বিকেলে ভোরের গল্প ... শেষ পর্ব

2714379

বরাবরের মতই ব্রিটেনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। প্রথম দেখায় মনে হবে নিশ্চয় বর্ষাকাল এখন। উত্তর সাগর হতে মেঘমালা সহসাই উড়ে এসে ভিজিয়ে দেবে সবকিছু। শরীর হয়ে ধুয়ে মুছে ফেলবে লম্বা জার্নির ক্লান্তি।
এ ধরণের আবহাওয়া টিপিক্যাল ব্রিটেনের জন্যে। যতবার এ দ্বীপপুঞ্জে এসেছি ততবারই মেঘাচ্ছন্ন সকাল স্বাগত জানিয়েছে। তাই অবাক হইনি এ যাত্রায়। বিষণ্ণতায় ভরা এ সকাল যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবেনা সেটাও জানা ছিল। কারণ মেঘের ওপাশেই আধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদ।

দশটা বাজার সাথে ভোজবাজির মত বদলে যায় সকালের বিষণ্ণ চেহারা। কুয়াশার চাদরে মোড়া উত্তর সাগর জেগে উঠবে ঘুম হতে। বাস, ট্রেন আর ফেরী গুলো কানায় কানায় ভরে উঠে পর্যটকদের পদভারে।

ব্যস্ততা বাড়ছে ইমিগ্রেশন বুথ গুলোতে। কাঁধে ব্যাক-প্যাক আর হাতে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এগুচ্ছে ওদিকে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ গুলোর জন্যে আলাদা একটা লাইনের ব্যবস্থা আছে। তুলনামূলক কম ভিড় থাকে ওখানটায়। যেহেতু বাংলাদেশ কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ তাই ওখানেই আমাদের লাইন ধরতে হয়।

পাসপোর্টের পাতাগুলো এদিক সেদিক করে কোন প্রশ্ন না করেই ৬ মাসের ভিজিটির ভিসা ইস্যু করে স্বাগত জানাল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে। হালকা একটা হাসি দিয়ে আমিও ধন্যবাদ জানালাম।

ইমিগ্রেশন ঝামেলা বলতে যা বুঝায় তা প্রথমবার এ দেশে প্রবেশ করার সময় সেরে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার এ নিয়ে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

অতিরিক্ত কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল সে যাত্রায়। নিজের ব্রিটেন ভ্রমণকে জাস্টিফাই করতে হয়েছিল। কেন এসেছি, কোথায় থাকবো, কতদিন থাকবো এসব প্রশ্নের উত্তর সাবলীলভাবে দেয়ার পর গুনে ২ মাস ১০ দিনের ভিসা দিয়েছিল। পকেটে ১০ ডলার নগদ নিয়ে টুরিস্ট হিসাবে এ দেশে ঢোকা নিমিষেই বানচাল হয়ে যেত যদি ইমিগ্রেশন আমার ওয়ালেট পরখ করতে চাইতো।

তেমন কিছুই করেনি। আমি সোভিয়েত দেশে সরকারী স্কলারশিপে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি এবং আমার ডিগ্রীলাভ ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার চাইতেও অনেক জরুরি এটাই ছিল আমার ডিফেন্স আর্গুমেন্ট।

ইমিগ্রেশন হতে বেরিয়ে রেল ষ্টেশনে এসে ভাবনায় পরে গেলাম। এখনও অনেক সকাল। কাউকে ফোন করে ঘুম ভাঙ্গানোর সময় হয়নি। বন্ধু হাসানকে ফোন না করে লন্ডনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আবারও ট্রেন ধরতে হবে। এ যাত্রায় ব্রিটেনের আন্তঃশহর ট্রেন। এসেক্সের হারউইচ হতে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশন।

দেড় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। জানালার পাশে বসলে ব্রিটেনের কান্ট্রি সাইড খুব কাছ হতে দেখা যায়। ছোট ছোট উপশহর, ফসলের মাঠ, কাউবয়দের ক্যাটেল নিয়ে ব্যস্ততা, সবকিছু মগজে আটকে যায় স্থায়ী স্মৃতি হিসাবে।
সকালের লোকাল ট্রেন। বলতে গেলে খালিই ছিল যাত্রার শুরুতে। কিন্তু ঘাটে ঘাটে থামার কারণ যাত্রীদের ভিড় বাড়তে শুরু করল। এ পথেই যে অনেকে চাকরি করতে লন্ডন যায় তার আলামত সবখানে। আমার উদ্দেশ্য একই। তবে পার্থক্য হচ্ছে, চাকরি করার আগে তার সন্ধান করতে হবে।

লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে নেমে হাতের ব্যাক-প্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে প্লাটফর্মের এক কোনায় শুয়ে পরলাম। আমার মত আরও অনেকে একইভাবে সময় কাটাচ্ছে। দশটা বাজার আগ পর্যন্ত বন্ধু হাসানকে ফোন না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ও অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। সকালে বিছানা ছাড়ে অনেক দেরী করে।

শুয়ে শুয়েই ফিরে গেলাম একই ষ্টেশনের এক ঘটনায়। বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। ব্রিটেন তখন লণ্ডভণ্ড আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির হুমকিতে। যত্রতত্র বোমা ফুটছে। আকাশে বাতাসে ভয়ের রাজত্ব। রাস্তা-ঘাট, বাজার-বন্দর, ষ্টেশনগুলোতে পুলিশদের অতিরিক্ত নজরদারি। সাথে কেডাবরা ডগ। সন্দেহ হলেই পুলিশ আটকে দিচ্ছে অনেক কিছু।

প্রতিবারের মত সেবারও লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে বসে অপেক্ষা করছি বেলা গড়ানোর। দশটা বাজার সাথে সাথে হাতের ব্যাক-প্যাকটা বাইরে রেখে ঢুকে গেলাম পাশের টেলিফোন বুথে। একটা পর একটা নাম্বার ডায়াল করে চালিয়ে গেলাম চাকরি সন্ধানের কাজ। মূলত সিলেটী ভাইদের রেস্টুরেন্টের কাজই ছিল আমার মূল টার্গেট। বেশকিছুটা সময় টেলিফোন বুথে কাটিয়ে বাইরে আসতে চোখ ছানাবড়া। পুলিশ!

একগাদা পুলিশ ঘিরে রেখেছে আমার ব্যাক-প্যাক। ক্যডাবরা ডগের সাহায্য নিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আমি কাছে আসতে চীৎকার করে আদেশ দিল যেখানে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার। আমি একেবারেই বোবা। কোথা দিয়ে কি শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুলিশই বা কেন আমার ব্যাক-প্যাক ঘিরে রেখেছে তার আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারলাম না।

একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল ব্যাগটা আমার কিনা। স্বীকার করতে আমাকে ঘিরে ফেললো। জানতে চাইলো কি আছে ব্যাগে এবং কেন আমি এক ঘণ্টার উপর একে বাইরে ফেলে রেখেছি।

সোভিয়েত দেশের টুরিস্ট আমি। ব্যাগ বাইরে রেখে ফোনে বন্ধুদের সন্ধান করছিলাম এতক্ষণ। অনেক কষ্টে বুঝানো গেল। ব্যাক-প্যাকে বিস্ফোরক কিছু নেই এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে খুলে বলল ঘটনা প্রবাহ। মালিকানা না থাকায় কেউ একজন পুলিশে ফোন করেছিল। পুলিশের সন্দেহ হয়ত আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ব্যাগ ভর্তি বিস্ফোরক রেখে গেছে বড় ধরণের নাশকতার অংশ হিসাবে।
আমাকে খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার হওয়ার পর পুলিশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। প্রস্তাব দিল আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার। ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাক-প্যাক গুটিয়ে বিদায় জানালাম লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনকে। উৎসুক জনতার অনেকে আমার দিয়ে তাকিয়ে আই এর এ’র চেহারায় দেখছিল।

ষ্টেশনের ঘড়ির কাটা ততক্ষণে ১০টায় পৌঁছে গেছে। বন্ধু হাসানকে ফোন করার সময় হয়েছে।

জানতাম ও রাগ করবে আমার হঠাৎ আগমনে। গেলবার কথা দিয়েছিলাম পশ্চিম বার্লিন নেমেই ওকে ফোন করবো এবং ও আমার জন্যে হারউইচ ষ্টেশনে অপেক্ষা করবে।

যেখানে আছি সেখান হতে এক পা না নড়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধু হাসান রওয়ানা দিল আমার সন্ধানে।

– শেষ।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিকেলে ভোরের গল্প ... শেষ পর্ব, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০৩-২০২২ | ১৩:০৪ |

    ধারাবাহিকে ভ্রমণের এমন অসাধারণ অভিজ্ঞতার সম্মিলন সচরাচর দেখা যায় না। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...