রূপবন্ধ

রূপবন্ধ

ঠিক উত্তরের ঘরটার উপর মেঘগুলো ডানা ঝাপটিয়ে উড়ছে, একটু পরেই ঝরে পড়বে যেন। এই ঘরটা ছোটমা’র ঘর। নওয়াব ঘুম ঘুম চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আরেকবার। মন বলে, অপুর মুখটা ওই মেঘেদের ভেতর আচমকা একদিন সে দেখে ফেলবে। শুধু এই এক প্রত্যাশায় নিজের ঘরের বারান্দায় বসে বসে আকাশ দেখে নওয়াব। ওর মা শুয়ে আছে ঘরে। আর একটু আগেই দেখেছে আব্বাকে ছোটমার ঘরের দিকে যেতে। আগে আগে মা এই সময়গুলোতে ছটফট করে ঘুরে বেড়াত আর একটু পর পর নওয়াবকে জিগ্যেস করত, ‘অই তর বাপে বারায়না ক্যান?’ আজকাল মা’রও আর ওসবে মন নেই। মা শুয়ে শুয়ে কেবল নওয়াবের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা’র জন্যে নওয়াবের মায়া হয় কিনতু ছোটমার জন্যেও যেন ওর কেমন কেমন লাগে। অপু থাকতে কত যেত ছোটমার ঘরে আর বারবার আড়চোখে তাকাত ছোটমার দিকে। ছোটমা টুকটাক ঘরের কাজ করত, পায়ের নখে উবু হয়ে বসে নেলপলিশ লাগাত অথবা নিজের ব্লাউজে নকশা আঁকত। নওয়াবের খুবই অবাক লাগত এই মহিলাকে দেখে। কেমন জৌলুষ তার মুখে চোখে। আব্বাকে দেখলেই চোখ ঘুরিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে কেমন করে যেন হাসত আর নওয়াবের বুকের ভেতর শিরশির করে উঠত অজানা এক ব্যথা।

কয়মাস আগে, তখনো ছোটমা ওর দিকে তাকিয়ে কোমল হাসি হাসত। এক দুপুরে ছোট একটা পোটলা হাতে নিয়ে অপু এসেছিল ওর কাছে, ‘দাদা চলো যাই মামুগো বাড়ি, যাইবানি?’ এ সময়ে ছোটমাও এসেছিল অপুর পেছন পেছন। নওয়াবের হাতটা ধরে বলেছিল, ‘যাও না বাপ, আমার ভাইয়ের বাড়িত এই নতুন পাটালি কয়খান দিয়া আসো, অপু ছুডু মানুষ একলা একলা যাইব!’ নওয়াব কোনো কথা না বলে ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁক দিয়েছিল, ‘অই রে মায়ো, আমি অপুর লগে নতুন মামুগো বাড়িত গেলাম, তুই য্যান আমারে বিছরাইস না।‘

যেতে যেতে অপু বলছিল, ‘দাদা মাইনষে কয় আমার মা শহরের মাইয়্যা, আব্বারে নাকি তুকতাক কইরা নিকা করছে তোমার কি মনে হয়? যাদুটোনা নি করছে?’ নওয়াব বিরক্ত মুখে বলেছিল, ‘মাইনষের কতা হোননের তর কি দরকার পড়ছে? করলে করছে, অরা করে না ক্যান? অরাও করুক।‘ অপু সভয়ে নওয়াবের শরীরের সাথে গা ঘঁষতে ঘঁষতে বলেছিল, ‘দাদা অরা যা কয় কউক, মা-বড়মা আর আব্বা যা খুশী করে করুক। আমি বড় হইলে নিপুরে নিয়া দাদা আমরা তিনজনে এক সাথে থাকুম, কি কও?’ নওয়াব এক মুখ বিস্তৃত হাসিতে গলে গলে যেতে যেতে ভাইকে দাঁড় করিয়ে হাত দিয়ে ওর চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে ভাইকে একবারে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে, হ ভাই ভুলিস না, মা বাপ যা-ই হোক আমরা কিন্তুক ভাই ভাই।‘

পুরো রাস্তা ওদের কত কথা, কত গল্প! মামুর বাড়িতে গিয়ে পেট ভরে নকশি পিঠা খেয়ে তবেই ওরা ফিরতি পথ ধরেছিল। ঘুরপথেই ওরা মামুদের গ্রামে এসেছিল। মাত্র একঘন্টা লাগে সময়। অথচ ফেরার সময়ে অপুর জেদে জঙ্গলের পথ ধরতে হল, তাহলে আধাঘন্টা সময় বাঁচে। আর অপুটার বিকালের ফুটবল খেলাটাও মার যায় না। দুই ভাই তেমনি গল্প করতে করতেই যাচ্ছিল। হঠাৎ অপু ‘উহ’ বলে পা চেপে ধরে বলেছিল, ‘অ দাদা কিসে য্যান কামুড় দিল পায়ে’ নওয়াব কথার ঝোঁকে এটাকে তেমন পাত্তা দেয় না বরং ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, ‘বিছা হইব মনে লয়।‘ ওরা জঙ্গলের বাইরে বের হয়ে নিজেদের গ্রামের সীমানায় আসতেই অপু কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, ‘অ দাদা পুরা পাও য্যান অবশ লাগে, আমারেনি সাপে কামড়াইছিল মনে লয় দাদা’ বলতে বলতেই ওর মুখ দিয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ল। এদিকে তখন গ্রামের অনেক লোক জড়ো হয়েছে। রমজান কাকু এসে তের বছরের অপুকে কোলে তুলে নিয়ে ছুট লাগিয়েছিল বাসার দিকে। বাড়ীর আঙ্গিনায় মাদুর পেতে শুয়ে ছিল অপু, সারা মুখ আর শরীর কালো। যদু ওঝা এসে ফিরে গেছে। কোনো লাভ হয়নি, অপু চলে গেছে দাদাকে রেখে, নিজে এক একা কোন অলীকলোকে থাকবে বলে। যাবার আগে তবু ভাইয়ের হাত ছাড়েনি, শক্ত মুঠোয় ধরে রেখেছিল নওয়াবের হাত। আর ছোটমা উপুড় হয়ে পড়েছিল অপুর শরীরে, জ্ঞানহীন।

সেই থেকে নওয়াব একা। ছয় বছরের নিপুকেও আর ওর কাছে আসতে দেয়না ছোটমা। নিপুও অপুর মত অত ছোঁকছোঁক করে ঘোরেনা নওয়াবের আশেপাশে। আসলে সবাই দোষ তো দিয়েছে নওয়াবকেই। কি দরকার ছিল ঐ জঙ্গলের পথে বাড়ী ফেরার? কি এমন তাড়া ছিল নওয়াবের? এসব শুনে শুনে কান ঝাঁজরা হয়ে গেছে নওয়াবের। কারো কথাই আর ওর কানে ঢোকেনা। ছোট বেলা থেকেই এই সতের অব্দি শুনে আসছে, সে বোকা, সে ভাদাইম্যা। কেউ কেউ তো আড়ালে ওকে পাগল বলেও ডাকে। ইদানীং শুনছে, ছোটমা ওদের সব জমি-জিরাত-সম্পত্তি বাবার কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়েছে। নইলে নাকি সে মামলা করে নওয়াবকে ফাঁসিতে ঝোলাত। নওয়াবের মা এখন শূন্য চোখে শুধু নওয়াবকে পাহারা দেয়। ছোটমা নাকি বলেছে সে শোধ নেবে, সাপ ঢুকিয়ে দেবে নওয়াবের ঘরে। ঢুকিয়ে দিলে দিক না। কি আর হবে? বরং ওটাই ভাল হবে। আকাশের উপর একটা ঘর তুলে অপুকে নিয়ে ঐ ঘরে থাকবে নওয়াব। মা’র ডাকে ও চমকে তাকায়,
– কি এত ভাবোস দিনরাইত? বাপের দোকানগুলাতে গিয়া বসলে তো একটা কাম অয়। তা না সারাদিন খালি ফ্যালফ্যালাইয়া আকাশের দিকে চাইয়া থাকন। বোজোস না, সব সম্পত্তি যে ডাইনীতে খায়া নিল। পরে গিয়া তো হাওয়া খাওন লাগব।
– আমি দোকানের কি বুঝি? সম্পত্তি চাই না আমার
– হ সম্পত্তি চাইবা ক্যান? এহন তো কিছু বুঝতাছ না। কালে কালে দ্যাখবা কিমুন দিন আসে!
– ধুর মায়ো, তুমার জইন্যে কুথাও বসাও আমার হারাম
বলে গজগজ করতে করতে নওয়াব উঠে যায় দাওয়ায় রাখা চেয়ার ছেড়ে।

রাতে শুয়ে শুয়ে নওয়াব শোনে মায়ের ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না। আব্বা রেগে ওঠে, ‘আরে এইগুলান যদি এহন অরে লেইখা না দেই তয় নওয়াবরে য্যান অই পুলিশে দিব সেই খিয়াল নাই তোমার? বে আক্কেল মাইয়া মানুষ, পোলারে সামলাইয়া থোও নাই এহন আবার কান্দাকাটি কি জইন্যি? আর পোলাও তো তেমুন, গাধার গাধা। কম দুঃখে আমি অপুর মায়েরে ঘরে আনছি? একটা তাজা পোলাও যদি দিতে পারতা আমারে তাইলে আর আমার দুঃখ থাকত না’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

নওয়াব শুনেছে, বিয়ের পর মায়ের কোলে কোনো সন্তান আসেনি অনেক বছর। মাকে সবাই কত গালমন্দ করেছে। দশ বছর পরে নওয়াবের জন্ম হলেও যে মার কপাল খুলেছে এমনও নয়। ততদিনে আব্বার অভ্যাস হয়েছে খারাপ। আজ এই মেয়ে কাল সেই মেয়ে হতে হতে একদিন শহর থেকে নিয়ে এসেছে ছোটমা শাহেদাকে। আর এই ছোটমা আসবার পরেই বাবা থিতু হয়েছে। মনোযোগী হয়েছে সংসারে। গ্রামের লোকেরাও ছোটমাকে অনেক খাতির তোয়াজ করে। নওয়াবের মাকেই বরং মানুষ কঠিন সব কথা শুনিয়ে দেয়। নওয়াবের নানা নেই, মামু নেই। ওর মা’টা তাই অসহায়ের মত ঘোরে। সারাদিনই প্রায় কাঁদে। আর এই কান্না দেখলেই আব্বা রেগে ওঠে তেলে বেগুনে। বলে, ‘কিসের অভাব দিছি তুমারে? সারাদিন শাপাও? তুমার চেহেরা দেখলেই তো পাপ। আমি তাও সইঝ্য করছি, বলো করি নাই? আবার জন্ম দিয়া থুইছ এক ভাদাইম্যারে। আমার অপুটা বড় হইলে যদি কুনো কুল হয়। নাইলে এই সম্পত্তি মাইনষে খাইব, বুঝলা?’ সেই অপুটাও এখন আর নাই। আহারে………নওয়াবের বুক ভেঙে আসে।

এখন আর নওয়াবের কোনো ঘর নেই, নওয়াবের কোনো ঠিকানা নেই। একটু আগে মা’র ঘ্যানঘ্যানানি থেকে বাঁচতে সে সরে এসেছে। ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন সে ছোটমা’র ঘরের পেছনে চলে গিয়েছে। একটু আগেই সে দেখেছিল আব্বা ছোটমা’র ঘরের দাওয়ায় উঠে গেছে। আর ছোটমা তার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে সেই গা শিরশির করা হাসিটা হাসছিল। নিপু গেছে মসজিদে পড়তে। তখন থেকেই ওর মাথার ভেতরটা কেমন করছে। এখন ছোটমা’র ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ও ভাবছিল নিপুর জন্যে একটা মজবুত গুলতি বানিয়ে দেবে। সে মনোযোগ দিয়ে বাড়ীর পেছন দিককার পেয়ারা গাছটাকে দেখছিল। একসাথে আড়াআড়ি ভাবে জেগে ওঠা দু’টো ডাল সে খুঁজছিল। হঠাৎই কানে আসে ছোটমার কণ্ঠস্বর। কেমন অদ্ভুত, জড়ানো। নওয়াবের মাথার ভেতর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে যেন। ছোটমা আকুল হয়ে টেনে টেনে বড় বড় নিঃশ্বাসের সাথে আব্বাকে বলছে,
– এইবার আমারে আরেকটা অপু দিতে হইব। দিবেন কন?
– দিমু, দিমু। কোন জিনিষটা আমি তোমারে দেই নাই? আমারেই তো দিসি তোমার কইরা
– থাক আপনেরে নিয়া আমি কি করমু, ভাগীদারের জিনিষ আমার লাগব না। আমি অপুরে চাই, আবারো
– আইচ্ছা অপুই আসব আবার
ওরা আরো কি সব বলছিল না শুনেই নওয়াব সরে আসে। ভেবে পায়না সরে সরে সে আর কতদূর যাবে? আব্বা আর ছোটমা চাইলেই অপুকে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিনতু সেটা তো নওয়াবের অপু নয়। নওয়াব আবারো অপুর জন্যে হাহাকার করে ওঠে, অপু, অপুরে………ওর বুক থেকে এই একটা ডাকই বারবার উথলে উথলে ওঠে। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে ও আকাশের দিকে তাকায়। চলমান মেঘগুলো কেমন দৌঁড়ে দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে কোনদিকে। নওয়াবের ইচ্ছে হয় দেখার, আসলে কোন কিনারে মেঘগুলোর বাড়ী, কোথায়ই বা শেষ! নিশ্চই পৃথিবীর শেষ মাথায়? মেঘেদের সাথে নওয়াবও তাই একটু একটু করে দৌঁড়াতে থাকে। মেঘের কোনো খোপে ঘর বানিয়ে অপু ওর জন্যে অবশ্যই বসে আছে, এটা সে ঠিক জানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৫-১০-২০১৭ | ২১:৪৯ |

    নিঃসন্দেহে আপনি গদ্য এবং পদ্য দুটোই অসাধারণ লিখেন। চলতি লিখাটিতে নওয়াব চরিত্রটি এমন চমৎকার উপস্থাপন হয়েছে যে, লিখায় অনন্য মাত্রা যোগ করেছে।

    শুভেচ্ছা প্রিয় শব্দ বন্ধু শাকিলা তুবা।

    GD Star Rating
    loading...
  2. এম এ বাসেত : ২৭-১০-২০১৭ | ২০:২৪ |

    ভাল লাগল আপু। ভাল থাকবেন।

    GD Star Rating
    loading...