বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১১

2710576

ঝামেলা পিছনে ফেলে Hook Van Holland গামী ট্রেনটায় চেপে বসতে মাথা হতে পাহাড় সমান কিছু একটা নেমে গেল যেন। নিঃশ্বাসে অক্সিজেনের মাত্রাও যে বেড়ে গেছে তা টের পেতে অসুবিধা হলনা।

লন্ডন পর্যন্ত জার্নিতে আমার আর কোন বাধা নেই। উপলব্ধিটা স্বস্তির আবেশ ছড়িয়ে দিল গোটা শরীরে। যদিও হারউইচ পোর্টে চাইলে বিনা কারণে ব্রিটিশরা আমাকে আটকে দিতে পারে। তবে গেল ১১ বছরে তারা এমনটা করেনি। এ যাত্রায় তেমন কিছু করার কারণ ছিলনা।

সব দেশের মত ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনেরও লক্ষ্য থাকে টুরিস্ট ভিসায় কেউ ব্রিটেনে ঢুকে ফিউজেটিভ হয়ে যায় কিনা। আমার পাসপোর্ট সাক্ষী দেবে এ ব্যপারে আমার স্বচ্ছতা।

পশ্চিম জার্মানি ও বেনেলাক্সের ২৪ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা পৃথিবীর এ অঞ্চলে স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তাও ছিল স্বস্তি-দায়ক। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট অনেক দেশে এন্ট্রি ভিসা পাওয়া যেত। কিন্তু অবৈধ অভিবাসীদের বিরামহীন ইন-ফ্লাক্স ততদিনে বদলে দিয়েছে অনেক সমীকরণ।

পূর্ব জার্মানির ভিসা অনেকদিন পর্যন্ত ছিল সহজলভ্য (অন এরাইভেল)। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে স্বদেশীদের অনেকে পূর্ব বার্লিন হয়ে পাড়ি জমিয়েছিল পশ্চিম জার্মানির অনেক শহরে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট বেশ ক’বছর ধরেই কালো তালিকাভুক্তির প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছিল ইউরোপের অনেক দেশে। এ নিয়ে অনেক দেশের মিডিয়া ডকুমেন্টারি তৈরি করে তুলে দিয়েছিল পশ্চিমাদের শয়নকক্ষে। স্বভাবতই জন্ম নিয়েছিল ভয় ও এক ধরণের ঘৃণা।

বগিটায় ৩/৪ জন যাত্রী ছাড়া বাকি সব আসন ছিল শূন্য। তবে অবস্থা যে এমনটা থাকবেনা তা পরবর্তী ষ্টেশনে থামলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে।

গ্রীষ্মের এ সময়টা গোটা পশ্চিম ইউরোপ হুমড়ি খেয়ে পরে একটুখানি স্বস্তির সন্ধানে। স্কুল কলেজ ছুটি থাকার সুবাদে মা-বাবাও বেরিয়ে পরে তাদের বার্ষিক ছুটিতে। চারদিকে থাকে উৎসবের আমেজ। এ আমেজের ছোঁয়া পাওয়া যায় তাদের কথায়, কাজে, চলাফেরায় এমনকি পোশাকে পর্যন্ত।

খুবই আরামদায়ক একটা চেয়ারে বসে নিজকে গুছিয়ে নিলাম লম্বা জার্নির জন্যে। জানালার পাশের সীটে না বসলে সময় সহজে কাটতে চায়না। মন্থর হয়ে যায় ট্রেনের গতির সাথে জীবনের গতি। একটা সময় ভয় এসে মগজে বাসা বাধে; মনে হয় এ পথ জীবনেও ফুরাবেনা।

মাইলের পর মাইল পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেন। এদিক সেদিক অনেক জায়গায় থামছে। দলবেঁধে যাত্রীরা উঠছে। অনেকে নেমে যাচ্ছে। কেবল জার্মান ভাষাই নয়, পৃথিবীর হরেক রকম ভাষায় মুখরিত হয়ে উঠছে ট্রেনের বগি। সবাই কোথাও না কোথাও যাচ্ছে। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়না ওরা শীতের খোলস হতে বেরিয়ে আলোর সন্ধানে ছুটছে। প্রকৃতিও যেন দুবাহু বাড়িয়ে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সবুজের সমারোহ চারদিকে। পাতায় পাতায় পল্লবিত গাছপালা। সূর্যের আলো আছড়ে পরছে পরতে পরতে।

ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ি ঘর, গাছপালা, মানুষ, পশু পাখি মিলিয়ে যাচ্ছে সেলুলয়েডের ফিতায়। ট্রেনের জানালা এ মুহূর্তে বিরাট ক্যানভাসের কোন ছায়াছবির প্রেক্ষাপটকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

পশ্চিম বার্লিন পার হয়ে ট্রেন আবারও প্রবেশ করল পূর্ব জার্মানিতে। আবারও ছায়া কায়াহীন মূর্তির মত হাজির হল পূর্ব জার্মান পুলিশ। ওরা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ঠায় হয়ে তাকিয়ে থাকে চোখের দিকে। কিছু একটার সন্ধান করে নিজেদের প্রফেশনাল চোখ দিয়ে। চাহনির রশ্মি এতটাই প্রখর কারও ভেতর ইমিগ্রেশন অথবা কাস্টম জাতীয় দুর্বলতা থাকলে তা বেরিয়ে আসতে বাধ্য। সবকিছু ঘটে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর। তারপর খটাস করে পাসপোর্টে এন্ট্রি অথবা এক্সিট ভিসার সিল বসিয়ে মিলিয়ে যায় সূক্ষ্ম বাতাসে।

পশ্চিম বার্লিনের একটা ইতিহাস আছে। বিভক্ত জার্মানির পতনের আগে রাজনৈতিক এনক্লেভ হিসাবে বিবেচিত জায়গাটার আইডেন্টিটি দেশ অথবা শহর হিসাবে ছিলনা। ছিল হিটলারের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ইউরোপের শেষ ফ্রন্টিয়ার।

১৯৪৫ সালের ৯ই মে মিত্র বাহিনীর কাছে হিটলারের পরাজয় অফিসিয়ালি লিপিবদ্ধ করা হয়। একই সালের ১৭ই জুলাই মিত্রপক্ষের চার শক্তি পরাজিত জার্মানির Postdam শহরে মিলিত হয় যুদ্ধ পরিবর্তী জার্মানির ভাগ্য নির্ধারণে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ও সোভিয়েত লৌহমানব জোসেফ স্টালিন Postdam বসেই সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীন সার্বভৌম জার্মানির অভ্যুদয় না ঘটা পর্যন্ত চারভাগে বিভক্ত করে চার শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে এই দেশ।

উত্তর-পশ্চিম দিকের নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রিটিশরা। ফ্রান্সের ভাগে আসে দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানি। মার্কিনীদের নিয়ন্ত্রণে আসে দেশটার দক্ষিণের অংশ। আর পূব দিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন। বার্লিন শহরকে চারভাগে বিভক্ত করে একই অনুপাতে তুলে দেয়া হয় চার শক্তির হাতে।

সোভিয়েতদের বশ্যতা মেনে নিয়ে জার্মানির পূর্বাংশে জন্ম নেয় পূর্ব জার্মানি। বাকি অংশ পরিচিত পায় পশ্চিম জার্মানি হিসাবে। পূর্ব জার্মানির মাঝখানে বার্লিন শহর অনেকটা দ্বীপের মত অবস্থানে চলে যায়। শহরের পূর্বাংশের নামকরণ করা হয় পূর্ব বার্লিন এবং পশ্চিমাংশ পশ্চিম বার্লিন। গণতান্ত্রিক বিশ্বে পশ্চিম বার্লিন পরিচিতি পায় আইল্যান্ড অব ফ্রীডম হিসাবে। ১৯৬১ সালে বার্লিনকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার লক্ষে পূর্ব জার্মানরা তৈরি করে ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল।

এখানে বলে রাখা ভাল, অফিসিয়ালি পশ্চিম বার্লিন ফেডার‍্যাল রিপাব্লিক অব জার্মানির (FRG) অংশ নাহলেও এর সমস্ত দায়-দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এই দেশ। বাকি তিন শক্তি বোঝাপড়ার মাধ্যমে হস্তান্তর করেছিল নিজদের দায়িত্ব।

চলবে।

ফুটনোট: আমার এ ভ্রমণের সময়কাল অনেক পুরানো। ঘটনা প্রবাহে অনেক ইনকনসিসটেন্সি থাকতে পারে। যেহেতু প্রফেশনাল লেখক নই তাই ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করব।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১১, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩১-০১-২০২২ | ১৪:১০ |

    ঘটনা প্রবাহে অনেক ইনকনসিসটেন্সি থাকলেও সমস্যা নেই, আপনি শুধু লিখাটিকে এগিয়ে নিন। আছি। অল দ্য বেস্ট। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...