দামেস্কাস গেইট এবং আমি।
ভারতীয় চরিত্রের এইদিকটা অনেকের মত আমাকেও বিমোহিত করে। ওরা যেখানেই যায় তাদের বেনিয়া-বৃত্তি সাথে নিয়ে যায়। অনেকটা সুঁই হয়ে ঢুকে সাপ হয়ে বের হওয়ার মত। দৃঢ় বিশ্বাস ইসরায়েল হচ্ছে তাদের বাণিজ্য-লক্ষ্মীর নয়া দিগন্ত। তেল আবিব এয়ারপোর্টে নেমেই ব্যপারটা আঁচ করা যায়। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় পাশের বুথে একজন ভারতীয়কে প্রশ্ন করছিল ইসরায়েলই অফিসার। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল সে তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং ছুটি কাটিয়ে ইসরায়েলে ফিরছে। দেখতে কোষ্ঠকাঠিন্য রুগীর মত হলেও ভারতীয় এই ছাত্রের সাথে কথা বলার সময় মনে হলো অফিসারের সুখ তেলতেলেয়ে মাটিতে পড়ছে। পুরানো জেরুজালেমের মুসলিম কোয়ার্টারে চোখে পরার মতে বিদেশী বলতে ভারতীয়রাই। গায়ে গতরে অগোছালো সাউথ ইন্ডিনিয়ানরাই সংখ্যায় বেশী। সংখ্যায় পশ্চিমা বিশ্বের রাস্তাঘাটে কিলবিল করার মত না হলেও সন্দেহ নেই ইসরায়েলও এদের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ একটা সময় যখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তাদের দুয়ার বিদেশী শ্রমিকদের জন্যে উন্মুক্ত করছিল একই ভারত তার দেশের মুসলিম জনসংখ্যাকে পুঁজি বানিয়ে ব্যাপক সুবিধা নিয়েছিল। পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক খারাপের অভিনয় করে আরব রাজা-বাদশাহদের আস্থা অর্জন করেছিল।
পৃথিবী এখন বদলে গেছে। ফিলিস্তিনি সমস্যা অনেক পশ্চিমা দেশের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্যেও এখন কোন সমস্যা নয়। এতদ অঞ্চলের রাজা-বাদশারা এখন ইসরায়েলের জিগরই দোস্ত। ওরা দেশে-বিদেশে একই পুঁজির যৌথ বিনিয়োগকারী। রাজধানী তেল আবিব আর বন্দর নগরী হাইফা হচ্ছে মদ আর পূর্ব ইউরোপীয় নারী ভোগের লীলাভূমি। ওরা আসে এবং সাথে নিয়ে আসে বস্তা-ভর্তি পেট্রো ডলার। সূরা আর সাকির আসরে বৃষ্টির মত ডলারে সিক্ত করে নারী দেহ। এখানেই ভারতীয়দের পার্থক্য। ওরাও আসে, তবে খরচের মানসে নয়, বরং টু-পাইস কামানোর ধান্ধায়। নিউজিল্যান্ডের গভীরে ছোট জনপদের শহরেও ওদের দেখা যায়। ডেইরি স্টোর বানিয়ে ব্যবসা করছে। অনেক দেশে একই বিনিয়োগ চলে কর্নার শপের নামে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে গুজরাটি ভারতীয়দের দখলে ফ্রীওয়ে সহ শহর-বন্দরের মোটেল ব্যবসা।
এবং কতিপয় ভারতীয়।
ঢালু ও পিচ্ছিল পাথরের রাস্তায় এহেন ধাক্কা সামলে নিতে একটু কষ্টই হলো। সামলে উঠে দাঁড়াতেই দেখি একদল ভারতীয়। তাদের কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কাটা ইচ্ছাকৃত ছিলনা, কিন্তু এর তীব্রতাই বলে দেয় এলোমেলো ও বেসামাল গতিতে হাঁটছিল মহিলা। ওদের কেউ ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। আমিও অবাক হইনি। কারণ ভুলের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি এখনো পৌঁছায়নি পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। আমাদের উপমহাদেশ তার অন্যতম। ক্ষণিকের জন্যে রক্তের চাপ উছলে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম, আমি এখন এমন একটা দেশে যে দেশে আমার ধর্মীয় পরিচয় গায়ে গতরে এলোমেলো ভারতীয়দের চাইতে অনেক বেশী ভীতিকর। সাহায্য চাইলেই যে ইসরায়েলই পুলিশ দৌড়ে আসবে এমন সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এসব মেনে নিয়েই উঠে দাঁড়ালাম এবং ভাণ করলাম যেন কিছুই হয়নি। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করে খুব অবাক হলাম, ওরা ফুটপাথের উপর বসা ভেন্ডরদের কাছ হতে সবজি কিনছে। প্রমাণ করার জন্যে এটাই ছিল যথেষ্ট, ওরা আমার মত পর্যটক নয়। হয়ত জেরুজালেমেই বাস করছে। নিশ্চয় কাজ বলে কিছু একটা করছে এখানে। জানার কৌতূহলটা দমাতে পারলাম না। বেশকিছুটা পথ ওদের অনুসরণ করলাম। যেখানে থামছে, আমিও থামছি। উদ্বার করার চেষ্টা করলাম ওদের কথোপকথন। কিন্তু না, গুটিকয়েক হিন্দি শব্দ বাদে কথাবার্তার সবটাই ছিল দক্ষিণের ভাষায়। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে মিশে গেলাম জনারণ্যে।
আর দশটা দিনের মত একটা দিন।
বেলা গড়াচ্ছিল। আজকের মেনুতে অন্য কোন শহরে ঢুঁ মারার পরিকল্পনা ছিলনা নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে ফিলিস্তিনি আরবদের ঢল নামা Suq Khan El Zeit রাস্তা দেখে তা বুঝার উপায় ছিলনা। জীবন এখানে আর দশটা দিনের মতই। লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় দুই ধারে পশরা সাজিয়ে দোকানিরা গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দোকান হতে ভেসে আসছে ভিন্ন রকমের গান। অনেক দোকানে বাজছে কুরানের আয়াত। এ রাস্তা যানবাহন চলাচলের জন্য নয়। তবে মালামাল পরিবহনের জন্যে ট্রাক্টর জাতীয় এক ধরণের ট্রাক সাপের মত একে-বেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের স্পন্দন অনুভব করতে এখানে কান পাততে হয়না। বরং এ স্পন্দন নিজেই চলে আসে কানের কাছে। শুধু চোখ আর কান দুটো একটু খোলা রাখতে হয়। পুরানো জেরুজালেমের রাস্তার এ জীবন কোনভাবেই দেয়ালের ওপারের ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিফলন নয়। এখানে আছে ব্যস্ততা, উচ্ছলতা, আছে না পাওয়ার কষ্টকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য। অধুনা ফিলিস্তিনের রাজধানী রামাল্লার চিত্রটা একটু ভিন্ন। ওখানে রাজত্ব করে দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর ইসরায়েলিদের প্রতি ঘৃণার আগুন। রামাল্লায় দেয়ালের লিখন পড়লেই আঁচ যায় ওদের বেঁচে থাকার গল্প। বাংলাদেশ হতে চোখ বেঁধে কাউকে পশ্চিম তীরে নামিয়ে দিলে প্রথমেই ভুল করবে এলাকাটা পুরানো ঢাকার কোন অংশ ভেবে। বিশেষ করে বিভক্ত দেয়াল পার হয়ে ফিলিস্তিনে পা রাখা দু’এক মাইলের মধ্যে। এর পর অবশ্য চিত্র কিছুটা হলেও বদলে যাবে। চোখে পড়বে উপরের দিকে ধাবমান স্কাই স্ক্রাপার। ঝকঝকে শপিং মল। বেশকিছু গাড়ির দোকান। যদিও এসবের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মূল ভূমির ইহুদি। রাস্তার ট্রাফিক অনেকটাই এলোমেলো। পথচারীরা অনেকটা ঢাকার ফ্রি স্টাইলে পার হচ্ছে।
দামেস্কাস গেইট।
দামাস্কাস গেইটে এসে পৌঁছলাম ঠিক মধ্য দুপুরে। জনশূন্য, অনেকটাই খা খা করছে সামনের স্কয়ার। হাতের ডানদিকে ছোট মত একটা ছাউনির নীচে বসা ইসরায়েলই পুলিশ কড়া নজর রাখছে চারদিকে। পুলিশদের বেশীর ভাগই যুবতী। লম্বায় অনেকটাই খাটো। দেখতে আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় হাতে ধরা অস্ত্রের হিংস্রতার চাইতে বেশী দৃষ্টি কাড়বে তাদের চেহারা ও গড়ন। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ও এক ধরণের বিষণ্ণতা। পূর্বাভাষ ছিল আজ এখানে গোলমাল হবে। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করবে বিভক্ত দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠা শতাধিক পাকাবাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে। পশ্চিম তীরে অনেকে বলেছিল, কে জানে, হয়ত আজই শুরু হতে পারে নতুন ইন্তেফাদার গোঁড়া পত্তন। মাঠের চিত্রে তার ছায়া মাত্র ছিলনা। সবকিছু ছিমছাম। চলাফেরার কিছুটা সতর্কতা। সামনের আ-ওয়াদ রোডে ব্যস্ততা বাড়ছে।
ফিলিস্তিনি জনগণ বনাম ইসিরায়েলি পুলিশ।
পাশের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ড্রাইভাররা প্রতিদিনের মতই আড্ডা দিচ্ছে। অনেকে সিগারেট ফুঁকছ এবং চোখ রাখছে সম্ভাব্য যাত্রীর দিকে। গেইটের সামনেই কলোসিয়ামের মত গ্যালারি। ওখানে সব সময়ই টুরিস্টদের ভীর। আজ অবশ্য তেমন কাউকে দেখা গেলনা। মোবাইল ফোনের ক্যামেরাটা অন করে বসে পরলাম ফাঁকা একটা জায়গায়। আবারও একদল ভারতীয়। ওরা দলবেঁধে ঢুকছে মুসলিম কোয়ার্টারে। আরব কজন যুবক একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করতেই পুলিশ নেমে এলো ছাউনি হতে। হিব্রু ভাষায় কি বললো বুঝতে পারলাম না। তবে আন্দাজ করত পারলাম, এখানে যুবাদের জমায়েত আজ নিষিদ্ধ। ইচ্ছা থাকলেও সামনে যেতে সাহস করলাম না। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলই পুলিশের সংঘর্ষ আমার মত অনেকের কাছে অপরিচিত নয়। আমরা যারা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের উপর দৈনিক পত্রিকা গুলোর হেডলাইন পড়ে বড় হয়েছি তাদের জানা আছে এর আদি ও অকৃত্রিম ইতিহাস।
২০ মিনিটের উপর খোলা আকাশের নীচে বসে থাকা সম্ভব হলোনা। সূর্যতাপের তীব্রতা ততক্ষণে সহনীয় সীমা অতিক্রম করে গেছে। সাথে বাতাসের আর্দ্রতা। শরীরের দিকে তাকাতেই খেয়াল হল, ঘামতে শুরু করেছি আমি। না, আজ আর এমনকিছু ঘটতে যাচ্ছেনা তা বুঝে নিলাম। হঠাৎ করেই রামাল্লায় আমার ট্যুর গাইড আবু আল নাসেরের কথা মনে পরল। জেরিকোর রেস্তোঁরায় বসে সে হর হর করে বলে যাচ্ছিল ফিলিস্তিনি কাহিনী। তার মতে পশ্চিম তীরের অনেককেই ইসরায়েলিরা কিনে নিয়েছে। এমনকি প্যালেষ্টাইনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে পর্যন্ত। ওদের দান-দক্ষিণার উপরই নাকি এরা বেঁচে থাকে। এ অভিযোগ হতে হানান আশরাফিকেও বাদ দেয় হলোনা। ফিলিস্তিনিদের প্রবাদ পুরুষ ইয়াসির আরাফাতের বিদেশী স্ত্রীর দিকেও আঙ্গুল তুলতে পিছপা হলোনা সে। যারা বিক্রি হতে অস্বীকার করে তাদেরই নাকি রাতের অন্ধকারে উঠিয়ে নেয়া হয়। তারপর নিখোঁজ হয়ে ঠাঁই নেয় ইতিহাসের পাতায়। আমি এদেশে এসেছি প্যালেস্টাইনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে নয়। এই এসব চিন্তা মাথা হয়ে ঝেড়ে ফেলে ট্যুরের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় যেন বাংলাদেশীয় রাজনীতির সাথে একটা সমান্তরাল খুঁজে পেলাম এখানে। কেবল ইসরায়েলের জায়গায় প্রতিবেশী ভারতে বসিয়ে দিলেই হিসাব মিলে যাবে।
বেলা বাড়ছিল। উঠে পরলাম এবং পাশেই ট্রাম ষ্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। গন্তব্য সেন্ট্রাল বাস ষ্টেশন। ওখান হতে গোলান হাইটসের দিকের বাস ধরার ইচ্ছা।
– চলবে।
loading...
loading...
পড়লাম। ফিলিস্তিন ভ্রমণ পর্ব মিস করতে চাই না মি. ওয়াচডগ। নিয়মিত চাই।
loading...
চলবে যতক্ষণ স্টক থাকবে
loading...
ভেবেছিলাম হারিয়েই গেলেন।
যাই হোক তৃতীয় পর্ব এলো। মনযোগ দিয়ে পড়লাম।
loading...
থ্যাংকু
loading...
একটা সময় যখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তাদের দুয়ার বিদেশী শ্রমিকদের জন্যে উন্মুক্ত করছিল একই ভারত তার দেশের মুসলিম জনসংখ্যাকে পুঁজি বানিয়ে ব্যাপক সুবিধা নিয়েছিল। পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক খারাপের অভিনয় করে আরব রাজা-বাদশাহদের আস্থা অর্জন করেছিল।
ঠিকই বলেছেন ওয়াচডগ ভাই। পোস্ট সুন্দর হয়েছে।
loading...
এই পর্বটিও দারুণ হয়েছে ভাই।
loading...
loading...
এই পর্বটিও পড়লাম দাদা। শুভেচ্ছা।
loading...
পড়লাম ভাই।
loading...
আপনার ভ্রমণকাহিনী পড়ে সত্যি খুব ভালো লাগলো। চলুক, সাথে আছি।
loading...