বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১০

271197

পূর্ব ইউরোপ হতে আসা ট্রেনগুলোর মত এসব ট্রেনে ঘুমের ব্যবস্থা নেই। বসার জন্যে আরামদায়ক চেয়ারই একমাত্র সম্বল। প্রায় সাত/আট ঘণ্টার জার্নি। লম্বা সময় বসে থাকলে ক্লান্তি এসে ভর করে। সেলুলয়েডের ফিতার মত বাইরের দৃশ্য দেখতে গেলে তন্দ্রা এসে যায়। তখন অজান্তেই সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলোকে মিস করি। ওখানে আর কিছু না থাক অন্তত রাতে ঘুমের ভাল ব্যবস্থা থাকে। পরিষ্কার ধবধবে বিছানা, গরম কম্বল, সাথে অন দ্যা হাউস গরম চা, সবকিছু মিলে অন্তত শারীরিক ক্লান্তিটাকে ঠেকিয়ে রাখে।

পশ্চিম বার্লিন হতে ছেড়ে আসা কোন ট্রেনই এক রুটে এক শহরের জন্যে নির্ধারিত থাকেনা। জায়গায় জাগায় থামে এবং এক লকোমোটিভ হতে বগি আলাদা করে অন্য লকোমোটিভে লাগিয়ে দেয়। ভাল করে যাচাই বাছাই না করে বগিতে বসলে বড় ধরণের ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়।

এক গ্রীষ্মে বেলজিয়াম হয়ে লন্ডন যাচ্ছি। বেশ ক’বার যাতায়াতের কারণে ধরে নিয়েছিলাম এ রাস্তার সবকিছু আমার জানা। কোথাও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে যাত্রায় ভুল হয়েছিল। এবং তা ছিল বড় ধরণের ভুল।

ট্রেনের সাইনে বেলজিয়ামের পোর্ট অব আন্টওয়ার্পের সাইন দেখে ধরেই নিয়েছিলাম গোটা ট্রেনটাই ওদিকে যাচ্ছে। খালি মত বগি দেখে ওখানেই আরাম করে বসে পরি। ভুলটা ধরতে বেশকিছু সময় লেগে যায়।

আমার গন্তব্য ব্রিটেনের ডোভার। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার ট্রেন ওদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু বেলজিয়াম অতিক্রম করে নতুন এক সীমান্তে আসতেই টনক নড়ল। ট্রেন সীমান্তে দিয়ে ফ্রান্সে ঢুকার অপেক্ষা করছে।

হুরমুর করে ইমিগ্রেশন পুলিশ উঠে পরল ট্রেনে। ওদের মুখে ফ্রেঞ্চ ভাষা শুনে পৃথিবী টলে উঠল। এ সীমান্ত হতে টিকেট কেটে ব্রাসেলস ফিরে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট অর্থ নেই পকেটে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মত হাতে যথেষ্ট সময়ও ছিলনা। এসব সীমান্তে ট্রেন পনের বিশ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করেনা।

ফ্রেঞ্চ পুলিশ এসে আমার পাসপোর্ট চাইতে সব খুলে বললাম। আমার পাসপোর্টে ফ্রান্সের ভিসা নেই। চাইলেও সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবো না। আবার ব্রাসেলস ফিরে যাওয়ার মত অর্থও নেই পকেটে। পুলিশ তড়িৎ গতিতে ট্রেন হতে নামিয়ে তাকে অনুসরণ করতে বলল।

সীমান্ত চৌকিতে গিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে কেনা লন্ডন-গামী ট্রেনের টিকেটটা চেক করলো। পাশের প্লাটফর্মেই দাঁড়ানো ছিল ব্রাসেলস-গামী রিটার্ন ট্রেনটা। ঐ ট্রেনের গার্ডের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে সংক্ষেপে জানিয়ে দিল আমার অবস্থা। গার্ড জানাল সোভিয়েত টিকেটই আমাকে সাহায্য করবে ব্রাসেলস ফিরে যেতে। ওখান হতে নতুন একটা ট্রেন ধরতে হবে। টিকেটের সাথে সাদা কাগজে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কিছু একটা লিখে ষ্টেপলার মেরে আটকে দিল। ঝামেলা ওখানেই চুকে গিয়েছিল।

এরপর যতবার এ পথে জার্নি করেছি আগ বাড়িয়ে নিশ্চিত করেছি ট্রেনের কোন বগি কোন দেশের কোন বন্দরের দিকে যাচ্ছে। এ যাত্রায়ও কোন ভুল করিনি।

বার্লিন হতে নেদারল্যান্ডস’এর Hook Van Holland’ পোর্টের ড্রাইভিং দূরত্ব প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার। গাড়ি চালিয়ে গেলে ৮ ঘণ্টার পথ। কিন্তু ট্রেন চলে তার নিজ পথে, নিজস্ব গতিতে। দূরত্ব যাই হোক, সময় লেগে যায় অনেক। চলার পথে পশ্চিম জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস’এর অনেক স্টেশনে থামে। ব্যস্ত কোন শহরে ট্রেনের বগি কেটে তা ভিন্ন রুটের লকোমটিভে লাগাতেও সময় লেগে যায়।

এ যাত্রায় আমার পথ পশ্চিম জার্মানির Brunswick, Hanover ও নেদারল্যান্ডস’এর Rotterdam হয়ে দেশটার বন্দর শহর Hook Van Holland। ওখান হতে ওভারনাইট ফেরীতে করে পাড়ি দিতে হবে নর্থ সী। সবকিছু ঠিক থাকলে পরদিন খুব ভোরে পৌঁছে যাব বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের বন্দর Harwich।

চলবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিকেলে ভোরের গল্প ... পর্ব ১০, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৯-০১-২০২২ | ১৩:৩৭ |

    মুগ্ধ পাঠ স্যার। নিয়মিত হোক ধারাবাহিকটি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০১-২০২২ | ১২:৪৪ |

      ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন

      GD Star Rating
      loading...