ভালই ছিল নিউ ইয়র্কের জীবন। ব্যস্ততা ও অলসতার মাঝে যে কোন একটা বেছে নিতে কোন বাধা ছিলনা। ছিলনা ঘরে ফেরার তাগাদা। না ছিল কোন পিছু টান। আমার রাজত্বে আমিই ছিলাম রাজা।
থাকি উডসাইডের একটা বাসায়। বাসার বেইসমেন্টে দুটো রুম থাকলেও বাড়িওয়ালা একটা রুম আমাকে দিয়ে বাকি রুমটা ভাড়া দেননি অন্য কারণে। মাঝেমধ্যে জুয়ার আসর জমতো ওখানে।
বাড়িওয়ালা বাংলাদেশি। নিজে ইয়োলো ক্যাব চালাতেন। আসরে যারা আসতো তারাও ছিল মেগা শহর নিউ ইয়র্কের পরিশ্রমী বাংলাদেশি ক্যাব ড্রাইভার। কাজের ফাঁকে জুয়ার আড্ডা আমার জন্যে নতুন কোন ঘটনা ছিলনা। অনেকে সপ্তাহে ছয়দিন গাড়ি চালাত। দৈনিক ১৫/১৬ ঘণ্টা কাজের পর এটাই ছিল তাদের একমাত্র বিনোদন।
এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ ছিলনা। কারণ আসর জমত মাসে দু’একবার। বাকি দিন আমি একা। কাজে যাই, বাসায় ফিরি, রান্না করি এবং দিনশেষে বিছানায় যাই নতুন একটা দিনের প্রত্যাশায়।
কাজ করি কুইন্স বুলোভার্ডের উপর একটা ষ্টোরে। পেশায় সেলসম্যান। আমেরিকায় প্রথম কাজ। শুরু হিসাবে মন্দ ছিলনা। যা আয়-রোজগার তা দিয়ে জীবন চলে যায়। রেগো পার্কের ঐ এলাকাটা মূলত রুশ, হিস্পানিক ও আমাদের উপমহাদেশের ইমিগ্রেন্টদের বাস।
ইংরেজির দৌড় প্রায় সবারই সীমিত। এবং চাকরিতে এটাই ছিল আমার এডভান্টেজ। আমার স্থায়ী কোন বেতন ছিলনা। আয়ের সবটাই আসত বিক্রির উপর কমিশন হতে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দুর পাশাপাশি রুশ ভাষাতেও ছিল যথেষ্ট ভাল দখল। ইউরোপের ১২ বছরের সবটাই কাটিয়েছি রুশ দেশে।
দুর্বল ইংরেজি সহ গ্রাহকদের সবাই চাইতো নিজ ভাষায় কথা বলতে। কাজ চালানোর মত স্প্যানিশ খুব দ্রুতই শিখে নেই মোটা দাগের হিস্পানিকদের কাছে টানতে। এভাবেই চলে যাচ্ছিল জীবন। এক বছর, দু’বছর, তিন বছর, একে একে ছ’বছর।
কাজেই পরিচয় হয় ওদের সাথে। নরমা, আয়ানা, অসমার, জুলিসা, শ্যরন, লুইস সহ আরও অনেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে ওরা অথবা ওদের পূর্ব পুরুষেরা এসেছে। নতুন করে জীবন গড়ছে ইমিগ্রান্টদের দেশ আমেরিকায়।
জীবন নিয়ে ওদের সবারই একটা গল্প আছে। সে গল্পের পরিধি নিউ ইয়র্ক ছাড়িয়ে চলে যায় কলোম্বিয়া, পেরু, জ্যামাইকা, গায়ানা, ত্রিনিদাদ টবাগো সহ পৃথিবীর অনেক দেশে। দিনের পর দিন একসাথে কাজ করতে গিয়ে একে অন্যের গল্প শুনেছি। পরস্পরকে জেনেছি। জীবনের সাথে মিশে গেছি। বেরিয়ে পরার ইচ্ছাটার জন্ম বোধহয় ওখানেই।
পেরুর মাচুপীচু দেখার ইচ্ছাটা ছিল অনেকদিনের। সোভিয়েত দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিল পেরুর ইসাবেলা। এক সময় আমাদের জানা-শুনাটা ইন্টিমেসি পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তার কাছেই গল্প শুনেছি এন্ডিস পর্বমালার। শুনেছি ইনকাদের লুকানো শহর মাচুপিচু্র কাহিনী। ইচ্ছেটা তখনই মগজে গেঁথে গিয়েছিল।
তবে সে ইচ্ছাটা ছিল অনেকটা স্বপ্নের মত। কোনদিন আলোর মুখ দেখবে আশা করিনি। মাচুপিচুর উচ্চতা জয় করার বাধাগুলো সহজ ছিলনা। প্রথমত, বাংলাদেশি পাসপোর্টে পৃথিবীর অনেক দেশই ভিসা দেয়না। আর আর দিলেও তাতে থাকে চলাফেরায় অনেক বিধি নিষেধ। আর্থিক সীমাবদ্ধতাও ছিলই।
আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করি বাংলাদেশির পাশাপাশি আমি ছিলাম একজন অস্ট্রেলিয়ান। দেশটার পাসপোর্ট আমাকে দিয়েছিল প্রায় পৃথিবীর সব দেশে প্রবেশ করার বৈধতা। এবং সুযোগটা কাজে লাগাতে আমি লম্বা সময় অপেক্ষা করিনি।
নিউ ইয়র্কের শুরুটা জন্যে ছিল ঘটনাবহুল। পেনসেলভ্যানিয়ার ফিলাডেলফিয়া হতে এ মেগা শহরে প্রথম যেদিন পা রাখি আমেরিকার ধূসর ইতিহাস ৯/১১’র বয়স মাত্র চার দিন। শহর জুড়ে শোকের স্তব্ধতা। কেবল নিউ ইয়র্কই নয়, গোটা আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা গ্রাস করে নিয়েছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। জীবন শুরু করার জন্যে সময়টা ছিল খুবই কঠিন। তাই শুরুর জন্যে কমিশন ভিত্তিক চাকরিটা নিয়ে কোন অভিযোগ ছিলনা।
-চলবে।
loading...
loading...
নতুন একটি পথে আপনার সাথে আমরা পাঠক … রওয়ানা হলাম। চলুন স্যার।
loading...