ওটাই ছিল আমার শেষ বিলাত যাত্রা। অনেক স্মৃতি, অনেক কাহিনী, অনেক গল্পের শেষ হবে এ গ্রীষ্মের পর। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া জার্নির ইতি টানবো এ যাত্রায়। মাঝখানে বাল্টিক সাগরের পানি অনেকদূর গড়িয়ে যাবে। দুই পৃথিবীর দুই জীবন খুব কাছ হতে দেখার সুযোগ হবে। দেখা হবে অনেক দেশ। পরিচয় হবে হরেক রকম মানুষের সাথে। কৈশোর অধ্যায়ের ইতি টেনে পা রাখবো যৌবনে। প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, সেক্স অনেক কিছুর সাথে দেখা হবে প্রথমবারের মত। সে জীবন হবে স্বপ্নিল প্রতিশ্রুতিতে ভরা বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী।
প্রতিবছর জুনের শেষদিকে শুরু হয় আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি। ক্যাম্পাস জীবন দু’মাসের জন্যে থমকে যায়। রুশ ছাত্ররা চলে যায় নিজ নিজ শহরে। অনেকের ঠিকানা হয় লেবার ক্যাম্পে। সাইবেরিয়ার গহীন অরণ্যে তৈরি হচ্ছে রেললাইন। শ্রমিক সমস্যা মাথায় রেখে দেশটার কম্যুনিস্ট সরকার উৎসাহ দেয় ছাত্রদের। সারা বছর আর্থিক সমস্যায় ভোগা রুশ ছাত্ররা নাম লেখায় নির্মাণ ব্রিগেডে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ওরা যখন ফিরে আসে পকেটে থাকে খরচ করার মত বেশকিছু রুবেল। আমি নিজেও একবার নাম লিখিয়েছিলাম এমন এক ব্রিগেডে। দু’মাসের কায়িক পরিশ্রমের সে কঠিনতম অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে শেয়ার করেছি পাঠকদের সাথে। ঐ বছরের গ্রীষ্মের ছুটিটা বাদ দিলে বাকি সবকটা ছুটি কাটাতে ছুটে গেছি আরও পশ্চিমে।
১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের কোন এক পূর্ণিমা রাতে নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চেপে বসি নৈশ ফেরীতে। লম্বা জার্নির এ ছিল শেষ ঠিকানা। শুরুটা ছিল মস্কো হতে ট্রেনে চেপে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। ওরারশ হতে পাশের দেশ পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন। প্রথমবারের মত বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে পশ্চিম বার্লিন। এবং ওখানে ট্রেন বদল করে পশ্চিম জার্মানির হ্যানোভার। হ্যানোভারে আরও একবার ট্রেন বদল। এবং সবশেষে নেদারল্যান্ডের রটোড্রাম হয়ে বন্দর শহর হোক ভ্যান হল্যান্ড।
ওভার-নাইট ফেরী জার্নিতেই প্রথম পরিচয় হয় পশ্চিম ইউরোপের খোলামেলা জীবনের সাথে। বিস্মিত না হলেও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক লৌহ বলয়ের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা সময় লাগেনি। যতটা ভালবাসা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পা রেখেছিলাম ততটা দ্রুতই এ ভালবাসা উবে গিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে ১০০ জাতি ও ভাষার একটা দেশকে কি করে কম্যুনিস্ট রেজিম নিজেদের গিনিপিগ বানিয়ে রেখেছিল তা ধরতে অনেকের অনেক সময় লাগলেও আমার খুব একটা লাগেনি। কারণ আমি খুব দ্রুত সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম মানুষের সাথে। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির একজন আর্মেনিয়ান কেন রুশদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিজেদের করে নেবে এ প্রশ্নের উত্তর খোদ আর্মেনিয়ানদের কাছেও ছিলনা। ওদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে ভেতরের চাপা ক্ষোভ ও বলশেভিকদের প্রতি জমে থাকা ঘৃণা।
এসব নিয়ে লিখতে গেলে লেখা যাবে বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী। যার শুরু থাকলেও হয়ত আমার মত কাঁচা হাতের লেখক টেনেটুনে শেষ করতে পারবেনা। তাই উঠিয়ে রাখছি এ গল্প। আপাতত চলুন তল্পি-তল্পা গুটিয়ে রওয়ানা দেই লন্ডনের দিকে। ওখানে জমা আছে অনেক গল্প। এ যাত্রায় আমাকে আর ব্রিটিশ ভিসার জন্যে মস্কো যেতে হবেনা। ইতিমধ্যে এর বিকল্প আবিষ্কার করে নিয়েছি। রওয়ানা দেবো সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। প্রথম স্টপেজ লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস।
চলবে।
loading...
loading...
চমৎকার প্রকাশ। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম পরের পর্বের জন্য।
loading...