পুরানো জেরুজালেমের মুসলিম কোয়ার্টার ছেড়ে আজ নতুন জেরুজালেমের ইহুদি এলাকায় আসতে হল। আল হাশেমি নামের যে হোটেলটায় এতদিন ছিলাম তাতে আমার জন্যে খালি রুম পাওয়া যায়নি। গন্তব্যের অনিশ্চয়তার কারণে একরাতের বেশি কোথাও হোটেল বুক করিনা। যদিও একরাতের কথা বলে ঢুকি এবং পরেরদিন তা নবায়ন করি। এভাবেই চলছিল। আজ সকালে কাউন্টারে যেতেই পেলাম খবরটা। হোটেল বুকড! রিসিপশনিষ্ট সাজেষ্ট করলো পাশের আল-আরাবি হোটেলে খোঁজ নিতে। লাগেজ গুটিয়ে লবিতে রেখে গেলাম পাশেরটায়। সকাল বাজে প্রায় ১০টা। লবির টেবিলে লম্বা হয়ে কেউ একজন ঘুমাচ্ছে। জোরে কাশি দিলাম। তাতেও কাজ হলো না। অচেনা ঘুমন্ত কাউকে ডেকে উঠানো কোন সংস্কৃতিতেই ভাল উদাহরণ না। ইসরায়েলি এসেছি নিজকে ভাল নাগরিক হিসাবে তুলে ধরতে। তাই ফিরে এলাম। আধাঘণ্টা পর ফিরে গিয়ে দেখি একই অবস্থা। এদিকে চেক আউটের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত আল হাশেমিতে ফিরে অনলাইনে খুঁজতে থাকলাম নতুন কোন হোটেল। জেরুজালেমের রাস্তাঘাট আমি চিনি না, তাই কোন হোটেল কোথায় অবস্থিত তার কোন হদিস করতে পারলাম না। সময় নেই, তাই সস্তা যেটা পেলাম সেটাই বুক করলাম। চেক-ইন সময় দুপুর ৩টা। হাতে অনেক সময়। সবাই যা করে তাই করলাম। লাগেজ গুলো আল হাশেমির স্টোরে রেখে বেরিয়ে পরলাম। আজ আর মুসলিম কোয়ার্টারে ঘোরাফেরার ইচ্ছা ছিলনা, রওয়ানা দিলাম ইহুদি কোয়ার্টারের দিকে। ওদিকটায় না ঘুরলে জেরুজালেম শহর দেখা সম্পূর্ণ হবেনা।
অনেকটা চাঁদের অন্য-পীঠের মতই পুরানো জেরুজালেমের ইহুদি কোয়ার্টার। মুসলিম এলাকা হতে হাঁটা শুরু করলে কখন যে সীমানা অতিক্রম করা হয় তা চারদিক না তাকালে বুঝার উপায় নেই। হঠাৎ করেই বদলে যায় সবকিছু। লম্বা আলখাল্লা পরিহিত আরব পুরুষদের জায়গা করে নেয় নানান জাতির ইহুদিরা। এক্সট্রিম পশ্চিম ইউরোপিয়ান সাদা, সেন্ট্রাল এশিয়ার বাদামি, আফ্রিকার কালা, পূর্ব ইউরোপের অসুখী সাদা, সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের ইহুদিদের পাওয়া যায় পশ্চিম দেয়ালের কাছে। ওদের অন্যতম পবিত্র স্থান হচ্ছে এই দেয়াল। তবে মুসলিম কোয়ার্টারের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়না। এ কোয়ার্টারে আরব মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন তার ছিটেফোঁটাও নেই। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, অথচ কেউ কথা বলছেনা। আরবদের মত অচেনা কাউকে সালাম দিচ্ছেনা। রুশ ইহুদিদের দেখলে মনে হবে ওরা তেড়ে আসবে। এখুনি জিজ্ঞেস করবে, – ইয়ব তোবায়ো মাত, পচিমু তি জদিয়েছ?
এ কোয়ার্টারের রাস্তায় নিজকে অপাক্তেয় মনে হলো। অনেকেই সন্দেহের চোখে চাইছে। আমি চোখে চোখ রাখা হতে বিরত থাকার চেষ্টা করলাম।
দুদিকের দোকানপাটেও পরিবর্তন চোখে পরার মত। সবকিছুতে ধর্মের প্রতিফলন। টুপি, হনুকা সাইন, বিভিন্ন সুগন্ধি যা হতে বেরিয়ে আসছে কটু গন্ধ। আরবদের মত গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে চীৎকার করছেনা। এক কথায় সব আছে, শুধু নেই চাঞ্চল্য, নেই উচ্ছ্বাস, নেই জীবন নিয়ে উচ্ছলতা। ওদের প্রতিটা সিনেগগে ঢু মারলাম। রাবাইদের সাথে ভালমন্দ কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও কোন রেসপন্স পেলাম না। সবাই কেমন নির্লিপ্ত। চোখের ভাষায় একটাই যেন জিজ্ঞাসা, তুমি এখানে কেন! বেশকিছু ছবি তুললাম। দুয়েকটা স্যুভেনির কিনলাম। অচেনা কাউকে থামিয়ে ছবি তুলে দেয়ার যে অভ্যাসটা মুসলিম কোয়ার্টারে প্রাকটিস করেছি এখানে তেমনটা করতে উৎসাহ পেলাম না।
মন কিছুটা হলেও বিষণ্ণ হয়ে গেল পুরানো জেরুজালেম ছেড়ে আসতে। অনেক কিছুই মিস করবো। রাস্তার হৈ-হোল্লা, দোকানীদের চীৎকার, উঁচু আওয়াজের আরবি গান, মধুর সুরের কোরান তেলাওয়াত। বিশেষ করে মিস করবো সকালের আজান। এই পরিবেশ এই কোলাহল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নস্টালজিক বানিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা ঢাকায়।
নতুন হোটেলটা নতুন শহরের খুব চকচকে একটা জায়গায়। দেখলেই বুঝা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে ততটা অনিশ্চয়তা নেই যতটা দেখেছি পূর্ব জেরুজালেমে অথবা পশ্চিম তীরের রামাল্লায়। হোটেলের মূল ফটকেই মেটাল ডিটেক্টর। অনেকটা এয়ারপোর্টের লাগেজ চেকিং’এর মত। লাস্যময়ী এক তরুণী দাঁড়িয়ে মনিটর করছে সবকিছু। ভদ্রতার হাসি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলাম। উত্তরে কিছুই বললো না। আমিও আর কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম না। কাউন্টারে একই অবস্থা। হোটেল ব্যবসার চিরাচরিত আপ্যায়ন একেবারেই অনুপস্থিত। কাগজপত্র দেখার আগেই জানিয়ে দিল, চেক-ইন’এর এখনো আড়াই ঘণ্টা বাকি। কথা যা বলার তখনি বলবে।
বিশাল একটা লবি। আধুনিক সুবিধাদির সুখময় সমাহার। আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আশপাশের মানুষদের। ভুলে যেতে চাইলাম ওদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত আমি। না চাইলেও আমার মার্কিন পরিচয়টা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। বলতে ইচ্ছা করলো…হতে পারি আমি জন্মগত মুসলিম, আমাকে তোমরা অপছন্দ করতে পার, কিন্তু ভুলে যেওনা আমার ট্যাক্সের টাকায়ই তোমাদের লালন করা হয়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে আমার দেশই তোমাদের নিরাপত্তা দেয়। যদি ঘৃণা করতে চাও, তাহলে প্রথমে আমার ট্যাক্সের টাকাকে ঘৃণা কর।
চারদিকে অদ্ভুত সব সুন্দরীদের চলাফেরা। ওরা হিব্রু ভাষায় নিজেদের ভেতর কি বলছে বুঝতে পারছিনা। কারও কারও কোমরে দুই দুইটা পিস্তল। আসলে জীবন কোথাও থেমে থাকেনা। ওরা যেমন নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে চাইছে, তেমনি মুসলমানরাও নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতি বজায় রেখে চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। আমরা বাইরের মানুষরা সব সময়ই চাইবো শান্তি আসুক এ ভূমিতে। মিলেমিশে বেড়ে উঠুক ওদের শিশুরা। অনিশ্চয়তার বেড়াজাল হতে বেরিয়ে নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হোক।
জেরুজালেম। ২৬শে জুলাই।
loading...
loading...
আমরা বাইরের মানুষরা সব সময়ই চাইবো শান্তি আসুক এ ভূমিতে। মিলেমিশে বেড়ে উঠুক ওদের শিশুরা। অনিশ্চয়তার বেড়াজাল হতে বেরিয়ে নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হোক।
—————————————————————
তবে তাই হোক।
loading...
ভ্রমণে আনন্দময় হউক
সতত শুভ কামনা
loading...
আমেরিকা ইসরায়েলকে ২০০৪ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সাহায্য করলেও সেটা বন্ধ করে এখন যা দেয় তার সবই মেলেটারী সাহায্য এবং তা লোন হিসেবে। বিশেষতই আমরা জানি সাহায্য আর লোন বা ধার এক জিনিস নয় কারন ধারের টাকা একসময় সুদের সাথে সার্ভিস বা ডিপ্রিসিয়েশন কস্ট সহ ফিরিয়ে নেয় এবং একটু ঘাটলে দেখবেন যে ইউএস এইডের লোনের ওপর যে সুদ সেটা জারকা বা আইএমএফ অথবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে বেশী। ইসরায়েল সেই লোন ফিরিয়ে দেবার সাথে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা তথা জঙ্গি বর্বর আরব মুসলিমদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়ও মোসাদের মাধ্যমে। সৌদী আরব পাকিস্তান সহ বেশ কিছু কট্টর মুসলিম দেশও তাদের সহযোগিতা পেয়ে আসছে এখনো।
ওদিকে প্যালেস্টাইনকে ২০১৮ পর্য্ন্ত প্রচুর সাহায্য দিলেও হিজবুল্লাহ সহ জঙ্গি মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও কুতসা এবং নিমকহারামীর কারনে তারা এ বছর বন্ধ করে দেয় এবং তা নিয়ে প্যালেস্টাইন মুসলমানদের মর্সিয়া ক্রন্দনের অন্ত নেই। এটা অবশ্য ভালো দিক আপনি যার কাছ থেকে টাকা নেবেন তাকেই বোমা মারবেন জিহাদের নামে… খুব কুল এটা, তাই না?
loading...
অবশ্য একটা জিনিস দেখে ভালো লাগলো ইহুদীরা নিজেদের দেশে থেকেও মুসলমানদের ইনঘিমাস তথা আমাদিয়া ইশতিশাদীর কারনে নিরাপদ না। তক্কে তক্কে থাকতে কখন তাদের ওপর ফিদায়ী অভিযান পরিচালিত করে। ওদিকে মুসলমানরা কত প্রানোচ্ছ্বল। তাদের জন্য আলাদা কোয়ার্টার এলাকাও দিয়েছে।
একেই বলে কল্যাণমূলক রাস্ট্র। যদিও আপনি যে দেশের পাসপোর্ট লিখেছেন সে দেশের সুযোগ সুবিধা নেবার পরও অনেক নীতির সাথে একমত নন… এটা একটা ভালো দিক
loading...
অসাধারণ লাগলো আজকের এপিসোড। অজানা ছিলো কিছু ইতিহাস। প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় অভিভূত তো হলামই সাথে সাথে জেনেও নিলাম অনেক কিছু। ধন্যবাদ ভাই।
loading...
হাতে একটু সময় হতেই চলে এলাম আপনার পোস্টে। অসাধারণ বর্ণনা।
loading...
সচক্ষে দেখা যতসব তথ্য উঠে আসছে আপনার ভ্রমণ প্রকাশে, অসাধারণ একটি প্রকাশনা দাঁড়িয়ে যাবে আশা করি। আমার একান্ত বিশ্বাস। শুভেচ্ছা ভাই।
loading...
খুব মনযোগ দিয়ে পড়ে চলেছি দাদা।
loading...
লিখাটি এতোটাই সবিস্তার যে, মনে হলো চোখের সামনেই দেখছি।
loading...
loading...
অনিশ্চয়তার বেড়াজাল হতে বেরিয়ে নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হোক।
এটাই সকলের প্রত্যাশা।
loading...