তাসমান পাড়ের গল্প

2719216

ইউরোপের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে চলুন এবার তাসমান পাড়ের গতিহীন জীবনে ঘুরে আসি। জীবন সেখানে আসলেই অচল। ছবির মত সুন্দর, হিজল তমাল দিঘীর মত শান্ত ও উঁচু উঁচু পাহাড়ের মত নিশ্চুপ ও স্থবির। ইউরোপের কোলাহলময় জীবন অনেক ব্যস্ত। ওখানে গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রেনে চড়ে একদেশ হতে অন্য দেশে যেতে অতিরিক্ত কিছুর দরকার হয়না। চাই কেবল ইচ্ছা ও সময়। কিন্তু তাসমান পাড়ের দুই দেশে আসা যাওয়ার একটাই মাধ্যম, সাগরের উপর ভাসমান মেঘমালার বুক-চিড়ে যাওয়া। চলুন সেটাই করি।

টাইম মেশিনে চড়ে চলুন ফিরে যাই ২২ বছর আগে। ২০০০ সাল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অলিম্পিকের জন্যে তৈরি হচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সবার মত আমিও কাঁপছি সে উত্তেজনায়। ১৯৮০ সালে মস্কোতে যে সুযোগ মিস করেছি এ যাত্রায় তা না করতে ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু হায়, আমি ও আমার দোতারার দুই সুরের গান আবারও অলিম্পিক মিস করা নিশ্চিত করে দিল। সেপ্টেম্বরের শুরুতে অলিম্পিক আর আমাকে আমেরিকায় ঢুকতে হবে একই মাসের ১৫ তারিখের ভেতর। তারিখের হেরফের হলে দেশটায় আমার মাইগ্রেশন প্রসেস ইনভেলিড হয়ে যাবে।

১৯৯৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে কাগজপত্র চূড়ান্ত করে অপেক্ষা করছি মাত্র শুরু হওয়া অস্ট্রেলিয়া জীবনের ইতি টানার। আমার জীবনের যা কিছু ঘটে সবই ঘটে এই সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৯৫ সালের একই মাসে জীবন যুদ্ধের শেষ অধ্যায় লেখার জন্যে হাজির হয়েছিলাম এই দ্বীপে।

অচেনা দেশ। প্রাথমিক সাহায্য পাওয়ার মত কেউ ছিলনা। লাগেজ নিয়ে কোথায় উঠবো তারও কোন ঠিক ছিলনা। অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে যাচ্ছি সিডনি কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে পা রেখেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। তবে এ নিয়ে আমি বিশেষ যে চিন্তিত ছিলাম তা নয়।

অতীতে বহুবার এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। অপরিচিত দেশ, অজানা ভাষার মত বাধা কাটিয়ে ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক প্রান্ত ঘুরে এসেছি। অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি সরকারী স্পন্সরে। স্কিল মাইগ্রেশনের বৈধ কাগজপত্র হাতে। তাই দ্বিধা থাকলেও ভয় ছিলনা। তাছাড়া পকেটে ছিল খরচ করার মত দুই হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড স্টালিং।

মার্টিন প্যালেসের কাছে জর্জ স্ট্রীটের উপর সস্তা এক হোটেলে উঠেছিলাম বাধ্য হয়ে। দুদিন পর ভোজবাজির মত বদলে গেল সবকিছু। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সন্ধান পাওয়ার একদিনের মাথায় দেশটার সোশ্যাল সিকিউরিটিতে নাম লিখিয়ে অন্তত প্রাথমিক খরচের কিছু অংক নিশ্চিত করতে সক্ষম হই। আরও একদিন পর মেডিকেয়ার/মেডিকেইডে তালিকাভুক্ত হয়ে নিশ্চিত করি চিকিৎসা পর্ব। শহরের পুবদিকে প্রথমে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে রেন্ডউইক, পরে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলেসের পাশে কেনসিংটনে এলাকার দিনগুলো ভালই কাটছিল।

চার বছর কেটে যায় সিডনি শহরে। শহরকে নিজের শহর ও দেশকে নিজের দেশ ভাবতে শুরু করছি কেবল। দু’বছরের মাথায় নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পাওয়ায় নিশ্চিত হয়ে যাই এই শহর এ দেশই হতে যাচ্ছে আমার শেষ ঠিকানা।

গোলমাল বাধে অন্য জায়গায়। মারুবার এনজাক পেরেডের উপর একটা ফ্লাটে থাকি। ফ্লাট-মেট হিসাবে বন্ধু পাভেল যোগ দিয়েছে কেবল। ইংল্যান্ডে এমবিএ করা পাভেল নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিতে কম্পিউটার সাইন্সে কি একটা কোর্স করতে দেশ হতে এসেছে কেবল। আমার মত অনেক ঘাটে পোড় খাওয়া পাভেলের সাথে সম্পর্কটা ফ্ল্যাট-মেট হতে বন্ধুত্বে রূপ নিতে সময় লাগেনি। দুজন দুদিকে কাজ করি। পাশাপাশি ইউনিতে দৌড়ায় পাভেল। দুজনের জীবন বয়ে চলছে অনেকটা নদীর মত।

আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে এসেছি। পাভেল এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। কোর্সের শেষদিকে এসে চিন্তাটা তাকে চেপে ধরল। দেশে ফেরার ইচ্ছা ছিলনা তার।

ক্লাস হতে ফিরে খাবার টেবিলে বসে সংবাদটা দিল। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ আমেরিকা তার দেশে প্রতিবছরের মত এবারও ডিভি লটারি অফার করছে। পাভেল ইউনির লাইব্রেরি হতে প্রিন্ট করে এনেছে দুটো ফর্ম। একটা তার ও অন্যটা আমার জন্যে। নিজে পূরণ করে কেবল আমার সই নিয়ে নিজেই পোস্টে পাঠিয়ে দেয় ডিভি দরখাস্ত। খুব দ্রুতই ভুলে যাই এমন একটা কাজ আমরা করেছিলাম।

কোর্স শেষ করে পাভেল দেশে ফিরে যায়। আমিও মন দেই আমার কাজে। ইতিমধ্যে বেশকিছু স্বদেশীর সাথে পরিচয় হওয়ায় জীবন আরও সহজ হয়ে যায়। মাছে-ভাতের একজন বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান হওয়ার লড়াই শুরু করি সর্বশক্তি দিয়ে।

হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস হতে একটা খাম পেয়ে অবাক হয়ে যাই। কারণ ততদিনে স্মৃতি হতে মুছে গেলে ডিভি পর্ব।
খাম খুলে হতভম্ব! আই এম আ উইনার।

আগামী পর্বে সমাপ্ত।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
তাসমান পাড়ের গল্প, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৪-০৩-২০২২ | ১৯:৪৯ |

    প্রথম পর্বেই অভিনন্দন জানিয়ে রাখলাম স্যার। চলুক। Smile https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...