মাসাদা এন্ড দ্যা ডেড সী…
আধুনিক প্যালেস্টাইনকে নিজেদের বলে দাবি করতে গিয়ে ইসরায়েলিরা ফিরে যায় তাদের অতীত ইতিহাসে। সে ইতিহাস দুই হাজার বছরের পুরানো। জুডাইজমের উত্থান, বিবর্তন ও পতনের সে কাহিনী রক্তাক্ত নির্মম ও করুণ। হ্যারড ছিলেন অধুনা অনেক রক্ত-খেকো স্বৈরশাসকদের মতই একজন ক্ষমতা-লিপ্সু কিং। যাকেই দরকার তাকেই শিরচ্ছেদ করতেন ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক ও মসৃণ রাখতে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরাম আয়েশের জন্যে বানাতেন রাজকীয় প্রাসাদ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় জেরিকো শহরের শীতকালীন প্রাসাদ ছিল তাদের অন্যতম।
হিব্রু ভাষায় মাসাদা শব্দের অর্থ strong foundation, বা শক্ত ভিত্তি। ইতিহাসবিদদের মতে জুদাইয়ান মরুর শেষপ্রান্তে প্রায় ১৩০০ ফুট উপরে মাসাদা দুর্গের গোঁড়া পত্তন করেছিলেন জনাথন দ্যা হাই প্রিস্ট হাসমোনিয়ান কিং অ্যালেক্সান্ডার জানেউস। যিনি রাজত্ব করে গেছেন সাল ১০৩ হতে ৭৬ বি সি পর্যন্ত। জেরুজালেমের অনতিদূরে ইন গেদি ও সডমের মাঝামাঝি Dead Sea’র কাছাকাছি মাসাদা দুর্গ এখন ইসরায়েলের ন্যাশনাল হ্যারিটেজ। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ টুরিস্ট দেখতে আসে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা।
কিং হ্যরড মাসাদাকে বেছে নিয়েছিলেন শত্রুর আক্রমণ হতে নিজকে রক্ষার জন্যে। হ্যারডের মৃত্যু বা অপমৃত্যুর পর জুদেয়ার দখল চলে যায় রোমানদের হাতে। মাসাদার দুর্গকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলে ওরা। ৬৬ এ,ডি’তে শুরু হয় গ্রেট ইহুদি রেভল্ট। ইহুদিরা দখল নেয় মাসাদার। এলেজার বিন ইয়ারিরের নেতৃত্বে একদল ইহুদি রোমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৭০ AD’তে রোমানরা জেরুজালেম শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। পাইকারি-ভাবে হত্যা করে ইহুদিদের। পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও ওরা রেহাই দেয়নি। জেরুজালেম যখন জ্বলছে তখন ৯৬০ জন ইহুদি আশ্রয় নেয় মাসাদা দুর্গে। ওখান হতে শুরু করে প্রতিরোধ।
জেরুজালেমের চূড়ান্ত পতন ও ইহুদিদের নির্মূল করার পর রোমানরা চোখে ফেরায় মাসাদার দিকে। জেনারেল ফ্লাভিউস সিলভার নেতৃত্ব ৮০০০ রোমান সৈন্য অবস্থান নেয় মাসাদার চারদিকে। শুরু হয় অবরোধ। মাসের পর মাস চলতে থাকে এই অবরোধ। রোমানদের জানা ছিল পানি আর খাদ্যের অভাবের কারণ ইহুদিরা নেমে আসবে পাহাড় হতে। কিন্তু তা হয়নি। চলতে থাকে প্রতিরোধ। অনন্যোপায় হয়ে রোমানরা নির্মাণ শুরু করে চূড়ায় উঠার পথ। প্রতিরোধকারীরা বুঝতে পারে ঘনিয়ে আসছে তাদের দিন। তাদের নেতা বেন ইয়াইর শেষবারের মত সবাইকে একত্রিত করে পছন্দ দেন, হয় বেঁচে থেকে রোমানদের দাস হও, অথবা আত্মহত্যা করে। ৭৩ AD’র ১৫ই এপ্রিল পতন হয় মাসাদা দুর্গের। জেনারেল সিলভার সৈন্যরা দুর্গের চূড়ায় উঠে দেখতে পায় দুজন মহিলা ও পাঁচজন শিশু ছাড়া বাকি সবাই আত্মহত্যা করেছে। ওরা দখলদারদের দাস হয়ে বেঁচে থাকতে চায়-নি। তাই আত্মহত্যাকেই অধিকতর গৌরবের পথ হিসাবে বেছে নিয়েছে। বিদ্রোহীদের শেষ পরিণতিকে সন্মান জানিয়েছিল রোমানরা।
______________________
প্রায় দুটো দিন ছিলাম হোটেলে বন্দী। গোলান হাইটসে যাওয়ার ইচ্ছাটায় ইতি টানতে হয়েছিল এর দূরত্বের কথা ভেবে। ৪ ঘণ্টার বাস জার্নি। দিনে দুইটা মাত্র বাস যায় ইসরায়েলের উত্তরে সিরিয়া সীমান্তে। একই দিনে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা না থাকায় ঐদিকটা সফরের ইচ্ছা তালিকা হতে বাদ দিতে হল। ছোট কোন শহর অথবা লোকালয়ে রাত কাটানো আমার বিচারে নিরাপদ ছিলনা অনেক কারণে। প্রথমত, যে কোন সময় ঝামেলা ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে এ দেশে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি সৈন্যদের গ্যংষ্টার টাইপ আচরণ। ওরা চাইলেই যে কাউকে খুন করতে পারে। এ অনুমতি তাদের দেয়া আছে। জেরুজালেমের পথেঘাটে অনেক সাধারণ মানুষকে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখেছি। শুট ফার্স্ট, আস্ক কোশ্চেয়েন লেইটার, এটাতে তাদের বৈধতা আছে। আরও একটা দিন হোটেলে বসে অলস সময় কাটানোর ইচ্ছা ছিলনা। অন্য কোথাও যাওয়া যায় কিনা তা পরখ করে রাত ২টার দিকে ঘুম হতে জেগে অনলাইনে অনুসন্ধান শুরু করলাম।
মাসাদা ও ডেড সী! ইসরায়েলি এসে কেউ এ দু’টো জায়গা না দেখে চলে গেছে এমনটা হয়না। আমি ভ্রমণের শুরুতেই ওখানটায় যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রামাল্লায় প্যালেষ্টাইনি গাইড আমাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। জেরিকোর ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ৫ কিলোমিটার ধকল সামলে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আবু আল নাসের সাবধান করে দিল মাসাদা ও ডেড সী’তে তাপমাত্রা ৫০-৫২’তে উঠানামা করে। সাথে আর্দ্রতা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম গোলান হাইটস যাওয়া হলে ডেড সী’র দিকে যাবনা গরমের কারণে।
শুক্রবার সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট আগে শুরু হয়। এবং চলে শনিবার সূর্যাস্তের পর যতক্ষণ না আকাশে তিনটা তারা দেখা যায়। এ সময়টা ইহুদিদের জন্যে Sabbath। ওদের ছুটি। কোন কাজেই হাত দেবেনা। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হতে শুরু করে ট্যুরিজমের অনেক কিছুই বন্ধ থাকে। অনলাইনে মাসাদা ট্যুর টিকেট কিনতে গিয়ে হতাশ হলাম। প্রায় সব ট্যুরেই বিরতি। লম্বা সময় ধরে ঘাঁটাঘাঁটির পর পাওয়া গেল একটা যারা চালিয়ে যাবে তাদের ট্যুর। অতিরিক্ত মূল্য দিতে হল এর জন্যে। সকাল সাড়ে আটটায় ট্যুর বাস আমাকে হোটেল হতে নিয়ে যাবে। ফিরিয়ে দেবে সন্ধ্যার দিকে। ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করতে সকাল ৩টা বেজে গেল। সকাল ১১টায় আমার ম্যান্ডেটরি চেক-আউট। হিসাব করে দেখলাম এখন ঘুমাতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।
খুব সকালে লম্বা মত একটা গোসল দিলাম। রুমেই রুটি ও কফির ব্যবস্থা ছিল। তাই দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। এ যাত্রায় ছবি তোলার জন্যে মোবাইল ফোন বাদে সাথে অন্যকিছু না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লবিতে নেমে আগের দিনের রিসেপশনিষ্টকেই পেলাম। খুলে বললাম আমার অবস্থা, এ মুহূর্তে নতুন কোন হোটেলে গেলে ট্যুর মিস করবো। প্রায় ৩০ মিনিট গুঁতোগুঁতির পর আমার ক্রেডিট কার্ড চাইল। পরিশোধ করে রুমে ফিরে আসলাম। সামান্য ধন্যবাদ দেয়ার যে রীতি তাও পালন করলো না মহিলা। পৃথিবীর কোন দেশেই এমনটা দেখিনি।
আসার কথা সাড়ে আটটায়, অথচ সাড়ে নটার আগে বাসের দেখা মিললো না। কোন কিছুতেই আর অবাক হচ্ছেনা। চমৎকার একটা মিনি বাস। ট্যুরিজমের জন্যে ওয়েল ইকুইপড। গাইড ইয়ায়ারের সাথে পরিচয় হল। আরও পরিচয় হল ফ্রেঞ্চ ম্যান পিয়ের ও কলোম্বিয়ান ফার্ণান্দোর সাথে। ওরাও যাচ্ছে আমার সাথে।
মাসাদার পথে সাময়িক বিরতী।
পাহাড়ের পাদদেশে ডেড সী।
ইসরাইল খুবই ছোট একটা দেশ। তাই এর এক শহর হতে অন্য শহরে যাওয়ার দূরত্ব খুব একটা বেশী না। মাসাদা পৌঁছতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে এমনটাই জানিয়ে দিল ট্যুর গাইড। ট্যুরের বিস্তারিত জানিয়ে ও ড্রাইভারের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে রওয়ানা দিলাম নতুন গন্তব্যে। প্রথমে মাসাদা ও ফেরার পথে ডেড সী।
পাহাড় ও সাগর। ওপারে জর্ডান।
চল্লিশ মিনিট পর বাস হতে বেরুতেই আগুনের গোলার মত চোখে মুখে আঘাত হানল চারদিকের বাতাস। পথে পাহাড়, এক পাশে ডেড সী, আর পাহাড়ের চূড়ায় সেটল্যারদের বাড়িঘর, সব মিলিয়ে সেলুলয়েডের ফিতার মত দৃশ্যপটে ভেসে উঠল চারদিকের প্যানোরমা। মাইলের পর মাইল খেজুর আর জলপাই বাগান। ফাঁকে ফাঁকে বেদুইনদের বস্তি, আঙ্গিনায় ক্লান্ত উটদের নিদ্রা, ডেড সী হতে লবণ তুলে আনার সরঞ্জাম; হুট করেই কেটে গেল সময়টা। মাসাদার পাদদেশে এসে থামার পর আন্দাজ করতে পারলাম এর বিশালতা।
একটা ক্যাবল কার যাচ্ছে উপরে। ওটা ধরতে হবে। গাইড জানিয়ে দিল পানি ছাড়া ওখানটায় যাওয়া হবে আত্মঘাতী। দুই লিটারের একটা বোতল কিনে বগলে চাপিয়ে উঠে বসলাম কেবল কারে। সাবাথ হলেও টুরিস্টদের অভাব দেখলাম না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে ওরা আসছে। ৮০’র দশকের পিটার ও’টুল অভিনীত মাসাদা টিভি সিরিজের কারণে এর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। মিনিট দশেকের ভেতর পৌঁছে গেলাম চূড়ায়।
মাসাদার চূড়ায়।
পানির অন্য নাম যে জীবন, এখানে না এলে ধারণা করা যাবেনা।
উপর হতে পৃথিবীটা এত সুন্দর দেখায় না দেখলে বুঝা যাবেনা। তিনদিকে জুদিয়ান মরু। সামনে ডেড সী। তার ওপারে জর্ডান। হঠাৎ করে পেরুর মাচুপিচুর কথা মনে পরে গেল। ২০০২ সালে দেখ পেরুর ঐ পাহাড় ছিল কাব্যময়। হাতের কাছে মেঘমালার ঘোরাফেরা। পাহাড়ে সবুজের সমাহার। এখানটায় ঠিক উলটো। তাতানো মরু আবহাওয়া। মাথার উপর জ্বলন্ত চুলার মত সূর্য। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। নগ্ন এবং ক্ষমাহীন। একবার কেউ পথ হারালে মৃত্যু তার অবধারিত।
ইতিহাসের কোন পাতাই উলটানো বাকি রাখল না আমাদের গাইড। জুদাইজম ও এ মাটিতে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক মালিকানা তত্ত্বও বাদ গেলনা। সন্দেহ নেই দুই হাজার বছর আগে এ মাটিতে ইহুদি রাজত্ব ছিল। কিন্তু অনেক সভ্যতার মত সেটাও ধ্বংস হয়েছিল, যাতে মুসলমানদের কোন হাত ছিলনা। এ মুহূর্তে মাসাদায় হরেক রকম মানুষ একত্রিত হয়েছে, অথচ নেই একজন প্যালেষ্টাইনি। ওরা দেয়ালের ওপাশে বন্দী। রোমানরা যেভাবে ইহুদিদের দাস বানিয়েছিল, একই কায়দায় ইহুদিরাও আজকে প্যালেষ্টাইনি মুসলমানদের দাস বানাতে চাইছে। এ সত্য ও বাস্তবতাটা এক মুহূর্তের জন্যে মাথা হতে দূর করতে পারলাম না।
ক্যাবল কার ধরে ঘণ্টা দুয়েক পর নেমে আসলাম মাসাদার চূড়া হতে। পাহাড়ের গোড়াতেই বাফে। ৭০ স্যাকেল খরচ করে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। সাথে অতিরিক্ত দু’বোতল কোন নিলাম পরবর্তী গন্তব্য ডেড সী বীচের জন্যে। ওখানে আরও গরম। প্রচণ্ড অসহনীয় গরম। ডেড সী – সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪৫০ মিটার নীচে। পৃথিবীর সর্বনীচু স্থান।
.
জেরুজালেম। ২৭শে জুলাই, ২০১৯।
loading...
loading...
ধারবাহিকটির প্রতি দুর্নিবার এক আকর্ষণ জন্মে গেছে। অপেক্ষায় থাকি আপনার পোস্ট কখন আসবে। বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি। যদিও আপনার লিখা আগে থেকেই ভালো লাগে।
loading...
পড়লে জানা যায়। ধন্যবাদ মি. ওয়াচডগ। শুভ সকাল।
loading...
ভ্রমণ বৃত্তান্তটি পড়া আমার জন্য এক ধরণের মোহগ্রস্থতার মধ্যে পড়ে গেছে।
loading...
অভূতপূর্ব ধারাবাহিক। মনে হচ্ছে শেষের দিকে চলে এসেছেন। শুভেচ্ছা রইলো।
loading...
পড়ে নিলাম।
loading...
ঋদ্ধ হলাম আপনার ভ্রমণ কাহিনি পড়ে। দিন সুন্দর হোক।
loading...
খুউবি ইচ্ছে ভ্রমণের এই অংশ যেন পড়া হয়। ইচ্ছে পূরণ করলেন। ধন্যবাদ।
loading...
ডেড সীর ইতিহাস কি আপনার জানা আছে?
loading...