বন্দী বিনিময় শুরু হয়ে গেছে। একজন আসবে, একজন যাবে।
দূরে বিস্তীর্ণ ভূমি, কি দারুণ বিস্তৃত। রোদ থেকে ঝলসে উঠছে কাকলী, প্রাণের কাকলী। বাতাসে শিস দিচ্ছে দুলে ওঠা কচি ধানের সবুজ। নরম ভাপ ওঠা রোদ। লোকটা বারান্দায় বসে এসব দেখে আর ভাবে, ভাবে আর দেখে। পাখির কিচিরমিচিরেও স্থির হয়ে আছে যে স্তব্ধতা সেটুকুই এখন তার সম্বল। ভালো লাগে উনার, ভালো লাগে পেরিয়ে আসা একটা জীবন।
কত বয়স ছিল যখন জেঠুর পিঠে চড়ে নিজেকে তুর্কী বীর সৈনিক মনে হতো? ভাবতেন বিশাল তলোয়ার ঝোলাবেন কোমরে সাথে থাকবে শিরস্ত্রাণ। কিংবা কোরবানীর হাটে বাবার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে পশু নির্বাচন! ঈদ আসতো যেন অসহ্য এক খুশী নিয়ে। গোলাম রহমান, আতাউল্লাহ, মাঈদুল সবাই আসতো ঈদের নামাজ শেষে। বীরেনটাও আসত। কেউ তো বলেনি কখনো, ‘ওরে বীরেন তুই এলি কেন, তুই না হিন্দু?’ মা বসে থাকতো হরেক রকমের খাবার আগলে। দাওয়ায় পা লম্বা করে পিঠ সামনের দিকে ঈষৎ বাঁকিয়ে আলুথালু বসে থাকা মায়ের সেদিন আর অবসর হতো না ওভাবে বসে জিরোবার। বাবা, দাদু, জেঠুর রসনা তৃপ্ত হলে ফের ওদের নিয়ে ব্যাস্ত হতো মা। সরু চালের ভাত আর গরুর গোশতের ঝাল তরকারী, খাসীর গোশতও থাকতো বীরেনের জন্য সাথে কত রকমের পিঠা, কত তার নকশা। খেতে খেতেও উনারা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তখন উনার বয়স ছিল কত?
এরপরে এক সময়ে গ্রামের এই বাড়ী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমানো। ততদিনে দাদু, জেঠু নেই। ততদিনে উনি জানেন তলোয়ারের চেয়েও ধারালো এ.কে ফোরটি সেভেন। কাঁধ আঁকড়ে ঝুলে থাকে কাটা রাইফেল অথবা কোমরে শোভা পায় পিস্তল, উনি জানেন। জেঠুর প্রয়োজন এখানেই শেষ হয়ে যায় অন্য কোনো জীবন শুরুর বিনিময়ে। হলের জীবন তো সহজ জীবন নয় কেবল বাড়ীর বড়দের শাসনের কঠোরতা নেই এখানে। অবাধ স্বাধীনতা। কত মিছিল, কত মিটিং। ইউনিভার্সিটির ক্লাসই জীবনে মুখ্য নয় উনি জেনে যান গ্রামের চেয়েও বড় এক জীবনে উনি ঢুকে পড়েছেন। তিনি উৎফুল্ল, তিনি আনন্দিত। গোলাম রহমান বা আতাউল্লাহর কাঁধে হাত পেঁচিয়ে যেভাবে মাঠ ঘাট চষে বেড়াতেন, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতারের কম্পিটিশন দিতে দিতে প্রাণপনে একে অপরকে ডেকে উঠতেন বন্ধু বন্ধু বলে। এখানে জীবন তেমন নয়। এখানে আছে প্রিন্স, অভি, মামুন যারা সবাই ওর দোস্ত। এখানে গলা জড়িয়ে ধরা নেই। প্রাণ দিয়ে বন্ধু বলে ডেকে ওঠা নেই। ওসব করে ক্ষ্যাতরা, উনি এখন সব জানেন। পকেটে টাকা না থাকলেও যাও আজিজ সুপারে, খেতে হলে মৌলী, সিলভানা নাহলে আড্ডা দাও মধুর ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া বা ক্যাম্পাস শ্যাডোতে, ডাস বা টিএসসিতে। টাকা ভূতে যোগায়, টাকা অস্ত্রের জোর জোগায়।
কেমন কেমন করে জীবনের এই সময়টুকুও তার পার হয়ে যায়। চুকে যায় পড়াশোনার পাট। ঝুটা কাপড়ের ব্যাবসাতেও বাতাস লাগে যেন। দোস্তদের সাহায্য নিয়ে কি করে টিকে থাকতে হয় উনি জানেন, জেনে যান। অন্যের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হয় ব্যাবসা তিনি জানেন। টেন্ডারে কিভাবে জিতে নেয়া যায় সব অলিগলি তিনি ঠিক ঠিক জানেন। ইউনিভার্সিটির জুনিয়র, রূপবতী মেয়ে দিনাও হয়ে যায় তার ছায়া। এরপরে কি আর পেছন ফিরে তাকায় কেউ? বড় ভাইকেও নিয়ে নেন নিজের সাথে ব্যাবসায়। বাবা মা খুশী। গ্রামের বাড়ি পড়ে থাকে বাড়িতেই। বাবা মা ভাই ভাবী আর দিনাকে নিয়ে মধুর এক সংসার। এরপরে তো পরপর তিনটি ছেলের জন্ম। ভাইভাবীর আবার উলটো তিন মেয়ে এক ছেলে। ততদিনে সবার আলাদা বাড়ি। বাবা মাও চলে গেছেন না ফেরার জগতে। এখন ঈদ মানেই সেমাই জর্দা, পোলাও বিরিয়ানী, মাটন কারি, রোস্ট আরো কত কি! সবই অভিজ্ঞ বাবুর্চির রান্না। পরিপাটি, সুস্বাদু। এছাড়া আছে শপিং। উনার এত সময় কই? এসব কেনাকাটা তো কম ঝামেলার নয়। প্রায় সাত দিন ধরে অফিসের ম্যানেজার তার দলবল নিয়ে সব কিনে টিনে আনে। লোকটাকে কিছুই ভাবতে হয়না। উনার ভাবী আর দিনাই ছোটাছুটি করে সব ম্যানেজ করে। গ্রামের একে এই দাও, তাকে সেই। নিজের বাচ্চাদের তো কথাই নেই। একেকজন জন্মদিনে গাড়ি পায়, দামী মোবাইল ফোন বা দামী ভিডিও গেইম প্লেয়ার পায় আর চলে রাতভোর পার্টি। সেইসব পার্টিতে চলে দেশ বিদেশের নানা খাবার। পিজ্জা, লাজ্জানিয়া, পাস্তা, কাচ্চি, নান, ফ্রায়েড চিকেন, আইসক্রিম, ফ্রেশজুসসহ আরও কত কি! বড়দের জন্য অন্য রকম পানীয়। আবার অনেকসময় দেশে পোষায় না, চলে যান সবাইকে নিয়ে দেশের বাইরে। পালটে গিয়েছে জীবনযাত্রা, সবই উপভোগ করেন তিনি। লোকটা বুদ্ধিমান। তিন ছেলেকেই বিদেশে পড়িয়েছেন। এখন একজন দেশে, অন্য দুজন বিদেশে থেকে ব্যাবসা সামলায়। দিনা মারা যাবার পর নিজেকে তিনি নির্বাসন দিয়েছেন বাবা মায়ের রেখে যাওয়া এই গ্রামের বাড়িটিতে। জীবন নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই, চাওয়া পাওয়া নেই। সুখি এক মানুষ। শুধু মাঝে মাঝে ছেলেদের কাজে বা ব্যাবসার প্রয়োজনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর দায়িত্বটুকু তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। তিনি সানন্দে তাঁর যোগাযোগের তারগুলো দিয়ে ছেলেদেরকে আরো ভালোভাবে আঁটোসাটো করে বেঁধে দেন। উন্নতি আর উন্নতিতে ছেলেরাও ভরে উঠছে। ছেলেরা বাবাকে অনুযোগ করে, ডাকে, ‘বাবা চলে আসো। নাহয় তোমার নিজের এপার্টমেন্টেই থাকো কিংবা আমাদের কারো সাথে আর তা না পোষালে বিদেশের ভাইয়ের কাছে, আসবে?‘ লোকটা হাসেন।
লোকটা তার গ্রামের বাড়ীটাকে গড়েছেন যেন রাজপ্রাসাদ। দোতলা ডুপ্লেক্স। এসি, জেনারেটর, আরাম আয়েস কি নেই তার? হ্যাঁ একটা জিনিস নেই। নেই গোলাম রহমান, আতাউল্লাহ, বীরেন কেউই। তাদেরকে ডাকলেও তারা আর আসেনা, এলেও কেমন জড়োসরো। তাদের কাঁধে হাত পেঁচিয়ে নদী পাড়ি দিতে ইচ্ছে জাগে তাঁর। গলাগলি করে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে মাঠের পর মাঠ। ভুলে যেতে চান এতদিনের দূরত্ব, ব্যাবধান। সময় এমনই এক ঘাতক। কখন নিহত করে রেখে গেছে তার ছেলেবেলাকে, ছেলেবেলার বন্ধুদেরকে উনি টেরই পাননি। এই কিছুদিন আগেও তো মাঈদুলটাকে যাকাতের টাকা পাঠাতো তাঁর বউ দিনা, সাথে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা জোড়ায় জোড়ায়। ‘আহা ওরাই তো হক্কদার,’ এটা ছিল দিনার ভাষ্য। তিনি কৃতজ্ঞ হতেন দিনার প্রতি। ভাবতেন, ‘দেখো কান্ড! কতদিকে চোখ আমার বউটার।‘ তারপরও এখানে এসে দেখেন তিনি, তাঁর নিজের উচ্চতায় এতটাই বাড় যে উনার বন্ধুরা আর তাঁর নাগাল পায় না। এমনকি মোসাহেবী করবার জন্যেও যতটা লম্বা হতে হয় উনার বন্ধুরা তার চেয়েও অনেক নীচে পড়ে গেছে। লোকটা তাই একা। তবু তাঁর ভালো লাগে এই গ্রাম। এসি রুম ছেড়ে উনি বসে থাকেন নীচতলার খোলা বারান্দাটায়, যেখান থেকে দেখা যায় দূরের রূপালী নদী। ঝাপসা হয়ে আসা কালচে সবুজ গাছপালা। বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ বা শিশুদের কলতান দেখতে উনার ভালো লাগে। ভালো লাগে জীবনের এই বেঁচে থাকা।
কদিন আগে ইটালী থেকে এসেছেন উনি। ছেলেদের ডাকে, ব্যাবসার প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল। ওখানেই শুনেছেন কোভিড ১৯ বা করোনার কথা। এসব নিয়ে ছেলেরা তাকে বিস্তর জ্ঞান দিয়েছেন কেননা উনি এখন টিভি দেখেননা, ফেইসবুকিং করেন না। উনি কাজের লোক ছিলেন। এসবের জন্য সময় ব্যয় করাটা তার অপচয় বলে মনে হয়। তারপরও ছেলেরা তাকে হোয়াটসএপে এই রোগের নানা তথ্য পাঠায়। উনি একা মানুষ। বাসায় কিছু কাজের লোক ছাড়া আর তো কেউ নেই। তাই আইসোলেশনের কথা ভেবে উনি হাসেন। আর তাছাড়া ইতিমধ্যে একুশ দিন তো পার হয়েই গেছে! পরশু বীরেনটা এসেছিল। খুব কাঁচুমাচু মুখে কিছু টাকা চাইতে। ঢাকায় নাকি লকডডাউন শুরু ঝয়ে যাবে। তাই ওর ছেলে টাকা পাঠাতে পারছে না। বেতন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ছেলেটা নাকি নিজেই দোটানায় আছে। অনেক ইচ্ছে করছিল বীরেনের সাথে আড্ডা দিতে। কিনতু কি আড্ডা দেবেন? সামনে বসে থাকা চাষাভুসা মার্কা এক বৃদ্ধ যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যাট্রিক ফেল তার উপর সে এসেছে দয়া চাইতে, তার সাথে কি আর আড্ডা জমে? উনি বীরেনের প্রত্যাশার চেয়েও বেশী টাকা গুঁজে দেন ওর হাতে আর নরম স্বরে বলেন, ‘আমি তো আছিই। ছেলেকে বলিস চিন্তা না করতে। যখনই টাকা লাগবে চলে আসিস।‘ বীরেন নত চোখে, নত হাতে টাকা নিয়ে চলে যায়। আর উনি ভাবতে বসেন, এতটা আশ্বাস দেয়াটা ঠিক হলো কি? শেষে তো এরা অলস হয়ে উঠবে! নাহ এরপরে আর এতটা আস্কারা দেয়া ঠিক হবে না। আবার ভাবতে বসেন বীরেনের ছেলেটাকে তার কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে দেবেন কিনা। তাহলে অফিসে নিজেদের লোকদের পাশাপাশি একেবারে নিজস্ব কিছু স্পাইও তৈরী করে রাখা যায়। কে কি করছে, কি হচ্ছে কোন অফিসে সেগুলোও ছেলেরা সব খবরাখরর রাখতে পারবে। কারণ ইদানীং বড় ভাইয়ের মেয়েজামাই আর ছেলেটার সাথেও ভালোই গোলমাল চলছে উনার ছেলেদের। পরক্ষণেই মনে হয়, কি দরকার! অযথা গ্রামের এইসব লোকজনকে নিয়ে এত টানাটানি করবার? যার যার জীবন তার তার কর্মফলের দান। তিনি কে এসব ঠেকাবার? বরং খামোখা ছেলেরা বিরক্ত হবে। বলবে, ‘বাবা গ্রামে গিয়ে সমাজসেবার পাশাপাশি যতসব ছাইপাঁশ করে বেড়াচ্ছে।‘ কিংবা হেসে হেসে বলবে, ‘বাবা এবার কি তুমি রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হবে?
ইলেকশন/টিলেকশনে দাঁড়াবে নাকি? তাহলে কিনতু মন্দ হয় না!’ এসব ভাবতে ভাবতেই উনার মাথাটা কেমন ভার ভার লাগে আর শরীরটা এত দুর্বল বোধ হয় যেন আর উঠে দাঁড়াতেই পারবেন না। তবু উনি উঠে দাঁড়ান। কোনো রকমে টলতে টলতে দোতলায় উঠে যান আর বেডরুমে রুমে ঢুকে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দেন। একটু ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, লোকটা ভাবে।
ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন সন্ধ্যা কি রাত টের পাননা। শুধু টের পান কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। উনার সাথে চার জন কাজের লোক থাকে। সবাই পুরুষ, নানা বয়সের, নানা যোগ্যতার। একজন শেফ, একজন বাটলার, একজন ক্লিনার আর একটা তরুন ছেলে নাম আরিফ। ছেলেটা গ্রাজুয়েট। উনার পিএস। ছেলেটা সারাক্ষণ উনার আশেপাশেই থাকে। উনি জানেন আরিফ উনার দরজার বাইরেই আছে তবু ওকে ডাকবার শক্তিও যেন উনার নেই। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে বেল টেপেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দরজা খুলে আরিফ ভেতরে ঢোকে। আলো জ্বালিয়ে উনার দিকে তাকায় আর উদ্বিগ্নস্বরে ‘স্যার কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? স্যার?’ বলতে বলতে খাটের দিকে ছুটে আসে। উনি কেবল বলতে পারেন, আমি টয়লেটে যাব।
এর পরের কয়েকটা দিন অন্যদের জন্য অনেক দ্রুত কাটলেও উনার জন্য সেটা হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ঘুম আর জাগরণে উনি কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকেন। জ্বর, কাশি, পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা সব মিলিয়ে অসহ্য বিষয়। আর শ্বাসকষ্ট যেন ক্রমেই বাড়ছে। নিঃস্বাস নিতে এত কষ্ট? উনি দেখেন বাসার প্রেক্ষাপটও যেন কেমন বদলে গেছে। অফিসের বেশ কিছু লোক চলে এসেছে উনার বাসায়। উনার রুমের বাইরে তাদের ত্রস্ত আনাগোনা টের পান উনি যদিও কাজের লোকজনও খুব একটা সামনে আসেনা। এলেও সবার মুখে মাস্ক। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে উনার নাকেমুখে ঢুকছে অক্সিজেন। তবু যেন আরাম নেই। অনেক কষ্টে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় উনি ম্যানেজারকে বলেন, ‘আমার ছেলেরা কই? ওরা আসেনি? ছেলেদেরকে খবর দাও, এখানে আসতে বলো।‘ ম্যানেজার একটু অস্বস্তি নিয়ে তোতলাতে থাকে। আরিফ এসে বোঝায়, ‘স্যার এখন উনারা কিছুতেই আসতে পারবেন না। ঢাকায় লকড ডাউন চলছে। প্লেন থেকে শুরু করে গাড়ি ঘোড়া পথ ঘাট সব বন্ধ স্যার। একটু ধৈর্য্য ধরুন।‘ ভিডিও কলে আরিফ উনাকে ছেলেদের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। বড় ছেলে অনুযোগ করে, ‘তোমাকে নিষেধ করেছিলাম বাবা ওখানে থাকতে, শুনলে না আমাদের কারো কোনো কথা। এখন ওখানে, ওই গন্ডগ্রামে কি করে চিকিৎসা করাব তোমার, বলো?’ আবার কখনো নাতি নাতনীরা কথা বলে, ‘গ্র্যান্ডপা গেট ওয়েল সুন’ উনি ঘোলা চোখে তৃষ্ণার্তের মতন ল্যাপটপ বা ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কদিন গেছে উনি জানেন না। উনি এখন হসপিটালে এটা বুঝলেন কি বুঝলেন না কে জানে! উনি দেখলেন সারা শরীরে কি সব পরা, হেলমেট লাগানো অনেকগুলো নারী পুরুষের ছোটাছুটি। আরিফ বলেছে, ছেলেরা চীন থেকে ডাক্তার, নার্স আনিয়েছে। উনার ভালো চিকিৎসা চলছে। কেন জানিনা শারিরীক এত কষ্টের ভেতরও উনি গোঁ গোঁ করে বললেন, ‘একবার আইমানকে আসতে বলো, ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে’ আইমান উনার ছোট ছেলে। আরিফ বলে, ‘স্যার অফিসের সবাই আমরা আছি এখানে। আপনি চিন্তা করবেন না। আর আপনার নাতি নাতনীদের সেইফটির জন্যে আপনার ছেলেরা আসতে পারছে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে।‘ উনি হতাশ হলেন কি?
আজ লোকটা চলে যাবেন। তার বুকের ভেতর এতটুকু নিঃশ্বাস অবশিষ্ট নেই। উনি তার কিছুই জানেন বা বোঝেন না। স্নেহের কোনো হাত উনার কপালে পড়েছে কি না তা নিয়েও নেই কোনো মাথাব্যাথা। শুধু ডাক্তাররা আর আশেপাশে যারা রয়ে গেছে তারা জানে উনি চলে যাচ্ছেন। কিনতু লোকটা তখন মাকে ডাকছে। দাওয়ায় বসে মা চিকন চালের ভাত আর ঝাল গরুর গোশত বেড়ে দিচ্ছে কালাই করা বাসনে। উনি বলছেন, আমার কষ্ট হচ্ছে মা। মা উনার কপালে হাত রাখলো। মায়া মায়া হাত। উনি বুঝলেন, মা ছাড়া আসলে এক জীবনে আর কেউই থাকেনা যে শুধুই ভালবাসে। উনি তখন মায়ের শরীরের ভেতর আরো ঘণ হয়ে ঢুকে পড়েন। উনি যেন মায়ের পেটের ভেতর চলে যেতে চান, এমনই ইচ্ছে জাগে মনে। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। উনি দেখতে চাইলেন জানালাটা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছে কিনা। কাউকে ডাকতে হবে, জানালা আটকাতে হবে, এইসব ভুলে উনি তখন বৃষ্টি কণাগুলোর সাথে সারা গ্রামময় ঘুরতে শুরু করলেন।
অনেক দূরে তখন মায়ের পেটের ভেতর একজন কাতরাচ্ছে ব্যথায়। যে শরীর সে চেনে না সেই শরীরের ব্যথাবোধ তাকে অবাক করছে। সে পরিচিত হচ্ছে কষ্টের সাথে, ব্যথার সাথে। সে তখন বাইরে আসবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যাস্ত। সে ভাবছে, হয়তো একবার বাইরে বেরুলেই এই ব্যথা থাকবে না আবার ভাবছে যদি থেকেই যায়? সে বোঝে এইসব ব্যথা নিয়েই তাকে নামতে হবে পৃথিবীর বুকে। পরে কি হবে সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাততঃ পৃথিবীই গন্তব্য। পৃথিবী আসলে কেমন? জীবনই বা কি? অনেক মানুষের উল্লাস, হাসি আনন্দ শুনতে শুনতে সেও কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকায়। সে দেখে জল। সে দেখে বৃষ্টি কণাগুলোর হাত ধরে কেউ যেন চলে যাচ্ছে। ছায়া ছায়া কেউ। চলে যাচ্ছে ভেজা ভেজা হয়ে দূরে আরো দূরে। যে যাচ্ছে সে যেন হাসছে মুক্তির আনন্দে। সে তাকিয়ে থাকে অপসৃয়মান ছায়াটার দিকে। আর তার কান্না পায়, ভীষন কান্না। বন্দিত্বের যন্ত্রনায়, নতুন পৃথিবী কেমন জায়গা, ভয় কি তাহলে এটাই? এসব ভাবতে ভাবতে তারস্বরে সে চীৎকার করে ওঠে। বাইরে তখনো প্রবল বৃষ্টি।
একটি শিশু মায়ের নিরাপদ কোলে। সে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। দূরে বিস্তীর্ণ ভূমি, কি দারুণ বিস্তৃত। রোদ থেকে ঝলসে উঠছে কাকলী, প্রাণের কাকলী। বাতাসে শিস দিচ্ছে দুলে ওঠা কচি ধানের সবুজ। নরম ভাপ ওঠা রোদ। পাখির কিচিরমিচিরেও স্থির হয়ে আছে যে স্তব্ধতা, যে নীরবতা তার ভালো লেগে যায়, ভালো লাগতে শুরু করে সব কিছু, ভালো লেগে যায় নতুন এই জীবন। সে হাসে।
loading...
loading...
পুরোটা জুড়ে খুঁজে পেলাম অসম্ভব কথা-আন্তরিকতা। যেন জীবন থেকে নেয়া।
loading...
দারুন
loading...