তাসমান পাড়ের গল্প ... শেষ পর্ব

27200

মাঝে মধ্যেই চিন্তাটা মাথায় আসে। মগজের গভীরে ঢুকে কিলবিল করে। কল্পনায় চমকিত হই। আবেগ আপ্লূত হই। কেমন হত যদি ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তগুলোতে পাশে কেউ থাকতো। খুবই আপন কেউ। ভালবাসার কেউ! এমন কিছু নিয়ে মাঝে মধ্যে যে ভাবিনি তা নয়।

মেঘে মেঘে বেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, এক বন্দর হতে অন্য বন্দরে নাও নোঙর করছি অথচ কোথায় যেন কি একটা নেই। হিসাবের শেষে কিছু একটা গোলমাল থেকে যাচ্ছে। বন্ধু শফিউল ও তার স্ত্রী বার বার সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল।

নিউজিল্যান্ডে প্রথম দুদিন ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করেই কাটিয়ে দিলাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে এ সময় গ্রীষ্মকাল। মধ্য গগনে সূর্যের দাপটে কোন কার্পণ্য নেই। তবে নেই প্রখরতা, সবকিছুতে কেমন যেন কোমলতার ছোঁয়া। উপভোগ করার মত ভালোলাগা।

তিনদিনের মাথায় রওয়ানা দিলাম আরও দক্ষিণে। ২২৭ কিলোমিটার দূরে রটোরোয়া নামের এক শহরে। ড্রাইভিং সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা। নেইমসেক লেকের পাড়ের এ শহর তার জিও-থার্মাল এক্টিভিটির জন্যে বিখ্যাত। দেখার মত অনেক কিছু আছে এখানে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে।

272069

মাঝপথে হ্যামিলটন নামের বড় একটা শহর। ওখানে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলাম শহর দেখতে। বেশ বড় শহর। একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ওয়াকাটো নদী। মানুষ আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এ শহরে। মাঝ নদীতে গলফ খেলার ব্যবস্থা আছে। ওখানে কিছুটা সময় ব্যায় করে আবারও নেমে পরলাম রাস্তায়।

অদ্ভুত দেশ এই নিউজিল্যান্ড। চারদিকে থমথমে চেহারার জঙ্গল। মাইলের পর মাইল জনবসতির কোন চিহ্ন নেই। ঝকঝকে রাস্তাঘাট। ভাল করে তাকালে মনে হবে কেউ দিনের পর দিন যত্ন করে আগলে রাখছে সবকিছু। এতকিছু ছাপিয়ে যে ছবি মগজে আঘাত হানে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত। রাস্তা পারা হতে গিয়ে চলমান গাড়ির নীচে চাপা পরে মারা যাচ্ছে বনের পশু। রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চলমান গাড়ির চাকার নীচে চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এই বৈরী সম্পর্ক।

হোটেল আগেই বুক করা ছিল। আহামরি তেমন কিছু না। তবে আধুনিক সভ্যতায় বাস করতে যা লাগে তার কোন অভাব ছিলনা।

হোটেলের বাইরে প্রথম পা রাখতে চোখে পরল অবিস্মরণীয় এসব দৃশ্য। মাটি ফুঁড়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে বাষ্প। কাঠি দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিলে সেখান হতেও বেরিয়ে আসছে।

রাতের খাবার ভারতীয় এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে মোকাবেলা করতে হল অন্য এক অভিজ্ঞতা। রেস্টুরেন্টের মহিলা মালিক আমার পাশের চেয়ারটায় বসে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। এবং সবশেষে প্রস্তাব দিলেন তার রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্যে। রেস্টুরেন্ট চালু রাখার মত লোকবল পাওয়া যাচ্ছেনা এদিকটায়। যে দুজন মাওরি কাজ করে করে তাদের মন-মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা থাকেনা। একদিন আসে তো দুদিন দেখা দেয়না। অথচ ব্যবসা নাকি এখানে খারাপ না।

চমৎকার একটা হাসি দিয়ে এক কিশোরী এসে পাশে বসলো। মালিকের কন্যা প্রমা। স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে। লোক না থাকায় প্রায়ই এখানে আসতে বাধ্য হয় মাকে সাহায্য করার জন্যে।
আমি সিডনির বাসিন্দা এবং ক’মাস পর চলে যাচ্ছি পৃথিবীর আরেক প্রান্তে শুনে বোধহয় কষ্ট পেলেন মহিলা। সামনে আরও একদিন আছি এখানে শুনে প্রমা প্রস্তাব দিল শহর ঘুরে দেখানোর। আমার বন্ধু ও তার স্ত্রীর চোখে অন্যরকম ইঙ্গিত।

পরদিন হোটেল হতে আমাকে উঠিয়ে নীল প্রমা। বাকি কেউ ইচ্ছা করেই যেতে ছিলোনা। আমি মনে মনে হাসলাম এবং কোন কিছু জটিল না করে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম কুড়িয়ে পাওয়া বাস্তবতা।

প্রথম দেখায় মনে হবে হলিউডের ক্যামেরায় আটকে রাখা কোন সিনেমার দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় ধোয়া আর ধোয়া। থার্মাল স্পার্ক মাটি ফুঁড়ে রকেট গতিতে আকাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রমাই নিয়ে গেল হ্যালিপ্যাডের দিকে। ওখানে চাইলেই হেলিকপ্টার ভাড়ায় পাওয়া যায়। মাস-খানেক আগে নাকি এক দুর্ঘটনায় দুজন প্রাণ হারিয়েছে। ধন্যবাদ জানিয়ে হেলিকপ্টারে আমার সহযাত্রী হতে অস্বীকার করলো প্রমা। দুর্ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলাম না। পৃথিবীর এদিকটায় কোনদিন ফিরে আসবোনা, তাই যা দেখার যা ছোঁয়ার সবকিছু উপভোগ করতে চাইলাম।

১৫ মিনিটের জন্যে উড়ে গেলাম রটোরোয়ার আকাশে। পাশে পাইলট কাম ট্যুর গাইড। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। নীচের দিকে তাকালে মনে হবে হাজার বছর আগের অন্য এক সভ্যতায় ফিরে গেছি আমি। চারদিকে ঘন বন, বাষ্পের ধোয়ায় ছেয়ে আছে সবকিছু। চোখ বুজলে মনে হবে নিশ্চয় জুরাসিক পার্কের উপর দিয়ে উড়ছি আমি। নীচে ভালকরে তাকালেই দেখা মিলবে অতিকায় সব ডায়নাসোরদের।

রাতে হোটেলের পাশে একটা খালি জায়গায় BBQ’র আয়োজন হল। আগুন জ্বালিয়ে রাত ২টা পর্যন্ত কাটিয়ে দিলাম ওখানে। পাশেই চমৎকার একটা লেক। রাত হলেও ওখানে মানুষের কমতি ছিলনা। অনেক কপোত কপোতী তাদের ভালবাসা প্রকাশ্যে আনতে কার্পণ্য করছেনা।

রাতটা ছিল খুবই শান্ত। চারদিকে জ্যোৎস্নার প্লাবন। আমরা কোন কথা বলিনি সে রাতে। চুপ হয়ে যার যার মত ফিরে যাচ্ছিল ফেলে আসা অতীতে।

ফেরার পথে হেমিলটনে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও অনেক কিছু দেখা হয়নি। বন্ধু শফিউল ইতিমধ্যে ঘুরে গেছে এ শহর। হাতে সময় ছিল সীমিত। তাই অস্থির হয়ে ছুটতে হয়েছিল এক জায়গা হতে অন্য জায়গায়।

অকল্যান্ড ফিরে দেখতে গিয়েছিলাম গলফ অব হাওরাকিতে চলমান আমেরিকা’স কাপ ইয়ট রেস দেখতে। বন্ধু শফিউলের আরও কজন বন্ধু দাওয়াত দিতে এসেছিল। তার এক রুশ বন্ধুর দাওয়াত অস্বীকার করার উপায় ছিলনা।

এভাবেই কেটে গেল বাকি সময়। এখান হতে ওখানে, এদিক হতে ওদিকে। শেষরাতে আমাদের আড্ডায় তৃতীয় কেউ যোগ দেয়নি। হয়ত ইচ্ছা করেই। পরিবারের বাকি সবাই চাইছিল আমরা দুই বন্ধু নিজেদের জমানো কথা জমানো স্মৃতি কেবল দুজনেই রোমন্থন করি।

অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে বন্ধুর সাথে আলাদা হতে গিয়ে নিশ্চিত ছিলাম সহসাই দেখা হচ্ছেনা আমাদের। অন্তত পৃথিবীর এ প্রান্তে।

27197

নোটঃ ভারতীয় যুবতী প্রমার সাথে পরিচয় ও তার পরবর্তী অনেক ঘটনা সামনে আনলাম না অনেক কারণে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
তাসমান পাড়ের গল্প ... শেষ পর্ব, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৮-০৩-২০২২ | ১৪:০০ |

    ভ্রমণ বিষয়ক আপনার প্রতিটি লিখা যে কোন মাপের পাঠকের মন জয় করে তুলতে সক্ষম। প্রাণঢালা শুভ কামনা স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...