আসুন ছবিটার দিকে একটু ভাল করে তাকাই। বিশেষকরে পাহাড়ের বুকে চলমান পিক-আপ ট্রাক সহ ছবিটার দিকে। এ ছবি আমার নিজের নয়, নেট হতে নেয়া। এন্ডিসের অন্য কোন বাঁকে তোলা এ ছবিই কথা বলবে।
Churin রিসোর্টে দু’দিন কাটিয়ে গিন্নীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক রওয়ানা দিলাম আরও দক্ষিণে। দক্ষিণ পূবে Huancahuasi একটি রহস্যময় লোকালয়। ওদিকে যাওয়ার মাজেজাটা বুঝতে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।
সবকিছু ঠিক থাকলে মাত্র দুই ঘণ্টার বাস জার্নি। সমস্যা হচ্ছে, প্রায় সব সময়ই সবকিছু ঠিক থাকেনা। এন্ডিসের এ অঞ্চলটা খুবই দুর্গম। প্রায়ই ভূমি ধ্বস হয়। আটকে যায় পথঘাট। বৃষ্টির সিজনে বিপদজনক হয়ে উঠে চলাফেরা।
এ যাত্রায় এন্ডিসের উচ্চতা ছিল ইমাজিনেশনের বাইরে। কাঁচা রাস্তা, বিপদজনক বাঁক, সবমিলিয়ে জার্নি অব লাইফ টাইম করতে যাচ্ছি তা যাত্রার প্রথম প্রহরেই বুঝে নিলাম। Churin বাসষ্ট্যান্ডে টিকেট কাটার সময় জানতে চাইল লো ল্যান্ডে আমাদের পয়েন্ট কব কন্টাক্টের ডিটেইলস।
ভেতরটা শুকিয়ে গেল এহেন প্রশ্নে শুনে। উত্তর শুনে গুটিয়ে গেলাম এবং গিন্নীকে অনুরোধ করলাম এ জার্নি ক্যান্সেল করা যায় কিনা।
এন্ডিসের বিপদজনক বাঁকে বাস দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। যদি ঘটে নিকট আত্মীয়দের অবহিত করার জন্যেই পয়েন্ট অব কন্টাক্টের প্রয়োজন। এন্ডিসের দুর্ঘটনায় উদ্ধার মিশন থাকেনা। অনেকটা সাগরের তলদেশে হারিয়ে যাওয়ার মত যানবাহনও হারিয়ে যায়। দুর্ঘটনা হারিয়ে যাওয়া যাত্রীদের নাম পেরুর ন্যাশনাল ডাটাবেজে মিসিং পারসন হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকে। কোনদিনও মৃত হিসাবে চিহ্নিত করেনা।
নিউ ইয়র্কস্থ বন্ধু রহমানের নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে কিছুটা আস্বস্থ হলাম কিছু একটা ঘটে গেলে অন্তত দেশ পর্যন্ত পৌঁছবে আমার পরিণতির খবর।
দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে বুকে অন্যরকম সাহসের দরকার হয়। থাকতে হয় পাহাড়ের মতই সমান মনোবল। তা না-হলে এ পথের জার্নি উপভোগ করা যায়না। মৃত্যুভয় গ্রাস করে নেয় নিজের অস্তিত্ব।
জানালার পাশের সীটটা ইচ্ছা করেই নিয়েছিলাম এন্ডিসের মায়াবী দৃশ্য দেখবো বলে। কিন্তু মায়াবী দৃশ্য হরর দৃশ্যে রূপ নিতে বেশিক্ষণ লাগেনি। বাসের চাকা রাস্তায় চলছে না হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে বুঝতে চাইলে বাস হতে নামতে হয়। পথের এক পাশে খোদ এন্ডিস পর্বতমালা, অন্য পাশে অন্তহীন মৃত্যুফাঁদ।
অভিজ্ঞতার ভয়াবহতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে উলটো দিক হতে কোন যানবাহন আসলে। প্রথম দর্শনে ওয়ান-ওয়ে রোড মনে হলেও দুদিক হতেই বাস ট্রাকের চলাচল। রাস্তার যেদিকটায় পাহাড় অতিরিক্ত কিছু পাথর সরিয়ে জ্যামিতির জ্যা আকৃতির স্পেস তৈরি করা আছে ক্রসিং’এর জন্যে। প্রতিটা সফল ক্রসিংয়ের পর বুকের ভেতর হতে যেন ১০ মন ওজনের পাথর নেমে যায়। বেশ ক’বার চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে।
হৃৎপিণ্ডের উথাল পাতাল শান্ত হতে ৩ ঘণ্টা লেগে গেল। বিনা ইন্সিডেন্টে পৌঁছে গেলাম এন্ডিসের নতুন উচ্চতায়।
Huancahuasi আসলে কোন শহর নয়। ব্যস্ত জীবন হতে কিছুটা সময় পালিয়ে থাকার সেইফ হেভেন। বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হট স্প্রিং টুরিস্ট আকর্ষণের হট স্পট। গরম পানির ন্যাচারাল ফোয়ারায় শরীর ডুবিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপভোগ করে প্রকৃতির এই দান। পৃথিবীর অনেক প্রান্ত হতে আসা পর্যটকদের দেখা মেলে এখানে।
পাহাড়ের দুই উচ্চতায় দুটি দালানের অবস্থান কিছুটা হলেও কৌতূহলের সৃষ্টি করে। এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের বিলাস বহুল দালান থাকার কথা না। গিন্নীকে জিজ্ঞেস করতে কোন উত্তর না দিয়ে ওদিকেই নিয়ে চলল আমাকে।
তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের অপরাজনীতির মাইলস্টোন হিসাবে দাঁড় করানো যাবে দালান দুটো। এক কথায় লুটপাটের অভয়ারণ্য। পেরুর এক কালের সফল প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুখিমোরের অবকাশ-কালীন প্রাসাদ এখানে। প্রাসাদ বলতে ন্যাচারাল হট স্প্রীংকে দেয়াল দিয়ে আটকে বানানো হয়েছে সুইমিং পুল। পাশে বিলাস বহুল কটেজ এবং হ্যালিপ্যাড।
প্রাসাদের উলটো দিকে একই চেহারা ও আকৃতির আরও একটা প্রাসাদ। এবং সেটার মালিক প্রেসিডেন্টের কন্যা কেইকো ফুখিমোরে। প্রেসিডেন্ট নিজ কন্যার জন্যে জন্মদিনের উপহার হিসাবে বানিয়েছিলেন ডুপ্লিকেটটা।
আলবার্তো ফুখিমোরে। গোটা পেরু যখন বামপন্থী সাইনিং পাথ গেরিলাদের সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি হয়েছিল রাজনীতির দিগন্তে আবির্ভূত হন জপানি ব্যাকগ্রাউন্ডের এই প্রেসিডেন্ট। কঠোর ও নির্মমভাবে নির্মূল করেন Manuel Rubén Abimael Guzmán Reynoso’র সন্ত্রাসী চক্র। পেরুভিয়ানরা ফিরে পায় তাদের স্বাভাবিক জীবন। অনেকে দেবতার আসনে বসায় ফুখিমোরের প্রেসিডেন্সি।
তৃতীয় বিশ্বের লুটেরা রাজনীতিবিদদের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে খুব একটা সময় নেননি ফুখিমোরে। Huancahuasi’র দুই দুইটা প্রাসাদ ছিল সাগরে এক ফোটা বৃষ্টির মত। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শেষ টার্মের নির্বাচনে অবৈধ উপায়ে নিজকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। কিন্তু পেরুর জনগণ দেশটার বিচার ব্যবস্থার সহায়তায় ক্ষমতাচ্যুত করে এক কালের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে। আলবার্তো ফুখিমোরে পালিয়ে যান জাপানে। ওখান হতে পেরুর কাছাকাছি দেশ চিলিতে আসেন বিভিন্ন কারণে। চিলির সরকার পেরু সরকারের অনুরোধ ফুখিমোরেকে তুলে দেয় তাদের হাতে।
সেই ফুখিমোরে এখন জেলে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আলবার্তোর কন্যা কেইকো ফুখিমোরে পেরুর রাজনীতিতে খুবই জনপ্রিয় একটি নাম। দুই দুইবার চেষ্টা করে পরাজিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।
গিন্নী আর দশজন পেরুভিয়ানের মত লম্বা সময় ধরে সাতার কাটতে নেমে গেল ফুখিমোরেদের সুইমিং পুলে। সময় চলে গেল চোখের পলকে। দুপুরের খাবারের জন্যে আমাদের কোন হোটেল রেস্টুরেন্টে যেতে হলোনা।
খোলা মাঠে অনেকে দোকান খুলে তৈরি খাবার বিক্রি করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রায় সবাই আদিবাসী ইনকা। ওদের খাবারেও তার প্রতিচ্ছবি। গিনিপিগ, র্যাবিট, লামা, মিষ্টি আলু, বয়েলড বিনস ছিল মেনুর মুল আইটেম।
এন্ডিসের কোন এক চোরা গলিতে সময়টা খুব দ্রুতই কেটে গেল। সূর্যের তাপ হাল্কা হয়ে আসছিল। এন্ডিসের চূড়ায় চূড়ায় মেঘমালাদের ঘোরাফেরা মনে করিয়ে দিচ্ছিল এবার ফেরার পালা।
কেবল ফেরার পথে গিন্নী জানাল এদিকটায় আসার মূল কারণ। এমন এক জার্নিতে তার বাবা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল এন্ডিসের গহীন শূন্যতায়। তার স্ট্যাটাস এখনো …মিসিং ইন এন্ডিস।
শেষ।
loading...
loading...
পরম মুগ্ধতায় এই পর্বের শেষাংশ পড়লাম প্রিয় স্যার। শুভ কামনা।
loading...