এন্ডিসের ভার্টিকেল জার্নি

270221

ভ্রমণ মানেই উপভোগ। অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার হাতছানি। সীমিত সামর্থ্যের ভেতর যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আমি ঘুরে বেড়াই। অন্যদের তুলনায় এই ঘুরে বেড়ানোর পরিসরটা আমার বেলায় একটু প্রসারিত সুযোগ ও সময়ের কারণে। উপভোগ করি বলেই ভ্রমণ করি। কিন্তু এই উপভোগ মাঝে মধ্যে নাইট্মেয়ার হয়ে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে। চাইলেও স্মৃতির পাতা হতে মুছে ফেলা যায়না।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর উত্তর দিকে Churin নামের ছোট একটা শহর আছে। ছবির মত সুন্দর। চারদিকে এন্ডিস পর্বতমালা। অনেকটা উপতক্যার মত এই শহরে বছর জুড়েই রাজত্ব করে সুনসান নীরবতা।

শীতকালে পর্যটকরা ভিড় জমায়। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ন্যাচারাল জলপ্রপাত প্রকৃতি প্রিয় মানুষদের হাতছানি দিয়ে টানে। হোটেল মোটেলেরও অভাব নেই। এ ছাড়া পেরুভিয়ানদের জন্যে আকর্ষণের আরও একটা কারণ হচ্ছে দেশটার লো-ল্যান্ডে যখন শীত এন্ডিসের উচ্চতায় তখন গ্রীষ্মকাল। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা আমার জানা নেই। শুধু জানি একই দেশে একই সময় শীত ও গ্রীষ্মকাল পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়ায়।

প্রস্তাবটা ছিল আমার গিন্নীর। মধ্য জুনের কনকনে শীতে রাজধানী লিমা কাবু হয়ে থাকে। কুয়াশার ঘোমটা হতে দিনে একবারের জন্যেও মুখ খোলেনা। চারদিকে একধরণের স্থায়ী বিষণ্ণতা। এমন এক পরিবেশে বেশীদিন বাস করলে ডিপ্রেশন চেপে ধরে। গিন্নীর তা জানা ছিল। লিমার মন খারাপ করা আবহাওয়া হতে বেরিয়ে ঝলমলে রোদে যাওয়ার জন্যেই Churin নামটা সামনে আসে। আমার কোন আপত্তি ছিলনা। নতুন কিছু দেখতে নরকে যেতেও প্রস্তুত আমি।

লিমা হতে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার পথ Churin। একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্যদিকে মাইটি এন্ডিস পর্বতমালা, যে কারও মন কাড়াতে বাধ্য।

যাত্রার শুরুতেই সমস্যা। ঘন কুয়াশায় বাসের গতি ডেড-স্লো করতে বাধ্য হচ্ছে ড্রাইভার। এমন ভৌতিক পরিবেশে বাস জার্নি ভয় ধরিয়ে দেয়। যে কোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নিয়েই বাসগুলো রাস্তায় নামে। বুকে অসীম সাহস না থাকলে এ পথে পা বাড়ানো খুব কষ্টের।

লিমা ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জনবসতির ঘনত্ব কমে আসতে শুরু করল। শহরের চাকচিক্য ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল পেরু নামের দেশটার বিবর্ণ চেহারা।

ঘণ্টা খানেক চলার পর পীচ-ঢালা রাজপথ ছেড়ে আমাদের ধরতে হবে ইট-সুরকির কাঁচা রাস্তা। গিন্নীর এমন ঘোষণায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। মূল কারণ, আমাদের বাস ধীরে ধীরে উপরে উঠছে।

SYAN নামের এক জরাজীর্ণ শহরে আমাদের প্রথম স্টপেজ। এক ঘণ্টার মত বিরতি। দুপুরের খাবার সেরে নেয়ার শেষ সুযোগ।

প্রশান্ত মহাসাগরের ফ্রেশ মাছ, সাথে ফ্রাইড পটেটো দিয়ে খাওয়া শেষ করে বিল দিতে গিয়ে অবাক। রেস্টুরেন্টের সবাই আমার গিন্নীকে চেনে। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানাল এক সময় এই রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন গিন্নীর নানী।

সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় বের হতে গিন্নী তাড়া দিল দৌড়ানোর। কিছু বুঝে উঠার আগে শুরু করলাম গিন্নীর পিছু নেয়া। দৌড়ে আরও উচ্চতা ডিঙ্গচ্ছি আমরা। মুখ হতে জিহ্বা বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিছুটা পথ পাড়ি দেয়ার পর একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে থামলাম আমরা।

বাড়ির সামনের গোপন কুঠুরি হতে ভোজবাজির মত বেরিয়ে এলো একটা চাবি। এবং সেই চাবি দিয়ে মূল ফটকের তালা খুলে ঢুকে পরলাম এন্ডিসের মতই বিবর্ণ চেহারার বাড়িটাতে।

এই বাড়ির মালিকও গিন্নীর নানী। তিনি বেঁচে থাকতে বার বার অনুরোধ করে গেছেন আমরা যেন কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও এখনটায় থামি।

অযত্ন অবহেলার সাক্ষী বাড়ির সবকিছুতে। বুঝা যায় অনেকদিন এখানটায় কেউ আসেনি।

কিছুটা সময় বিছানায় আরাম করে পথের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম। বাথরুম শেষে রওয়ানা দিলাম উলটো পথে।

এবং এখানেই ছিল পীচ-ঢালা পথের শেষ এবং সমস্যার শুরু।

আকাশের দিকে উঠছি আমরা। হিসাব কষলে ৪৫ ডিগ্রী হবে হয়ত বাসের জিয়োমেট্রি। ঠিক যে ডিগ্রীতে বিমানবন্দর হতে বড় বড় বিমান উড়ে যায়। তলপেটে একধরণের চাপ অনুভব করতে শুরু করলাম। অস্বস্তি বাড়তে লাগলো। সাথে সীমাহীন ভয়। প্রয়োজনে ব্রেক কষলে বাসটা থামানো যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ হল।

গিন্নীর দিকে তাকালাম। নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এন্ডিসের বিশালতায় এক ধরণের মায়াবী টান আছে। একবার প্রেমে পরলে সহজে উঠে আসা যায়না।

মাচু পীচুর উচ্চতার কথা মনে হল। একই কায়দায় উপরে উঠেছিলাম। তবে রাস্তা ছিল মসৃণ। ছিল আধুনিক যানবাহনের সব সুবিধা।

কিন্তু এ যাত্রায় এ সবের লেশমাত্র ছিলনা। অথচ জানামতে এদিকটায়ও পর্যটকরা নিয়মিত ভিড় জমায়। বিদেশি না হোক স্থানীয়দের সংখ্যাও কম না।

জীবনে এই প্রথম বাস জার্নিতে বমির ভাব অনুভব করলাম। কখন কোথায় বেরিয়ে আসবে ভাবতে অস্থির লাগলো। গিন্নীকে বলতে ব্যস্ত হয়ে পরল ড্রাইভারকে বুঝাতে। সময়মত না থামলে নোংরা কাজটা হয়ত ভেতরে সমাধা করতে হতো।

বাসের বাইরে পা রাখতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আমি কি রাস্তায় পা রাখছি, নাকি এন্ডিস পর্বতমালার খোলা ফাঁদে পা দিয়ে চিরদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। নীচের দিকে তাকাতে মাথা ভো করে ঘুরে উঠল। গিন্নী পাশে না থাকলে হয়ত পরেই যেতাম।

নিজকে কিছুটা আড়াল করে হর হর করে বমি করে ফেললাম। ড্রাইভারের কাছ হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছি তাই গিন্নীর গো-এহেড সিগন্যাল পেয়ে প্যান্টের বোতাম খুলে বাকি কাজটা সেরে নিলাম।

এ যেন অনন্তকালের যাত্রা। ধীরে পিপড়ার গতিতে চলছে আমাদের বাস। ভেতর আমি শক্ত হয়ে প্রহর গুনছি। এক একটা বাঁক পাড় হচ্ছি আর নতুন নতুন ভয় এসে ভর করছে। কি হবে যদি এখানেই আমার ইতি হয়!
বাসের বাকি যাত্রীরা ছিল নির্বিকার। চোখ মুখ ভাবলেশহীন। আমার মত এদিক সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছে না। ইট সুরকি আর পাথরের রাস্তা দিয়ে বাসের ভার্টিকেল জার্নিতে ওরা হয়ত অভ্যস্ত। কিন্তু সমতলের মানুষ আমি, কিছুতেই সহজ হতে পারলাম না।

চার ঘণ্টার জার্নি সাত ঘণ্টায় এসে ঠেকল। শেষ কখন তার কোন ইঙ্গিত নেই। গিন্নী ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছে একই প্রশ্ন বারবার শুনতে গিয়ে। শুধু আশা দিচ্ছে, এই সামনের বাঁকটা পার হলেও আমাদের যাত্রা শেষ।

এন্ডিসের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে ছবির মত সুন্দর একটা লোকালয়। পর্বতমালার বুক-চিড়ে শেষ বাঁকটা পার হতে চোখের সামনে আছড়ে পরল চুরিনের প্যানোরমা।

ফুটনোট; এক পর্বে শেষ করার ওয়াদা থাকলেও সম্ভব হলনা। আরও একটা পর্ব দিয়ে শেষ করবো লেখাটা। কারণ একই জার্নিতে আমি আরও উপর উঠবো। পাড়ি দেব আরও দুর্গম পথ। আশাকরি সাথে থাকবেন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এন্ডিসের ভার্টিকেল জার্নি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৬-০২-২০২২ | ১৯:৪৮ |

    ভ্রমণ মানেই উপভোগ। অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার হাতছানি।

    এই পর্বটি পড়েও মুগ্ধ হলাম স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ০৬-০২-২০২২ | ২১:০০ |

      অনেক ধন্যবাদ

       

      GD Star Rating
      loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০৭-০২-২০২২ | ২:১৩ |

    অসাধারণ অনুভূতি প্রকাশ

    GD Star Rating
    loading...