হতে বুঝতে শিখেছি একটা জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে শোষণ করছে আরেকটা জাতি। এখানে জন্ম নিয়ে একটা শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে পায় উদ্বাস্তুর তকমা। নিজ গৃহে ওরা পরবাসী। স্বপ্ন-হীন একটা জাতি তিল তিল করে বেড়ে উঠে প্রতিরোধ আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে তামা হয়ে।
আকাশ হতে বুঝার উপায় ছিলনা কোনটা ইসরায়েল আর কোনটা তাদের দখলে থাকা পশ্চিম তীরের প্যালেস্টাইন। আলোর ঝলকানি যাচাই বাছাই করলে হয়ত আন্দাজ করা যেত প্যালেস্টাইনের সীমানা। ওখানে জীবন থাকলেও নেই জীবনের ছন্দ। তাই আলোর ঝলকানি ওখানে প্রত্যাশিত ছিলনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ঠিক মাঝখান হতে।
চলবে।
loading...
loading...
বরাবরের মতো তন্ময় হয়ে পড়ে গেলাম প্রতিটি দাড়ি কমা সেমিকোলন। চলুক …
loading...
"জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৭"
পড়ে যাচ্ছি! শুভকামনা থাকলো।
loading...