জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা... ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৩

272299

২০০২ সালের মার্চ মাস। গোটা প্যালেস্টাইন দাউ দাউ করছে দ্বিতীয় ইন্তেফাদার আগুনে। শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের আগস্ট মাসে। সামনে ইসরায়েলি পার্লামেন্টের নির্বাচন। লিকুদ দলীয় প্রার্থী লেবানন যুদ্ধের কসাই হিসাবে পরিচিত এরিয়েল শ্যরণ দলবল নিয়ে সহসাই জেরুজালেমস্থ মুসলমানদের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে প্রবেশ করেন। দেশটার ইহুদিরাও এই মসজিদের মালিকানা দাবি পূর্বক নিজেদের পবিত্র স্থান হিসাবে গণ্য করে থাকে। তাদের কাছে এ মসজিদ টেম্পল মাউন্ট, এবং মুসলমানদের মতই পবিত্র স্থান। কলফ্লিক্টের শুরু ওখানেই।

প্যালেষ্টাইনিরা গর্জে উঠে। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। সাথে বাড়তে থাকে ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে প্যালেষ্টাইনিদের সুইসাইড মিশন। অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশায় ডুবে যায় ইসরায়েলিদের জীবন। একদিকে মূল ভূখণ্ড, পাশাপাশি প্যালেষ্টাইনি এলাকায় স্যাটেলারদের উপর চলতে থাকে মুহুর্মুহু আক্রমণ। এভাবে চলতে থাকে প্রায় ২ বছর। ততদিনে ক্ষমতায় পোক্ত হয়ে বসেছেন এরিয়াল সারণ।

মার্চের ২৭ তারিখ, ২০০২ সাল। তরুণ এক প্যালেষ্টাইনি বুকে বোমা বেধে ইসরায়েলি শহর নেতনিয়ার পার্ক হোটেলে নিজকে উড়িয়ে দেয়। সাথে নিয়ে যায় ৩০ জন ইসরায়েলি জীবন। দিনটা ছিল ইহুদিদের পবিত্র পাস-ওভার দিন। যারা মারা যায় তাদের প্রায় সবাই ছিল বয়স্ক টুরিস্ট। এরিয়েল সারণ ঘোষণা দেন চরম প্রতিশোধের। রক্তের বদলে রক্ত নেয়ার কঠিন শপথ নেন এই জেনারেল। এর আগে তিনি ১৯৮২ সালের দক্ষিণ লেবানন অভিযানের সময় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে কসাই হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

শ্যরণ কথা দিয়ে কথা রাখেন, তাই বিশ্বের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল কি ঘটতে যাচ্ছে প্যালেষ্টাইনের মাটিতে। পার্ক হোটেল ম্যাসাকারের দুদিন পর মার্চের ২৯ তারিখ ইসরায়েলিরা সেনারা সামরিক অভিযানে ঢুক পরে পশ্চিম তীরে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর এটাই ছিল সবচাইতে ভয়াবহ অভিযান। ইসরায়েলিরা এ অভিযানের নাম দেয় অপারেশন ডিফেন্সিভ শিল্ড।

প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির রামাল্লাস্থ সদর দফতর ও দলটার চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের কার্যালয় অবরোধ করে ফেলে ইসরায়েলি বাহিনী। শুরু হয় প্যালেষ্টাইনিদের উপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। চেয়ারম্যান আরাফাতকে গৃহবন্দী করে চারদিক ট্যাংক কামান দিয়ে আটকে ফেলে রামাল্লায়।

নিউ ইয়র্কের বেইসমেন্টের রুমটায় বসে এসব দেখতে গিয়ে একসময় প্রতিজ্ঞা করি যুদ্ধের শেষ ও অবরোধের অবসান হলে চেয়ারম্যান আরাফাতকে দেখতে রামাল্লায় যাবো।

পুরানো ইচ্ছাটাকে ঝালাই করে সুযোগ খুঁজতে থাকি ইসরায়েল তথা প্যালেস্টাইন যাওয়ার। কিন্তু সে সুযোগ আর আসেনি। ২০০৪ সালে চেয়ারম্যান আরাফাত মারা যান। তার মৃত্যুতেও আছে অনেক বিতর্ক। বলাহয় ইসরায়েলিরা তাকে স্লো পয়জনিং করছিলো। সময় গড়িয়ে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা হতে সরে আসিনি। গন্তব্য ইসরায়েল হয়ে প্যালেস্টাইন।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু যাওয়ার প্লান অনেকদিনের। আমার গিন্নীর জন্মস্থান। পারিবারিক-ভাবে আমাদের পরিকল্পনাটা এরকম; পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ও পেরু সফরে যাওয়া। একবছর পেরু হলে পরের বছর বাংলাদেশ। এভাবেই চলে আসছিল। বাচ্চারাও মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছিল জুলাই’র শেষদিকে নানার দেশে যাওয়ার। সময়টা উত্তর আমেরিকার জন্যে গ্রীষ্মকাল হলেও দক্ষিণ আমেরিকায় তখন শীতকাল।

পেরু সহ দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ ইতিমধ্যে আমি বহুবার গেছি। এ যাত্রায় নতুন করে যাওয়ার আগ্রহটা হারিয়ে ফেললাম বেশকিছু কারণে। প্রথমত; ওটা আমার দেখা দেশ। নতুন কিছু দেখার নেই। দ্বিতীয়ত; ওখানে গেলে ঘরে বসেই কাটাতে হবে ছুটির এক মাস। মা আর মেয়ে মিলে শপিংয়ে যাবে আর বাসায় বসে আমি বাচ্চাদের দেখবো। মন চাইছিল না ছুটিটা এভাবে কাটাতে। শেষমুহুর্তে এসে আমি অস্বীকার করলাম এ যাত্রায় পেরু যাওয়ার। ওরাও অবাক হলোনা। হয়ত মনে মনে ধরে নিয়েছিল আমি যাচ্ছিনা। কারণগুলো অনেক আগেই গিন্নীকে বলেছি। তাই সে অবাক হলোনা।

মার্চের মাঝামাঝি ওরা চলে গেল দক্ষিণের দিকে। আমি যথারীতি কাজে যাই। বাসায় ফিরে সময় কাটাই ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। ধারণটা হঠাৎ করেই মাথায় এলো। এখান হতে চলে যাবো আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনাস আয়ার্সে। সপ্তাহ-খানেক ওখানে কাটিয়ে ফ্লাইট ধরবো আরও দক্ষিণের। একবারে মেরুর কাছের দ্বীপ ইসলাস মালভিনাস’এ। যার ইংরেজি নাম ফকল্যান্ড আইল্যান্ডস।

দ্বীপ নিয়ে ব্রিটিশ ও আর্জেন্টাইনদের যুদ্ধের সময় কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম এর বিচিত্রতার উপর। অনলাইল গবেষণার ম্যারাথন চালিয়ে উপসংহারে আসতে বাধ্য হলাম শীতের সময়টা ওখানে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় নয়। তাছাড়া দ্বীপের ফ্লাইট ধরতে আমাকে যেতে হবে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে। ওখান হতে ইসলাস মালভিনাসে মাসে কেবল দুটো ফ্লাইট। হঠাৎ করে পেরুর রাজধানী লিমায় হাজির হয়ে গিন্নী ও বাচ্চাদের অবাক করে দেয়ার প্লানটা মাঠে মারা যাওয়ায় হতাশ হলাম।

টিকেট আগেই কেনা ছিল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই ওরা চলে গেল। বাচ্চারা একটু অবাক। ইতিমধ্যে ওরা দুজনেই অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে। অনেক পথ-ঘাট মাড়িয়েছে। কিন্তু কোনদিন বাবাকে ছাড়া কোথাও যায়নি। এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে ওদের চোখ ছল ছল করে উঠল। বুঝতে পারলো না কি ঘটতে যাচ্ছে। মন খারাপ দুজনেরই। এক পা আগায় তো দুপা পিছনে ফিরে। এবং তাকিয়ে থাকে। সবারই মন খারাপ। তবে আমি জানতাম ভোরে লিমায় পা রাখা মাত্র যে কোলাহল শুরু হবে। ততক্ষণে ভুলে যাবে বাবার কথা। নানী, নানা, খালা, খালাতো বোনদের ভিড়ে তলিয়ে যাবে বিদায়ের বিষাদ। ডালাস হতে কানেক্টিং ফ্লাইট। আট ঘণ্টার জার্নি। চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম বহির্গমন টার্মিনালে।

হাইওয়ে ধরে বাসায় ফিরতে একধরণের হাহাকার বয়ে গেল পা হতে মাথা পর্যন্ত। গোটা বাড়ি-জুড়ে ভৌতিক নীরবতা। ওদের খেলনাগুলো দেখে কান্না এসে গেলো। ঘন্টাখানেক পর ডালাস হতে ফোনে সবার সাথে কথা হল। ওরা উপভোগ করেছে জার্নি। মন হালকা হয়ে এলো। আগামীকাল শনিবার। অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। অনেকদিন রাত জাগা হয়না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ফেলে আসা পথ ধরে আজ ফিরে যাবো সুখময় অতীতে। এবং রাত জেগে সন্ধান শুরু করবো ইসরায়েল যাওয়ার পথ।

চলবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা... ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৩, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৩-০৩-২০২২ | ২৩:১৭ |

    মুগ্ধকাড়া বর্ণনা আপনার লিখাটিকে অনেক বেশী সৌকর্য্যময় করে তুলেছে স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...