খুব ছোট্টবেলা থেকেই আমি একটা গাছ খুঁজতাম, নিজস্ব গাছ। আমাদের পুরনো ঢাকার বাসাটাতে তখন এমন কোনো গাছ নেই যে ছিল না। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা এমন কি কলা গাছ পর্যন্ত। কলা গাছের ঊর্ধ্বমুখি বিস্তার আর সজীব রঙ আমাকে বেশ লোভাতুর করত ওকে আপন করে নেবার জন্যে। কিনতু দেখতাম ফল দেবার পর ওকে বেশীদিন আপন করে রাখা যায় না, একেবারেই মিইয়ে যায়। আমি কাউকে বলিনি আমার এ বাসনার কথা, এমনকি ভাই হাসানকেও নয়। একা একা ঘুরতাম আমাদের বাগানে। দিনের বেলা যাকে খুঁজে পাইনি এক রাত্তিরে তাকেও পেয়ে গেলাম অকস্মাৎ।
সন্ধ্যার পর তখন প্রায়ই কারেন্ট চলে যেত। আমাদের জন্যে বরাদ্দ ছিল রাত ন’টা থেকে দশটা পর্যন্ত বিটিভি দেখা। ওটুকু সময়ের মধ্যেই আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিতাম, কেননা টিভিতে তখন চলত আমার প্রাণের ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক উয়োম্যান, ম্যাকগাইভার, দ্য এ টিম এইসব সিরিজ। আমরা তখন এইসব হলিউডি নায়ক নায়িকার জীবন যাপন করতাম স্বপ্নে। তো এমনি এক রাতে আমাদেরকে হতাশ করে দিয়ে কারেন্ট চলে গেল রাত ন’টায়। মনে প্রবল কষ্ট নিয়ে আমরা তখন বারান্দার সিঁড়িতে বসে ভাইবোনেরা সব গল্প করার ছলে কারেন্টের ফিরে আসবার অপেক্ষায় আছি। উঠোনে আমার আয়া মা’র পাতা চৌকি। আয়া মা’ও গরমে হাসফাঁস করছে চৌকিতে শুয়ে। আমি তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তীব্র সুন্দর এক ঘ্রাণে। চোখ মেলে দেখলাম, একরঙা জ্যোৎস্নার চাদর ছড়িয়ে আছে আমার গায়ে, আশেপাশে। শুধু ক’টা গাছের নীচে ছোপছোপ উদাস জ্যোৎস্না আমার চারপাশটাকে কেমন অপার্থিব করে রেখেছে। কেন জানিনা ঐ মূহুর্তে সব শব্দ, সব কোলাহল কোথায় গিয়ে লুকিয়েছিল! সেই সময় বাদামওয়ালার হাঁকডাক ছিল না, পাশের বাড়ীর শিরিন, মুক্তিদের চীৎকার করে নামতা মুখস্তের মহড়া ছিল না, ছিল শুধু নৈঃশব্দ। আর ছিল সেই তীব্র সুন্দর গন্ধ। আমি পাগলের মত চৌকিতে উঠে বসলাম। পাশ থেকে আয়া মা আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ডররাও কিও, আমি আছি ন!’ আমি জিগ্যেস করলাম, মা ও মা, এটা কিসের গন্ধ? এত সুন্দর!’ মা হেসে বল, ‘ইতানের নাম ছাতিম ফুল রে মাইয়া।‘
সেই থেকে আমার নিজের গাছ হয়ে গেল ছাতিম গাছটা। ওটা এত্ত বড় ছিল যে ওকে কখনো আমি জড়িয়ে ধরতে পারিনি সম্পূর্নভাবে। তারপরও ওর গায়ে আমি হাত বুলাতাম সময়-অসময়ে। এরপর থেকে আমাদের আড্ডার স্থান হয়ে গেল ছাতিম তলা।
স্কুলগুলোতে তখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। পুরো মহল্লা জুড়ে আমাদের হৈ হল্লা। গরম এলে কিছু কিছু মানুষ নাকি পাগল হয়ে যায়। আমাদের ঐ সময়কার অবস্থা ছিল তেমনই। আমরা সব যেন পাগল হয়ে যেতাম। আমি তখন ঠিক কোন ক্লাসে পড়ি মনে নেই। শুধু মনে আছে নূর আসিয়া তখন দশ/এগার বছরের বালিকা। আমাদের মেয়ে গ্রুপের সব চেয়ে ছোট সদস্য নূর আসিয়া, ওর চেয়ে আমি কয়েক মাসের বড়। বাকীরা আমাদের চেয়ে কেউ এক, কেউ দুই, এমন কি তিন চার বছরের বড়রাও আছে এবং বড়রা অনেকেই তখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আসলে তখন পুরনো ঢাকার মেয়েরা পড়াশোনায় একটু পিছিয়েই ছিল। পুরো মহল্লায় শিক্ষিত পরিবার ছিল মাত্র দু’টো। একটা জুয়েলাদের বাসা আর অন্যটা আমাদের। তো দেখা যেত ছুটির দিনগুলোতেও জুয়েলা পড়ছে কিনতু আমি ছিলাম রাজ্যের ফাঁকিবাজ। আমি কোনো রকমে সকালের পড়া শেষ করে বেলা ১০ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়তাম পাড়া বেড়াতে। আমার ভাই হাসান আর অন্য ছেলেরা আমাকে নিয়ে চলে যেত বলিয়াদি বাড়ী। বলিয়াদি বাড়ীটা ছিল বিশাল, প্রায় তিন চার বিঘা জুড়ে। আমাদের এই দিকে পাকিস্থান মাঠ আর ভেতরের দিকে বংশাল হয়ে মাহুতটুলি। বলিয়াদি বাড়ীর পেছনের অংশ ছিল পাকিস্থান মাঠের দিকে, সামনেটা মাহুতটুলি। ওদের বাড়ী যেতে হলে অনেক রাস্তা পেরিয়ে মাহুতটুলি হয়ে তবেই ও বাড়ীতে ঢোকা যায়। কিনতু আমরা এই পেছন দিক দিয়েই দিব্যি পাঁচিল গলে ঢুকে যেতাম ওদের বাড়ীতে। এই পেছন দিকটায় নেই এমন কোনো গাছ ওদের ছিল না। আম, জাম, পেরায়া, কাঁঠাল এসব তো ছিলই তবে কি না ওসব গাছ আমাদেরও ঘরে ঘরেই ছিল। ছিল না যে ফল সেটা হল তুঁত ফল। অনেকটাই দেখতে রাশিয়ান ব্ল্যাক বেরির মত, আর স্বাদেও তেমনি টক-মিষ্টি। বড়রা বলত, ওসব খেলে পাগল হয়ে যায়। আমরা তাই কাউকে না জানিয়ে ও বাড়ীতে ঢুকতাম। আর সুবিধার বিষয় ছিল বলিয়াদি বাড়ীতে কেউ থাকত না, পুরোই পোড়ো বাড়ীর মতন প্রানবান প্রানহীনতায় বসবাস করা এক প্রাসাদবাড়ী। কিনতু অসুবিধার বিষয় ছিল ও বাড়ীতে একটাই লোক থাকত, ওদের বুড়ো পাহারাদার। ওহ সেই এক লোক ছিল। যেমন কর্কশ ওর গলা, তেমনি বিশ্রী তার ব্যাবহার। যদি কোনোদিন ও তোমাকে ধরতে পারল তো বোঝো, সারাদিন ঐ জঙ্গলে বেঁধে তো রাখবেই আবার বাপ মাকে ডেকে বাপের মারটুকুও ভালভাবে খাইয়ে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করাবে যেন এ জীবনে আর কখনো ওমুখো না হও আর সত্যিই একবার যে ওর মার খেত সে আর দ্বিতীয়বার ও বাড়ীতে ঢোকেনি তাই আমরা ও বাড়ীতে ঢুকতাম লিস্টেড কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে। এমন কি আমার ভাই হাসান আমাকেও কখনো ঐ জঙ্গলে নামতে দেয়নি। ছেলেবেলায় পোলিও হয়ে আমার একটা পা এমনিতেই কমজোর। কে জানে ঠিক সময়ে দৌঁড়ুতে না পারলে তো ধরা। সে কারনেই আমি থাকতাম পাঁচিলের উপর বসে পাহারায়। ওরা ভেতরে গিয়ে ছিঁড়ে আনত সেই মিষ্টি মধুর রসে মাখা ফল। হাসান তখন পকেট ভরে ওগুলো এনে আমার কোঁচড়ে ঢেলে দিয়ে যেত আরো আনতে। আমাদের দুই ভাইবোনের চেহারা ঐ মূহুর্তে যদি কেউ দেখে থাকে তো সে জানে সুখ স্বর্গে নয় এই মাটির পৃথিবীতেই আছে। আমরা বড় হবার আগেই ঐ গাছ ওরা কেটে ফেলেছিল। আজো আমি আর হাসান মনে মনে ঐ ফলগুলোকে খুঁজি।
পেটভরে তুঁতফল খেয়ে ভাইরা চলে যেত সিনেমা হলের দিকে বেলা ১২টা থেকে মর্নিং শো দেখবে বলে আর আমি চলে যেতাম মেয়েমহলের দিকে। ছুটির সকাল তখন কেবল শুরুর দিকে।
তেমনই এক ঝকঝকে সকালে সূর্য্যিটা সবে এঁকেবেঁকে মাথার উপরে গিয়ে বসবার জন্যে একটা যুতসই জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আরো পশ্চিমের দিকে ঢলে যাচ্ছে। আর আমাদের কচি চামড়া ফুঁড়ে ঘামের রোঁয়া বেশ চিকন ধারায় অলরেডি ফুটে বেরুতে শুরু করেছে। এমন মধুর এক দুপুর লাগা সকালে দেখলাম নূর আসিয়া ছুটে আসছে। ওর পরনে কমলা রঙের কুঁচি দেয়া ইজের আর গায়ে একটা ভেজা গামছা এক হাতের নীচ দিয়ে বেরিয়ে অন্য কাঁধের উপরে ফেলে দেয়া। গরম এলেই নূর আসিয়ার এই বেশ। গরমে নাকি ওর অনেক কষ্ট হয় তাই ও তার গামছাটা ঘন্টায় ঘন্টায় ভিজিয়ে গায়ে মেলে দিয়ে রাখে। ও এসেই কলকল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘অই তরা হোন, আইজকা রাইতে আমার বিয়া, আমি যামুগা, তগো লগে আর আহুম না।‘ শুনে সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম, কছ কি! সেদিন সারাদিন আমরা নূর আসিয়াকে স্পেশাল ট্রিট দিলাম মানে গাছের কষ্টি পেয়ারাগুলোর মধ্যে যেটা একটু কম কষ্টি সেটা ওকে দিলাম, পুতুলের যে মালাটা ও পছন্দ করেছিল সেটা আমি ওকে অম্লান বদনে দিয়ে দিলাম। আমাদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে তা’ও দলের সব চেয়ে ছোট মেয়েটির। আমরা বিচ্ছেদ বেদনায় অস্থির আবার খুশীও। ‘বিয়ে’ শব্দটা শুনলেই তো কেমন খুশী খুশী লাগে, তাই না!
আমরা মুখহাত ধুয়ে পড়তে বসেছি। আশেপাশের বাড়ীতে কোরাস করে অন্যরাও পড়ছে।
শিরিনের বিয়েটা হল আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে ম্যাচুউরড অবস্থায়, সতের বছর বয়সে। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী, দলের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিতা। কাজে কাজেই সবার কাছে আমার দামটা একটু অন্য ধরনের। বৌভাতের পর শিরিন নাইওর এসেছে। আর আমরা সবাই ওকে ঘিরে বসে আছি বাসরঘরের মিঠে স্মৃতিকথা শুনব বলে। শিরিন ফিসফিস করে তখন বলছে, ‘এরপর সবতে বাইর হইয়া গেছে ঘর থিকা আর হেয় ঘরের দরজা দিয়া আয়াই আমার পাও ধইরা দিল একটা টান। আমি ডরে কাঁইপা উঠছি আর ওই করল কি পকেট থিকা একজোড়া সোনার বিছা আমার পাওয়ে বাইন্ধা দিয়া কইল, এমুন সুন্দর পাও জমিনে ফেলবা না। আমি সরমায়া গিয়া আস্তে কইরা কইলাম, তয় কই ফেলমু? ওই হাইসা দিয়া কইল, কেলা আমার বুকে ফেলবা, ফেইলা লৌরাইবা, ফালাইবা, যা মন তাই করবা আর তুমারে এমতে কইরা সোহাগ দিমু। কইয়াই হেয় আমার পায়ে একটা চুমা দিল আর আমার মেন্দি দেওয়া পাও ঘুরায়া ঘুরায়া দেখতে লাগল। তুবা তো আমার পাওয়ে নেলপলিস দিয়ে আট কইরা দিছে, সবই হেয় ভালা কইরা দ্যাখতাছে আর এই দিকে আমার মাথার ভিতর তখন কেমুন জানি করতাছে, সইল ঝিমঝিম করতাছে। আমি ঐ সুময় বহুত খুসী হইছি, কেলা কি তরা তো দেখছস তগো দুলাভাইরে। ক’ অক্করে ইলিয়াস কাঞ্চনের মতন লাগে না অরে দ্যাখতে?’ আমরা ‘হুঁ হাঁ’ করে উত্তর দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে সবাই তখন বিবাহিতা, কেউ কেউ বাচ্চার মা। নূর আসিয়ার মেয়েই তো তখন আমাদের আঙ্গুল ধরে হাঁটে। শুধু আমারই তখনো বিয়ে হয়নি। আমি শিরিনের বাসরঘরের সিন্দুক খুলে অজানা জড়োয়াগুলো তখন লোভীর মত গিলছি, আহা বিয়ে না জানি কি জিনিষ! বাসায় ফিরেই তাই সোজা মার কাছে গেলাম। ঘরে তখন অন্য ভাইবোনেরা আড্ডা দিচ্ছিল। আমি মাকে গিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা মা আমার যে বয়েস হচ্ছে তা তো দেখছ। কই আমার বিয়ের জন্যে তো তেমন কিছু করছ না, ছেলে দেখছ না! দেরী হয়ে গেলে ভাল ছেলে আর কি করে পাবে?’ মা তো মা, ভাইবোনেরা পর্যন্ত অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাল ধরার ব্যাপারে মা’র জুড়ি নেই, মা মুখ টিপে একটু হেসে বলল, ‘আরে তোর মনমত বর না পেলে বিয়ে দেই কি করে বল!’
বিয়ে পাগল মেয়ে ছিলাম বলেই কি না আমার বিয়েও হয়ে গেল ইন্টারমিডিয়েটের পর পর। আমার উপর দিয়েও অনেক জল গড়াল। এরই মধ্যে শুনতাম, শিরিনের সোনার দোকানী বরের আরো অনেকগুলো দোকান হয়েছে তাঁতীবাজারে তবু পর পর তিনটে মেয়ের জন্মদানের কারনে সে নিজেই কুন্ঠিত হয়ে আছে শ্বশুরবাড়ীতে। ওদের বাড়ীর উঠোনটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল ওর যৌতুকের যোগান দিতে। নিজের মেয়ে তিনটের কথা ভেবেই বোধকরি শিরিন পরবর্তীতে দারুন হিসেবী হয়ে উঠেছিল। সে কারনেই বড় হয়ে ওর দেখা কদাচিৎ পেয়েছি। তার তুলনায় বরং নুর আসিয়ার সাথে দেখা হত বেশ। ও তখন এক মেয়ে নিয়ে চলে এসেছে বাপের বাড়ী কারন ওর স্বামী ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে পড়েছিল শেষের দিকে। এবং এক সময়ে মারাও গেছে। মুক্তি, শিরিন, রানী ওরা আমাকে পরবর্তীতে দেখলে যেমন জড়োসরো হয়ে পড়ত নুর আসিয়া তাদের তুলনায় ছিল স্মার্ট। আমাকে দেখলেই এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে পড়ত আর হড়বড় করে অনেক কথা বলত। আমি আড়চোখে নুর আসিয়ার মেয়েটাকে দেখতাম, আহা কলা গাছের মত মেয়ে, বাড়ছে তো বাড়ছেই। আমি বলতাম, ‘নুর আসিয়া একে যেন অত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিস না!’ শুনে নুর আসিয়াও শিউরে উঠে বলত, ‘ না না বইন দোয়া কইরো, আমি য্যান অরে তোমগো মতন শিক্ষিত করতে পারি।‘
পেরেছিল নুর আসিয়া, মেয়েকে কলেজ অব্দি পড়াতে। আরো হয়তো পারতো কিনতু মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সুন্দর এক সকালে নুর আসিয়া হার্ট এটাক করে পাড়ি জমালো মৃত্যুর দেশে। পরবর্তীতে ওর মেয়েটির কি হয়েছিল জানিনা। জানতে খুব ইচ্ছে করে। হয়তো একদিন জানতেও পারবো তখন না হয় বাকী গল্পটুকু শেষ করবো। আজ এটুকুই থাক, কি বলো!
loading...
loading...
খুব সুন্দর লিখন ।
loading...
অদ্ভুত আপনার লিখন শৈলী প্রিয় কবিবন্ধু শাকিলা তুবা। তন্ময় হয়ে পড়লাম। অসাধারণ।
loading...