পশ্চিম বার্লিনে ওটাই ছিল আমার শেষ আসা। কোথায় যেন একটা লুকানো কষ্ট বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল কেবল জার্মানি নয়, বরং ইউরোপকে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে। মস্কো অথবা সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে ট্রেনে করে লন্ডন যাত্রার পথে পোল্যান্ড, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম অথবা নেদারল্যান্ডের পথেঘাটে অনেক স্মৃতি, অনেক না-বলা কথা যা হয়ত জীবনের অন্তিম বেলায় হাতড়াতে গেলে কষ্ট লাগবে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে।
১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম আসা পশ্চিম বার্লিনে। বার্লিন দেয়ালের ঝামেলা আর পূর্ব জার্মান ইমিগ্রেশনের লৌহবলয় পার হয়ে এ শহরে পা রাখতেই মনে হল জীবন এখানে অন্যরকম। পূর্ব ইউরোপের তুলনায় বাতাস এখানে অনেক হাল্কা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মত পদে পদে এখানে কেউ কাউকে নজরদারি করেনা। দুই পরাশক্তির ফোরফ্রণ্ট এ শহরে প্রথমবারের অভিজ্ঞতাটাও ছিল মনে রাখার মত।
মস্কো হতে পূর্ব জার্মান ও নেদারল্যান্ডের ভিসা নেয়ায় যে যাত্রায় পূর্ব বার্লিনে তেমন কিছু করার ছিলনা। সকাল সকাল বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে বসে আছি Zoologischer Garten রেল ষ্টেশনে।
নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড-গামী ট্রেন দুপুরের দিকে। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। সাথে বন্ধু রহমান। ও ইতিমধ্যে ঘুরে গেছে এ পথে, তাই অনেক কিছু ছিল তার পরিচিত। কিছু দোকানপাট ইতিমধ্যে খুলে গেছে। শূন্য রাস্তাঘাটেও বাড়ছে গাড়ির ভিড়। ষ্টেশনের পাশেই একটা কফি শপ। ওখান হতে গরম এক কাপ কফি কিনে হাঁটতে শুরু করলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে।
পাশাপাশি বেশকটা ইলেকট্রনিক্সের দোকান। এসব দোকানের মূল ক্রেতা আমার মত পূর্ব ইউরোপ হতে আসা পরিব্রাজকের দল। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে পশ্চিমা ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপক চাহিদা। বিশেষকরে উন্নত মানের মিউজিক সেন্টার গুলো। দোকানদার আমাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল আমরা সোভিয়েত দেশের মানুষ।
উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানালো হরেক রকম পণ্যে সাজানো স্টোরগুলোতে। অলস সময় কাটানোর মোক্ষম জায়গা। এলপি রেকর্ডের বিশাল ভাণ্ডারে চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো যায় বাজারে আসা নতুন নতুন গান শুনে।
হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ফিস ফিস শব্দে বাংলা বলছে। এদিক ওদিক তাকাতে চোখে পরল স্টক-রুমের স্লাইডিং ডোর খুলে কেউ একজন আমাকে ডাকছে। এবং তা বাংলায়। উৎসুক হয়ে ওদিকে পা বাড়ালাম।
বাংলাদেশি সোহেল আহমেদের সাথে পরিচয়টা ওখানেই। গলার স্বর অনেকটা নীচে নামিয়ে ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল পুলিশের ক্যাডাবরা কুকুর আমাকে তাড়া করেছিল কিনা। একটু অবাক হলাম। কারণ আমার জানা ছিল পশ্চিম ইউরোপের পথেঘাটে পুলিশ তাদের ক্যাডাবরা কুকুর টুরিস্টদের লাগেজের পেছনে লেলিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, ড্রাগের সন্ধান!
আমি টুরিস্ট এবং ২৪ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসায় এখানে এসেছি শুনে অবাক হল সদ্য পরিচিত বাংলাদেশি সোহেল আহমেদ। উনার কাছেই পেলাম দলে দলে বাংলাদেশিদের এখানে আসার অনেক অজানা তথ্য।
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশিদের জন্য দুই জার্মানির একটাতেও ভিসার প্রয়োজন হয়না। সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত ক্যারিয়ার এরোফ্লট গাদা গাদা বাংলাদেশিদের নিয়ে আসছে পূর্ব জার্মানিতে। ওখান হতে বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে সবাই ভিড় জমাচ্ছে পশ্চিম বার্লিনে। যাদের একটু ইংরেজি জানা আছে তারা ছড়িয়ে পরছে পশ্চিম জার্মানির বিভিন্ন শহরে।
আমি এখানে থাকতে আসিনি শুনে আকাশ হতে পরলেন সোহেল সাহেব। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ওনার বাড়ি ঢাকার রূপগঞ্জে। এবং ঐ এলাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব গোলবক্স ভূঁইয়া সম্পর্কে উনার চাচা। গোলবক্স ভূঁইয়া ছিলেন আমার আব্বার বন্ধু। সব খুলে বলতে সোহেল সাহেব খুব আপন করে নিলেন আমাকে। সময় থাকলে তার বাসায় ঘুরে আসারও দাওয়াত দিলেন। এক রুমের বাসায় আরও দশজন বাংলাদেশির বাস। খুঁজলে পরিচিত আরও অনেককে পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস দিলেন।
ইলেকট্রনিক্স ষ্টোরের স্টক-রুম লুকিয়ে লোড-আনলোডের কাজ করেন তিনি। সময় অসময় পুলিশ এসে হানা দেয় অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে, তাই সবসময় নিজকে লুকিয়ে রাখেন স্টক-রুমে।
দেশে গেলে পরিবারের সাথে দেখা করার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান হতে।
কোথায় যেন একটা কষ্ট দানা বাঁধতে শুরু করে প্রবাসে এসব বাংলাদেশিদের কথা শুনলে।
loading...
loading...
তথ্যযোগে নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে অসাধারণ এক স্মৃতি বিন্যাস। পড়ে চলেছি।
loading...
সুন্দর ভাবনা
loading...