১৯৯৯ সালের শেষদিকেই সব চূড়ান্ত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ভিসার প্যাকেট হাতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম অস্ট্রেলিয়ার থাকা হচ্ছেনা আমার। এ নিয়ে তেমন কোন হায় হুতাশ ছিলনা। প্রথমত, এখানে আপনজন অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলনা। দ্বিতীয়ত, ভাল একটা চাকরির জন্যে তখনও ষ্ট্রাগল করছিলাম।
একদম শেষমুহুর্তে আমেরিকায় প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় গুনে দেখলাম হাতে এখনও নয়টা মাস সময় আছে। অস্ট্রেলিয়ায় ইতিমধ্যে মন উঠে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে যাব। কটা মাস মা’র সাথে কাটিয়ে ফিরে এসে পাড়ি দেব আমেরিকার দিকে।
শাফিউল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। সেন্ট পিটার্সবার্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রুম শেয়ার করেছি। বছরের পর বছর ধরে এক হাড়ি হতে ভাত খেয়েছি। বাংলাদেশে ফিরে এসে একই কোম্পানিতে চাকরি করেছি।
হঠাৎ করেই শফিউল আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে চলে যায় চাকরি নিয়ে। এবং তারপর দেখা দূরে থাক, কোন রকম যোগাযোগও ছিলনা।
সেই শফিউল হঠাৎ করে নিউজিল্যান্ডে হাজির। সপরিবারে মাইগ্রেট করেছে। তাসমানের দুই তীরে দুজন থাকলেও দেখা হয়নি এতদিন। যাই যাই করেও আমার যাওয়া হয়নি। আমেরিকা চলে যাচ্ছি শুনে শফিউল ওর ওখানে ঘুরে যাওয়ার জন্যে শেষবারের মত অনুরোধ করল।
কোথাও বেরিয়ে পরার ওটাই ছিল আমার মোক্ষম সময়। পৃথিবীর এ প্রান্ত একবার ছেড়ে গেলে দ্বিতীয়বার আসা হবে কি-না সন্দেহ ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুরে আসব নিউজিল্যান্ড। হাতে সময় নিয়ে টিকেট কাটলাম যাতে ফিরে এসে চলে যেতে পারি বাংলাদেশে।
১৯৯৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের হিসাবে খ্রিষ্টানদের বড়দিন। চারদিকে উৎসবের আমেজ। বন্ধু শফিউলেরও ছুটি। আমাকে সময় দেয়ার মত যথেষ্ট সময় থাকবে হাতে।
সিডনি হতে অকল্যান্ড। তিন ঘণ্টার ফ্লাইট। সাথে দুই ঘণ্টার সময় পার্থক্য। ঘড়ির হিসাবে ওরা এগিয়ে। বড়দিন তাই আসছিলো এয়ার নিউজিল্যান্ড হয়ত বিশেষ সার্ভিসের ব্যবস্থা করবে। থাকবে হরেক রকম খাবার ও আপ্যায়ন।
তেমন কিছুই ছিলনা ফ্লাইটে। কেবল পাইলটের অভিনন্দন’এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে বিশেষ দিনের বিশেষ আয়োজন। প্রায় ৯০% ফাঁকা সীটের ফ্লাইটে আগে কোনদিন ফ্লাই করেছি কিনা মনে করতে পারলাম না।
নির্ধারিত সময়ের দশমিনিট আগেই ল্যান্ড করল আমাদের ফ্লাইট।
অকল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেহারা দেখে একটু অবাক ও বিমোহিত হলাম। এয়ারপোর্টের প্রায় সব দায়িত্বে দেশটার আদিবাসী মাউরিরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ টোংগা, সামোয়া, ভানোয়াতুর নাগরিকদের মত চেহারার মাউরিদের চিনতে অসুবিধা হয়না। গায়ে গতরে খুবই শক্তিশালী মাউরিরা হাজার বছর আগে তাদের মিথিক্যাল পলিনেশিয়ান হোমল্যান্ড হাওয়াইকি হতে এখানে এসেছিল। গোটা নিউজিল্যান্ড জুড়ে এদের বাস। দেশটার জনসংখ্যার শতকরা ১৪ ভাগ হলেও এয়ারপোর্টে তাদের উপস্থিতি দেখে তা মনে হলোনা।
প্লেনের দরজা হতে বেরুতেই চোখ পরল শফিউলের উপস্থিতি। সপরিবারের অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। বন্ধুর স্ত্রী ইউক্রেইনের নাগরিক। চিনি সেই কৈশোরকাল হতে।
আমরা দুজনেই আবেগী নই। তাই ভেতরের অনুভূতি বাইরে না এনেও অনেক কথা বিনিময় হয়ে গেল। আমরা অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা মুহূর্তের।
ডিসেম্বরের শেষদিকে নিউজিল্যান্ড যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল আমার জন্যে। মিলেনিয়াম অথবা Y2K বাগের জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। কম্পিউটার সফটওয়্যার ২০০০ সালের শেষ দুটা শূন্যের জন্যে প্রোগ্রাম করা না থাকায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে মানব সভ্যতায়, এমন আশংকা করছিল অনেকে। অনেকে অতিরিক্ত খাদ্য, পানি মজুত করে তৈরি হচ্ছিল আপদকালিন সময়ের জন্যে। এ নিয়ে মিডিয়াতেও ছিল প্রচুর হৈ চৈ। ২০০০ সাল ধরণীতে প্রথম পা রাখবে নিউজিল্যান্ড সহ পলেনেশিয়ার বাকি দ্বীপগুলোতে। বিপর্যয় যদি ঘটে তার শুরুটাও হবে ওসব দেশ হতেই। ইচ্ছা ছিল মানব সভ্যতা ভেঙ্গে পরার ঊষালগ্নের সাক্ষী হওয়ার। তাই ইচ্ছা করেই বছরের শেষদিকে পাড়ি জমাই তাসমানের ওপারে।
সে রাতে আমাদের কারও চোখে আসবেনা জানা ছিল। শেয়ার করার মত গল্পের পাহাড় জমে ছিল দুজনের ভেতর। সাথে ছিল ফেলা আসা স্মৃতি রোমন্থন। যে স্মৃতি আমাদের নিয়ে গিয়েছিল ইউক্রেইনের ছোট এক শিল্প শহর হতে রুশ জার-তন্ত্রের রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে। সে তালিকায় আরও ছিল বাংলাদেশের নওগাঁর পত্নীতলা, বদলগাছি ও ধামুইরহাটের অনেক পথ-ঘাট।
বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে BBQ আর পানের আসরে যোগ দিয়েছিল আরও কটা পরিবার। শফিউলের বাড়িটা খোলামেলা জায়গায় হওয়ায় মাঝরাতে গলা খুলে গান ধরতেও কোন বাধা ছিলনা। বন্ধু নিশ্চিত করেছিল সম্ভাব্য শব্দ দূষণের আওতায় আসতে পারে এমন সব বাড়িওয়ালাদের সবাইকে আগাম নোটিশ দেয়া আছে। কেউ মাইন্ড করবেনা।
বড়দিন হতে নিউ ইয়ার, গুনলে এক সপ্তাহের ব্যবধান। এই এক সপ্তাহ চষে বেড়ালাম অকল্যান্ডের সব কোনায়। সফরের দ্বিতীয় রাতে বন্ধুকে নিয়ে গেলাম স্থানীয় কাসিনোতে। কাসিনোর সাথে শফিউলের পরিচয় নেই। ওখানে জুয়া খেলার ব্যাপারে তার সামান্যতম ধারণা ছিলনা।
রুলেট টেবিলে আধাঘণ্টায় ৮০০ ডলার লাভ করে নীরবে বেরিয়ে আসলাম। নিউজিল্যান্ড আসা-যাওয়া সহ সব খরচ এক নিমিষে উঠে এলো। বন্ধু ও তার স্ত্রী হতভম্ব! বুঝতেই পারলো না কি হতে কি হয়ে গেল। চিপস হাতে নিয়ে বিভিন্ন নাম্বারে বসাচ্ছি…রুলেটের চাকা ঘুরছে…আমি আরও চিপস হাতে পাচ্ছি এবং একসময় চিপসগুলো কাউন্টারে জমা দিয়ে কিইউ ডলার হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরা, বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী দুজনের জন্যেই ছিল দুর্বোধ্য।
এবং শেষমেশ হাজির হল সে মাহেন্দ্রক্ষণ! নতুন সহস্রাব্দির ঊষালগ্নে আমরা। টেবিলে খাবার ও পানীয় নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি বড় ধরণের বিপর্যয়ের। ঘড়ির কাটায় বারটা বাজার শেষ ঘণ্টাটা বাজতে দলবেঁধে রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তায় মানুষের ঢল। সবাই সাক্ষী হতে চাইছে ইতিহাসের।
না, কোথাও কিছু ঘটেনি সে রাতে। মানব সভ্যতার একটা চুলেও হাত দিতে পারেনি মিলেনিয়াম বাগ। পৃথিবী যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল সে রাতে। ভয় ভীতি আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষরাতে দিকে ঘুমাতে গেলাম সবাই।
সূর্য উঠার সাথে সাথে কলিং বেলের তীব্র আর্তনাদে ভেঙ্গে গেল কাঁচা ঘুম। আমি ড্রয়িং রুমে তাই আমাকেই খুলতে হল বাসার মুল দরজা।
একদল বাংলাদেশি। সবার মাথায় টুপি ও মুখে দাঁড়ি। বন্ধু শফিউলের সাথে দেখা করতে এসেছে। তার জন্যে তবলীগ জামাতের দাওয়াত নিয়ে এসেছে।
(বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই আপাতত ইতি টানছি। সময়ে পেলে আরও একটা লেখায় শেষ করবো নিউজিল্যান্ড সফরের বাকি অংশ)
loading...
loading...
জীবনের গল্প পড়লাম স্যার। আগামী পর্বের অপেক্ষা থেকে গেলো।
loading...