বিদায় জেরুজালেম বিদায় ইসরায়েল বিদায় প্যালেস্টাইন

Dead Sea – মৃত সাগর!

হিব্রু ভাষায় ইয়াম হা-মেলাহ, যার ইংরেজি অর্থ, সী অব সল্ট। পুব তীরে জর্ডান এবং পশ্চিমে তীরে ইসরাইল। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে পৃথিবীর সবচাইতে নিচু এলিভিশনে অবস্থিত এ সাগর। মিটারের হিসাবে প্রায় ৪৩০ মিটার। কোন মাছ নেই পানিতে। নেই কোন জলজ প্রাণী। লবনাক্ততাই এর মূল কারণ, যার পরিমাণ শতকরা ৩৪ ভাগ। লবণের কারণে এখানে স্বাভাবিক সাতার কাটায়ও সমস্যা। পানিতে নামলে ভেসে থাকতে হয়। জর্ডান রিফট ভ্যালিতে অবস্থিত মৃত সাগরে পানি সরবরাহের মূল উৎসও জর্ডান নদী। ইউনিক বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক ভিড় জমায় ডেড সীর তীরে। অনেকের কাছে এটা একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অনেকে সাগরের কালো কাদামাটি চামড়ার চিকিৎসার জন্যে ব্যবহার করে থাকেন। বলাহয় মিশরীয়রা মমিফিকেশনেও ব্যবহার করেছে এই সাগরের কাদামাটি।

মাসাদার পথে জেরুজালেম হতে বেরিয়ে কিছুটা পথ যাওয়ার পরই চোখে পরে ডেড সী’র অবস্থান। দূর হতে দেখলে অনেকটা বাংলাদেশের খালের মত মনে হবে। সাগরের লম্বা উপকূল জনমানবহীন। রাস্তার দুইধারে সাড়ি সাড়ি খেজুর আর জলপাই বাগান। লবণ তৈরির কারখানার বিস্মৃতি গোট কূল জুড়ে। অনেক পরিত্যক্ত উপকূল দখল করে নিয়েছে লবণের স্রোত। সূর্যের আলো লবণ স্তূপের উপর আছড়ে পর আয়নার মত চক চক করে। ওদিকে টুরিস্টদের যাওয়া নিষেধ। লবণ ও পানির রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তীর জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল সব সিঙ্কহোল। বা গর্ত। যে কোন সময় মাটি সরে গিয়ে তৈরি হতে পারে এই গর্ত। তাই সাবধানতা অবলম্বনের জন্যে ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই টুরিস্টদের।


প্রবেশমুখে বেদুইনদের উট।

দুপুর ৩টার পর মাসাদা ফোর্ট ভ্রমণ শেষে আমাদের বাস থামল কালিয়া নামের একটা বীচে। ভেতরে এসির ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে বুঝা যায়নি বাইরের অবস্থা। বাসের দরজা খোলার সাথে মনে হল কেউ আগুনের গোলা ছুড়েছে আমাদের দিকে। এ যেন আগ্নেয়গিরি হতে নেমে আসা লাভার উত্তাপ। পানির বোতলটা হাতে নিয়ে নেমে পরলাম বাস হতে।

গাইড জানিয়ে দিল কালিয়া বীচের নিয়ম কানুন। বলে দিল যাদের ধারণা নেই তারা যেন সাতার কেটে বেশিদূর না যায়। মাথা নিচু করলে কি ধরণের বিপদ আসতে পারে তার ধারণা দিল। দৈবক্রমে চোখে লবণ ঢুকে গেলে কি করতে হবে তারও প্রেসক্রিপশন দিল। পাশেই দোকানপাট। ওখানে টাওয়েল সহ অনেক কিছুই ভাড়া করা যায়। পরিস্থিতির সামগ্রিক বিচার করে পানিতে না নামার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। একে সাতার জানিনা, দ্বিতীয়ত সূর্যের তাপে চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। ছাতার মত একটা সেদের নীচে জুতা আর গায়ের গেঞ্জিটা খুলে এলিয়ে দিলাম শরীর। ক্লান্তি এসে ভর করছে। চোখ বুজে আসছে।

একটু পর পর পানি খেতে হল। দুই লিটারের বোতলটা শেষ হওয়ার পর এক বোতল কোক কিনে ফিরে এলাম ছায়াটায়। হরেক রকম মানুষ। হরেক রকম ভাষা। তাদের সাঁতারের পোশাকও ভিন্ন। বিপদজনক বিকিনি পরিহিত ইউরোপীয়ানদের পাশেই লম্বা জুব্বা-ওয়ালা আফ্রিকান মহিলারা পানিতে মাতামাতি করছে। কালো কাঁদায় গোটা শরীর লেপটে নিয়ে ভুতের মত শুয়ে আছে সূর্যের নীচে। সদ্য পরিচিত ট্যুর বন্ধু ফ্রেঞ্চ-ম্যান পিয়ের দূর হতে আমাকে হাত নাড়াল। পানিতে নামার ইশারা দিল। মাথা নেড়ে আমিও ধন্যবাদ দিলাম। এবং পানিতে নামার জন্যে আমি যে তৈরি নই, তা জানিয়ে দিলাম। সময় গড়াচ্ছে এবং সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। আমি ঘামছি। শরীরের সাথে লেপটে যাচ্ছে আমার টি-শার্ট। সূর্য দখল নিয়েছে আমার ছায়ার জায়গাটা। উঠতে হল। পাশের বারে ঢুকে বরফের মত ঠাণ্ডা আরও এক বোতল কোক কিনতে হল। এক পর্যায়ে মন হল আমি আর পারছিনা।


সদ্য পরিচিত ট্যুর বন্ধু ফ্রান্সের পিয়ের।

নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট আগেই বাসটা এসে গেল। কেবল আমি নই, আফ্রিকা উপমহাদেশের বেশ কজন টুরিস্ট এক লাফে উঠে গেল। ওখানে বেহেস্তের ঠাণ্ডা বাতাস! আমার পাশের সীটের মহিলাকে দেখলাম বাইরের জলপাই গাছের ছায়ায় বিকিনি পরে বসে আছে। চোখে চোখ পরতে আমাকে ইশারায় ডাক দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বে আবারও নামতে হল। দুঃখ প্রকাশ করে জানাল সমুদ্র-পারের যে জায়গাটায় আমি শুয়ে ছিলাম ওখানে সে তার ব্যাগটা ফেলে এসেছে। এত রোদে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। পারলে আমি যেন হেল্প করি। করতেই হল। এটাই ভদ্রতা। সিঁড়ি বেয়ে অনেকদূর নামতে হবে। ফেরার পথে উপরে উঠতে হবে। নিজকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করলাম। জানতাম সহজ হবেনা এ যাত্রা।

বিশ মিনিট পর ট্যুর গাইড ফিরে যোগ দিল আমাদের সাথে। সবাইকে ধন্যবাদ জানাল এবং আজ ট্যুরে কি কি দেখেছি তার উপর ছোট্ট একটা লেকচার দিল। এখানেই আমাদের ট্যুরের সমাপ্তি এবং ঘরে ফেরার পালা।

চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করলাম। অবশ্য আশেপাশের বাকি যাত্রীরাও তাই করছে। বাস ছুটে চলছে জেরুজালেমের দিকে। আমি জানি এ দেশে এটাই আমার শেষ ট্যুর। আগামীকাল রাতে আমাকে ফেরার ফ্লাইট ধরতে হবে। ঘরে ফিরে ভোজবাজির মত ভুলে যেতে হবে পৃথিবীর এ অংশে কাটিয়ে যাওয়া কটা দিন। অনেকসময় হয়ত স্বপ্ন মনে হবে। এদেশে ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই। হয়ত ইচ্ছাও নেই। হয়ত হঠাৎ করেই বদলে যাবে এর চেহারা। ট্যাংক আর বন্দুকের পদভারে থর থর করবে রামাল্লার মাটি। হয়ত জেরিকো শহরের নির্জন রাস্তাঘাট ভারী হবে প্রতিবাদীদের মিছিলে। কোনকিছুরই নিশ্চয়তা নেই এ দেশে। এ অনেকটা বারুদের গোলার মত। যেকোনো সময় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে। সেদিন দূর হতে আমিও হয়ত কষ্ট পাব এই ভেবে, রক্তস্নাত এই মাটিতে আমিও হেঁটেছিলাম।

বিদায় জেরুজালেম। বিদায় ইসরায়েল। বিদায় প্যালেস্টাইন।

.
২৭শে জুলাই, ২০১৯।
______________

ইসরায়েল সফরের উপর আমার লেখাগুলো অনেকটা তাড়াহুড়ো করে লেখা। আমি জানতাম সাথে সাথে না লিখলে ঘরে ফিরে সহজে লেখা হবেনা। সবার মত আমাকেও দিনের বড় একটা অংশ কাটাতে হয় অফিসে। বাসায় ফিরলে আমার দখল নেয় ছেলেমেয়েরা। ওদের ফেলে লিখতে গেলে গিন্নীর হতো মন খারাপ। তাছাড়া অন-গোয়িং এইজিং প্রসেসে ঘটনার অনেক কিছু মনে রাখা সম্ভব হতোনা। তাই প্রতিটা ট্রিপের পর রাত জেগে লেখার চেষ্টা করেছি। নিশ্চিত করে বলা যায় আমার লেখার সীমিত পাঠকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল লেখা শেষ করায় বিরাট একটা উৎসাহ। কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট হবেনা। আমি কোন বিচারেই লেখক নই। আমার বাংলা ভাষার জ্ঞান সীমিত, কারণ ভাষা চর্চার পিক আওয়ারে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল দেশের বাইরে। তৃতীয় একটা ভাষা রপ্ত করে সে ভাষায় লেখাপড়া শেষ করতে হয়েছিল। ভাষা চর্চা খুব একটা সহজ কাজ নয়, এর জন্যে মৌলিক উপাদানের পাশাপাশি চাই জন্মগত ট্যালেন্ট। এসব অনেক কিছুর ঘাটতি আছে আমার লেখালেখিতে। কেউ না বললেও আমি বুঝতে পারি।

তেল আবিব এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছি ফ্লাইটের। পেছনে রেখে যাচ্ছি ঝটিকা সফরের অনেক স্মৃতি। সাথে নিয়ে যাচ্ছি এমন অনেক কথা যা জেরুজালেমে বসে বলতে পারিনি নিরাপত্তার কথা ভেবে। সময় করে লেখাগুলো আপডেট করার চেষ্টা করবো। সাথে থাকার জন্যে রইলো অশেষ কৃতজ্ঞতা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২০ টি মন্তব্য (লেখকের ৯টি) | ১১ জন মন্তব্যকারী

  1. ছন্দ হিন্দোল : ২৯-০৭-২০১৯ | ৮:১৯ |

    ঝরঝরে লিখা এক নিঃশ্বাসেই নিয়ে গেল শেষ অবধি।
    ভাল লাগল পড়তে। হয়ত দেখা অন্য কোন লিখায়,

    ঘরে ফেরা হোক নির্বিঘ্নে এই কামনা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫২ |

      থ্যাংক ইউ

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ২৯-০৭-২০১৯ | ৯:১২ |

    ভ্রমণের আরও কিছু প্রকাশ হয়তো রয়ে গেছে। ভবিষ্যতে লিখবেন। অপেক্ষা থাকবে।
    অভিনন্দন মি. ওয়াচডগ। আপনাকে ধন্যবাদ। হোম সুইট হোম। এখন বিশ্রাম নিন। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৩ |

      পৃথিবীটা অনেক বড় ও গোলাকার। হয়ত কোন বাঁকে দেখা হয়ে যাবে।

      GD Star Rating
      loading...
  3. আনু আনোয়ার : ২৯-০৭-২০১৯ | ১০:১৫ |

    এক নিঃশ্বাসে পড়লাম।  খুবই ভাল লেগেছে। 

    ধন্যবাদ।    

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৩ |

      সাথে থাকার জন্যে ধন্যবাদ

      GD Star Rating
      loading...
  4. সুমন আহমেদ : ২৯-০৭-২০১৯ | ১৬:৩৮ |

    অসাধারণ এই ভ্রমণ বর্ণনাটি আমার জীবনে পড়া অন্যতম সেরা হিসেবে থাকবে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৪ |

      প্রেরণা হয়ে রইল মন্তব্য। ধন্যাবাদ।

      GD Star Rating
      loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২৯-০৭-২০১৯ | ১৬:৪২ |

    জীবনের সকল অভিজ্ঞতা স্মৃতি হয়ে থাক ওয়াচডগ ভাই। সার্থক ভ্রমণ গল্প। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৫ |

      অনেক ধন্যবাদ।

      GD Star Rating
      loading...
  6. সাজিয়া আফরিন : ২৯-০৭-২০১৯ | ১৭:০৪ |

    হ্যাপী এন্ডিং। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৫ |

      এন্ড আই এম হ্যাপি!

      GD Star Rating
      loading...
  7. রিয়া রিয়া : ২৯-০৭-২০১৯ | ১৭:২৭ |

    অসাধারণ ভ্রমন বর্ণনা উপহারের জন্য আপনার প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৭ |

      ধন্যবাদ। ভাল থাকুন নিরন্তর!

      GD Star Rating
      loading...
  8. শাকিলা তুবা : ২৯-০৭-২০১৯ | ১৭:৪৮ |

    সব কয়টি পর্ব ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৭ |

      থ্যাংক্স।

      GD Star Rating
      loading...
  9. আবু সাঈদ আহমেদ : ২৯-০৭-২০১৯ | ১৮:৪১ |

    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  10. দাউদুল ইসলাম : ৩০-০৭-২০১৯ | ০:১৫ |

    জেরুকালেম আমার স্বপ্নের শহরhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif  

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ৩১-০৭-২০১৯ | ৯:৫৮ |

      মনে রাখার মত একটি শহর!

      GD Star Rating
      loading...
  11. মাহমুদুর রহমান : ৩১-০৭-২০১৯ | ২২:৫৫ |

    উট খুবই প্রতিশোধ প্রবণ প্রাণী। এটাকে একবার আঘাত করলেই হলো, নাগালের কাছে পেলে সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। 

    GD Star Rating
    loading...