বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১৩

271204

ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে হ্যানোভারের আকাশ। শহরের বাতিগুলো জানান দিচ্ছে রাত নামছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। গ্রীষ্মের রাত এদিকটায় এমনিতেই ছোট। নৈশ জীবনের সবটুকু নিংড়ে নিতে ভিড় জমছে শুঁড়িখানায়, ডিস্কো সহ বিনোদনের সবকটা ভেনুতে। ট্রেনের জানালায় বসে এসব দৃশ্যও চোখ এড়ায় না।

প্ল্যাটফর্মের মাইক্রোফোনে Hook Van Holland গামী ট্রেনের ডিপার্টাচার ঘোষণা আসতে ভাল করে দেখে নিলাম সহযাত্রীদের। অনেকটা সময় কাটাতে হবে ওদের সাথে। অস্বাভাবিক আচরণের কেউ থাকলে গোটা জার্নিটা হতে পারে নরক যাত্রার অভিজ্ঞতা।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাত্রীদের চেহারায় তেমন কারও ছায়া পাওয়া গেলনা। সবাই মালামাল গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে নিজেদের গন্তব্যের জন্যে।
সহযাত্রীদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সংক্ষিপ্ত দূরত্বের যাত্রীরা দিনের আলোতেই নিজেদের ভ্রমণ সেরে নেয়। কেবল আমার মত যারা শহরের পর শহর, দেশের পর দেশ পাড়ি দিয়ে অন্য এক দেশে পাড়ি জমায় তারাই চেপে বসে রাতের ট্রেনে।

দুটো সীট পরেই মাত্র পরিচয় হওয়া দুই তরুণীকে দেখলাম নিজেদের ব্যাক-প্যাক হতে বালিশ বের করে তৈরি হচ্ছে লম্বা জার্নির। সময় গড়ানোর সাথে দুই জনের পরিচয় আবিষ্কার করতে অসুবিধা হলোনা। ওরা সমকামী। একজনের চুল পুরুষদের মত ছোট করে কাটা। শরীর যতটুকু দেখা যায় তার সবটা ঢেকে আছে উল্কিতে। বাকি-জনও পিছিয়ে নেই। পোশাকের ব্যপারে দুজনের কারোই কোন রাখঢাক নেই। হিসাব করলে দেখা যাবে শরীরের ৭০ ভাগেই কোন পোশাক নেই। নিজেদের যৌন আচরণ বাইরে আনার জন্যে এতক্ষণ মুখিয়ে ছিল। ট্রেন ছাড়তেই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল নিজেদের ভালবাসা সামনে আনতে।

চাইলেও এসব উপেক্ষা করা যায়না। বিশেষকরে আমার মত যারা পূর্ব ইউরোপের রক্ষণশীল সমাজ হতে এদিকটায় আসে। পৃথিবীর সব দেশে সবকালে সমকামীরা ছিল। শতাব্দীর শুরুতে নিজেদের পরিচয় গোপন করায় সামাজিক বাধ্য বাধকতা থাকলেও পৃথিবী এখন অনেক উন্মুক্ত। এসবের অস্তিত্ব এখন আমাদের চারদিকে।

অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেছে বাইরের পৃথিবী। সাথে হাল্কা কুয়াশা। চলমান বাতিগুলো ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনা ভেতর হতে। সাথে দু’তিনটা বই এনেছিলাম রাস্তায় পড়ব বলে। দস্তায়েভস্কির ‘преступление и наказание (ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট)’ বইটা আগেও পড়েছি। রুশ ভাষায় প্রথমবার পড়ার পর সেই যে প্রেমে পড়েছি আজও তা শেষ হয়নি। সময় কাটানোর হাতিয়ার হিসাবে বইটাকে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করি।

পড়ার মত যথেষ্ট আলো ছিলনা ট্রেনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠিয়ে রাখতে বাধ্য হলাম। খিদা লাগতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। ব্যাগে খাবার যা অবশিষ্ট ছিল তা খেয়ে আবারও বাইরের দিকে চোখ ফেরালাম। হঠাৎ মনে হল ট্রেনের গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সামনে থামার মত ষ্টেশন না থাকলে গতি বেড়ে যায়, ব্যপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। সামনের সীটে কেউ না থাকায় পা উঠিয়ে আরাম করে বসে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ মনে হল ঘুম আসছে আমার।

…… শতাধিক যাত্রীর অনেকে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকছে অনেকে। সহযাত্রীদের ঘুমের তোয়াক্কা না করে অনেকে কথা বলছে উঁচু স্বরে। দল বেঁধে কেউ কেউ তাস খেলছে। অনেকে নাকে নস্যি নিচ্ছে একটু পরপর। ফেরিওয়ালারা পণ্যের পসার সাজিয়ে দলে দলে হাঁক দিচ্ছে।

…… সাপের মত একে-বেঁকে এগিয়ে চলছে ট্রেন। থর থর করে কাঁপছে সবকিছু। ঘুমাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আগে কখনও মোকাবেলা করেছি মনে করতে পারলাম না। হাতের ব্যাগটা সীটের ডাণ্ডার সাথে তালা চেইন দিয়ে আটকেও নিশ্চিত হতে পারছিনা নিরাপত্তার। হাওড়া ষ্টেশনে এক ফেরিওয়ালা বাধ্য করেছিল এসব কিনতে। এ পথে জার্নি করতে গেলে এসব নাকি বাধ্যতামূলক। কোলকাতা হতে ওড়িশার পূরী যাচ্ছি। লম্বা অন্তহীন পথ। বরাবরের মত আমি একা। কথা বলার কেউ নেই। …শোয়ার ভান করে উপরের দিকে তাকিয়ে ট্রেনের ঝং ধরা ছাদ দেখছি কেবল। দেখছি আর প্রহর গুনছি কবে শেষ হবে এ নরক যাত্রা।

ব্রেকের কড় কড়া আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। স্বপ্ন দেখছিলাম আমি।

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতরে যাত্রীদের প্রায় সবাই ঘুমাচ্ছে। বগির মূল বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে কেউ। কিছুটা চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল যাত্রীদের মাঝে। বাইরে ইমিগ্রেশন পুলিশদের আনাগোনা জানান দিল সীমান্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছি আমরা। এ যাত্রায় পশ্চিম জার্মানি হতে নেদারল্যান্ড। পকেটে হাত দিয়ে আবারও পাসপোর্টের অস্বিত্বটা পরখ করে নিলাম।

চলবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১৩, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২০-০২-২০২২ | ৯:২২ |

    বিমুগ্ধ পাঠ। শুভ কামনা রইলো স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২১-০২-২০২২ | ১২:১১ |

      অনেক ধব্যবাদ সাথে থাকার জন্যে

      GD Star Rating
      loading...