বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১২

271200

চলন্ত ট্রেনে বসে বাইরের দিকে তাকালে মনে হবে ট্রেন নয়, যেন বাইরের পৃথিবীটাই ছুটছে। বাড়িঘর, মাঠ ঘাট, গাছপালা সবকিছু ক্ষণিকের জন্যে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখায়। পড়ন্ত বিকেলের দৃশ্যপট হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর নিপুণ কোন শিল্পকর্ম।

সূর্যের রক্তিম আভা আছড়ে পরছে ফসলের মাঠে। কৃষকরা ঘরে ফিরছে তাদের ট্রাক্টর নিয়ে। কাউবয়রা শেষবারের মত সেরে নিচ্ছে ক্যাটেল হেড কাউন্ট। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে থেমে আছে একাধিক গাড়ি। নিভু নিভু আলোতেও মাঠে ফুটবল খেলছে অনেকে। শিশু কিশোরের দল বাইক নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে। হয়ত ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল ফিরে যাচ্ছে তাদের কুলায়।

এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি। হকার টাইপের কেউ একজনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুকনা জাতীয় কিছু খাবার ও কোল্ড ড্রিংকস বিক্রির চেষ্টা করছে। আমার মত যারা বার্লিন হতে উঠে হ্যানোভার অথবা নেদারল্যান্ডস’এর রোটরড্রামে যাচ্ছে তাদের কেউ কেউ সাড়া দিচ্ছে হকারের ডাকে। লম্বা জার্নি। খাবার না কিনলেই নয়।

পূর্ব ইউরোপিয়ানদের সাথে পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের এই পার্থক্যটা খুব প্রকট হয়ে ধরা পরে। বিশেষকরে ট্রেন অথবা বাসের লম্বা জার্নিতে। মহাদেশের পূবের দিকের মানুষ যেখানেই যাক ভ্রমণের সময় তারা ঘরে তৈরি নিজেদের খাবার বহন করবেই।

সোভিয়েত, পোলিশ অথবা চেকদের ভ্রমণ ব্যাগের অপরিহার্য অংশ শুকনো খাবার। রুটি, সালামি, শুকরের বেকন সাথে মাখন এবং সবশেষে পানীয় হিসাবে মগ ভর্তি গরম চা।

মা তার সন্তানকে অথবা স্ত্রী তার স্বামীকে যখন বিদায় দেয় সাথে দেয় জার্নির পুরোটা সময় চালিয়ে নেয়ার মত যথেষ্ট খাবার। ওরা নিজেদের খাবার সদ্য পরিচিত সহযাত্রীদের বিনা দ্বিধায় অফার করতে অভ্যস্ত।

পশ্চিম ইউরোপিয়ানরা তাদের পূব দিকের সগোত্রীয়দের এসব সংস্কৃতির ধারে কাছেও যায়না। ঘরে রান্না করা খাবার কেউ ট্রেনে খেয়েছে এমন দৃশ্য বিরল। বরং এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টায় কাটিয়ে দেয় এমন যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। মাঝপথে কোথাও থামলে ষ্টেশন হতে একটা স্যান্ডউইচ ও এক বোতল পানিই তাদের শেষ সম্বল। এর অতিরিক্ত কিছু কিনলে যাত্রীর পশ্চিম ইউরোপীয় আইডেন্টিটি নিয়ে প্রশ্ন তুললে অন্যায় হবেনা।

হ্যানোভার। পশ্চিম জার্মানির বেশ বড় একটা শহর। রেল নেটওয়ার্কের বড়সড় একটা হাব। ১৫/২০ মিনিটের যাত্রা বিরতি এ শহরে। একই ট্রেন ধরে বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন শহরে যাওয়ার শুরুটা হয় এখানেই। এ যেন বিমানের কানেক্টিং ফ্লাইটের মত। ইউরোপের বিভিন্ন কোনা হতে দলে দলে ট্রেন আসে। এক ট্রেনের বগি অন্য ট্রেনে লাগিয়ে চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে।

পৃথিবীর আর দশটা ট্রেন ষ্টেশনের মতই হ্যানোভারের ব্যস্ততা। মিনিটে মিনিটে ট্রেন আসছে এবং পাশাপাশি ছেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের ভিড়ে গিজ গিজ করছে প্লাটফর্ম। নিজদের ট্রেনের সন্ধানে যাত্রীরা এক প্লাটফর্ম হতে অন্য প্লাটফর্মে দৌড়চ্ছে। দম দেয়া পুতুলের মত ঝট করে উঠে পরছে ট্রেনে এবং তাৎক্ষণিক ভাবে মিশে যাচ্ছে যাত্রীদের মিছিলে। বিমানবন্দরের মতই ভারী গলায় দফায় দফায় ঘোষণা আসছে ট্রেনের এরাইভেল ও ডিপার্টচারের বিবরণ।

গ্রীষ্মকাল বলেই হয়ত ভিড়টা একটু বেশি। আমার মত লন্ডনের দিকে কারা যাচ্ছে তা হোক ভ্যান হল্যান্ড পর্যন্ত না গেলে বুঝার উপায় নেই। তবে আমার সহযাত্রী একদল স্প্যানিশ কিশোরীদের ভাবা-সাব দেখে মনে হল ওরা ওদিকে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের ছুটিতে স্পেন হতে অনেকে কলেজ ইউনির ছাত্র ছাত্রী ব্রিটেনের দিকে যায় সামার যবের জন্যে। লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডের অনেক বার রেস্তোরায় ওদের কাজ করতে দেখেছি। দু’য়েক জনের সাথে পরিচয় হয়নি তাও নয়।

আসলে সবকিছুতেই কেমন যেন একটা ছুটির আমেজ। কি মানুষ কি প্রকৃতি কোন কিছু বাদ নেই। সাথে কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন সুখের ইঙ্গিত। দেশ, জাতি, ভাষা অথবা সংস্কৃতি কোন কিছুই বাধা হয়ে নেই সুখের এ মেঠো পথে। আপাদমস্তক শরীর ঢেকে আরব মহিলার পাশাপাশি শরীর উন্মুক্ত করার তীব্র প্রতিযোগিতায় মত্ত ললনারাও চলছে সুখের সন্ধানে। এক ষ্টেশনে উঠে পরের ষ্টেশনেই নেমে পরছে অনেকে। অনেকে আবার সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে দূর দূরান্তে।

পূর্ব বার্লিন হতে হতে কেনা কিছু শুকনো খাবার ছিল সাথে। সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে আনা ছোট ফ্লাক্সটাও ভর্তি করে নিয়েছিলাম কালো কফিতে। পেট চো চো করছিল ক্ষুধায়। হ্যানোভারের বিরতিতে গোগ্রাসে গিলে মগটা হাতে নিয়ে সামনে সীটে পা উঠিয়ে বেশ আয়েশ করেই প্রস্তুতি নিলাম জার্নির পরের অংশের।

মহাশয়, এই ট্রেনটা কি হোক ভ্যন হল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে?’
জিনসের সংক্ষিপ্ত শর্টস পরা দুজন তরুণী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল আমার দিকে।
আমি নিশ্চয়তা দিলাম ওদিকেই যাচ্ছি আমরা।

চলবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১২, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৩-০২-২০২২ | ২১:৫২ |

    মন্ত্র মুগ্ধ পাঠ। বরাবরের মতো শুভ কামনা রইলো স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...