ফিলিস্তিনিদের গল্প

বিশেষ কোন প্লান না থাকায় দিনটা হোটেলে বসে কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। তাই রাতে সকাল সকাল বিছানায় যাওয়ার ইচ্ছাটাও উঠিয়ে রাখতে হল। প্যালেস্টাইনে একদিনের ঝটিকা সফরে এমনি ছিলাম ক্লান্ত, তার উপর দুদিন আগে ইসরায়েলিরা ওয়েস্টার্ন ওয়াল বরাবর ফিলিস্তিনিদের শতাধিক বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠার সম্ভাবনা ছিল। পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে পা রাখতেই বাতাসে এর গন্ধ পাওয়া গেল। ট্যুর গাইড, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, বাস ড্রাইভার সহ অনেকেই এমন একটা সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিল না। রামাল্লার মূল রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। উদ্দেশ্য খুব কাছ হতে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে অনুভব করা। ট্যুর গাইড শহরের একটা গোল চত্বরে এসে ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়াল। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালো এই এখান হতেই শুরু হয়েছিল তাদের বিদ্রোহের গল্প। ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদা।

রামাল্লা হতে জেরিকো চল্লিশ মিনিটের বাস জার্নি। ছোট মিনিবাস ধরলে আরও আগে পৌঁছানো যায়। এগার হাজার বছর পুরানো এ শহরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচাইতে বয়স্ক শহর এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সবচাইতে নীচে। মধ্য দুপুরে শহরের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী ছুঁইছুঁই করছিল। শহরের আঠার হাজার বাসিন্দাদের বলতে গেলে কাউকেই বাইরে দেখা গেলনা। ট্যুর গাইড জানালো এটাই শহরের জীবন! দিনে সাধারণত কেউ বের হয়না। সন্ধ্যা নামতেই শহরের বাজার বন্দর, ক্লাব, রেস্তোরা সব জেগে উঠে, রাস্তায় কিলবিল করে মানুষ। শহরের ভূতুড়ে রাস্তা ধরে কম করে হলেও পাঁচ কিলোমিটার হাটতে হল গাইডের কারণে। সামনে ভাল একটা রেস্তোরা আছে, এমন লোভ দেখিয়ে আমাকে সে টেনে আনল শহরের কেন্দ্রে। খা খা করছে বিশাল রেস্তোরাটা। খদ্দেরের কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু রান্নাঘরের ব্যস্ততায় কোন কমতি নেই। গ্রিলে মুরগী ও আস্ত ভেড়া পোড়ানো হচ্ছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে বিয়ে বাড়ির মেহমানদারীর প্রস্তুতি চলছে। ট্যুর গাইড জানাল সুর্যাস্তের পর রেস্তোরার চেহারা বদলে যাবে। সহজে সীট পাওয়া যায় না এখানে। খোদ ইয়াসির আরাফাতও এ শহরে বেড়াতে এলে এ রেস্তোরায় ঢুঁ মারতেন। দশজনের লম্বা টেবিলে আমাদের দুজনকে বসানো হল। মেনুর ছবি দেখে আমিই লাঞ্চের অর্ডার দিলাম।

রেস্তোরা হতে বের হয়ে আরও আধাঘণ্টা হাঁটতে হল বেথেলহামগামী বাস ধরার জন্যে। তাপমাত্রা তখনো ঊর্ধ্বগামী। কম করে হলেও ৫২ ডিগ্রী। আমি ঘামছি। বোতলের পর বোতল পানি খাচ্ছি আর হাঁটছি। এ শহর খ্রিষ্টানদেরও ঐতিহাসিক জায়গা। শহরকে ঘিরে জড়িয়ে আছে যীশু খ্রিষ্টের অনেক স্মৃতি। উত্তপ্ত মরু শহরে হাঁটছি আর শুনছি ট্যুর গাইডের বর্ণনা। এক মিনিটের জন্যেও সে ভুলে যায়নি তার কর্তব্য।

বেথেলহাম পৌছতে সূর্যের তাপ অনেকটাই কমে এলো। তাছাড়া উচ্চতাও বেড়েছে। হাল্কা মৃদু বাতাস স্বাগত জানালো যীশু খৃষ্টের জন্মভূমিতে। ন্যাটিভিট চার্চ ঘুরে আসার পর ফিলিস্তিনি একটা পরিবারের সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটানো হল অনেকটা বাধ্য হয়ে। হাঁটার জন্যে যে শক্তি প্রয়োজন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিলনা। বাড়ির বারান্দায় লম্বা একটা সোফার উপর কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিলাম।

চোখ মেলতেই মনে হল অন্ধকার নামছে পশ্চিম তীরে। পাহাড় গুলোর চূড়া আর দেখা যাচ্ছেনা। মানুষও মনে হয় লম্বা একটা দিনের পর জেগে উঠছে। এবার ফেরার পালা। পথে হেবরন শহরে কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি। ট্যুর গাইডই উপদেশ দিল, জেরুজালেমে ফিরে আমি যেন মুসলিম কোয়ার্টার ছেড়ে ইহুদি কোয়ার্টারে চলে যাই। ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নামলে লম্বা সময়ের জন্য দামেস্ক গেইট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন ওখান হতে বেরুনো খুব একটা সহজ হবেনা। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিলোনা হঠাৎ করে এভাবে পালানোর। বরং ইচ্ছা করছিল খুব কাছ হতে দেখি ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ। কে জানে, হয়ত এ বিদ্রোহ হতেই শুরু হতে পারে নতুন এক ইন্তিফাদা।

ভোর ৩টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। ইচ্ছা ছিল দশটার দিকে উঠে নাস্তা সেরে দামেস্ক গেটের সিঁড়িতে বসে চারদিকের জেরুজালেমকে দেখবো। কোথাও গোলমাল বাধলে ওখানেও যাবো। খুব কাছ হতে কিছু ছবি তুলবো।

ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে আযানের সুরে। হয়ত পাশের আল আকসা মসজিদ হয়ে ভেসে আসা আযান। জানালার পর্দা খুলে জেরুজালেমের আকাশকে দেখার চেষ্টা করলাম। ভোর হয় হয় করছে। রাস্তায় কিছু বেওয়ারিশ কুকুর এদিক ওদিক হাটতে শুরু করেছে। পাশের বাড়িঘর হতে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে গেল আকাশে। কে জানে, হয়ত ওরা উড়ে গেছে পশ্চিম তীরের শহর হেবরন, রামাল্লা অথবা বেথেলহেমে।

– চলবে

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৩ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. রিয়া রিয়া : ১০-০৮-২০১৯ | ১৩:২৪ |

    তন্ময় হয়ে পড়লাম। আশা করছি এখন থেকে সব পোস্ট আরও বেশী তথ্য থাকবে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ১১-০৮-২০১৯ | ১২:৫৮ |

      সাথে আছেন বলেই হয়ত লেখার উৎসাহ পাচ্ছি। ধন্যবাদ

      GD Star Rating
      loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১০-০৮-২০১৯ | ১৩:৪৭ |

    ফিলিস্তিনিদের গল্প পড়লাম। আশা করছি নিয়মিত করবেন। ধন্যবাদ ওয়াচডগ ভাই। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ১১-০৮-২০১৯ | ১২:৫৮ |

       সাথেই আছি!

      GD Star Rating
      loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ১০-০৮-২০১৯ | ১৩:৫৯ |

    নিয়মিত চললে নিশ্চয় পড়বো ভাই। ধন্যবাদ। 

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ১১-০৮-২০১৯ | ১২:৫৯ |

      মাঝে মধ্যে হাজির হব লেখা নিয়ে

      GD Star Rating
      loading...
  4. মুরুব্বী : ১০-০৮-২০১৯ | ১৯:২৭ |

    শুরু হয়ে যাক সদ্য ফেরা ভ্রমণের বিস্তারিত পোস্ট। পাঠক হিসেবে তো আছিই। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ১১-০৮-২০১৯ | ১৩:০০ |

      একটু সময় নিয়ে হলেও লেখা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। সাথে থাকায় অনেক ধন্যবাদ

      GD Star Rating
      loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১০-০৮-২০১৯ | ২০:৪০ |

    পর্বের স্বাক্ষী হয়ে রইলাম ভাই। চলুক নিয়মিত। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  6. আবু সাঈদ আহমেদ : ১০-০৮-২০১৯ | ২১:৪৮ |

    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  7. শাকিলা তুবা : ১০-০৮-২০১৯ | ২২:৫৪ |

    পড়তে চাই। 

    GD Star Rating
    loading...
  8. নিতাই বাবু : ১০-০৮-২০১৯ | ২৩:২২ |

    ফিলিস্তিনের অনেক ভিডিও গুগলের ইউটিউবে অনেক দেখি। কিন্তু ভাষাগত দিক দিয়ে না বোঝার কারণে অনেককিছুই জ্ঞানের বাইরে থেকে যায়। তবে এখন ফিলিস্তিনিদের গল্প আপনার সু-লেখনীয় পোস্ট থেকেই জানা হয়ে গেল।  আশা করি আপনার কাছ থেকে এরকম ভ্রমণ কাহিনী আরও বেশি করে পড়তে পারবো।  আপনেকে অনেক অনেক শুভেচছা।    

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ১১-০৮-২০১৯ | ১৩:০১ |

      মন্তব্য উৎসাহ হয়ে থাকবে।

      GD Star Rating
      loading...