এ কথা সকল তথ্যাভিজ্ঞ মানুষই স্বীকার করবেন যে, বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন ধর্ম এক নম্বর ইস্যু। পাঁচ শতাব্দী আগে ইউরোপে বস্তুবাদী ধর্মহীন একটি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তারা যখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থাগুলোকে দুনিয়াজুড়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চিত বস্তুবাদী ধর্মহীন পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র প্রভাবে পৃথিবীর মানুষ এখন এতটাই মানবতাবোধহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিকে পরিণত হয়েছে যে সকল চিন্তাশীল, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এখন একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, যদিও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও পৈশাচিকতা রুখতে ধর্মকে বাদ দিয়েই জাতীয় জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু সেটার ফল আশানুরূপ হয় নি, মানুষ শান্তি পায় নি। যেটা পেয়েছে সেটা হলো যান্ত্রিক প্রগতি (Technological advancement)। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, বাস্তবে কোথাও ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় নি। শত সহস্র বছর থেকে মানুষের মনে লালিত ধর্মবিশ্বাস দূর করা যায় নি। এ কারণে তারা নীতি পাল্টিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে রাষ্ট্র যখন কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) উপাধি ধারণ করে ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ত হওয়া শুরু করল, মানুষও রাষ্ট্রের নানা কাজে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেল, তখন সেই ধর্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে গণ্ডিবদ্ধ থাকে নি। নানা ইস্যুতে, নানা প্রেক্ষাপটে, ঘটনাপ্রবাহের নানা বাঁকে সেই ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। তখন রাষ্ট্রকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ধর্ম দিনশেষে ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে নি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারিত্ব নিয়ে এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি। এ পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ধর্ম এখন বিশ্বরাজনীতির এক নম্বর ইস্যু। ইউরোপে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার সেক্যুলার দলগুলো রাজনীতির মাঠ দখল করেছিল সেই মাঠ এখন ডানপন্থী খ্রিস্টান প্রভাবাধীন দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে এবং জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। সেখানে বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো জড়িত হয়ে গেছে। আর এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ক্রমশ উত্থান কীভাবে রাজনীতির অঙ্গনে কলকাঠি নাড়ছে সেটা সবাই জানেন।
ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতবর্ষেও চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো ধর্মের অনুসারীই ছিল সংখ্যাগুরু। তার আগে বৌদ্ধরা ছিল বড় জনগোষ্ঠী। মুসলমানদের আগমনের পর কোটি কোটি ভারতবাসী ইসলামের শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য ও উন্নত আদর্শের পরিচয় পেয়ে মুসলিম হয়। এখনও হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই পাক-ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমান বাস্তবতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যগঠন করা, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত তাদের পারস্পরিক মনোমালিন্য ও মানসিক দূরত্ব দূর করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতন চালিয়ে প্রায়ই নির্মমভাবে ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এখানে করা হচ্ছে হিন্দুদের উপর আর ভারতে করা হচ্ছে মুসলমানদের উপর।
এই দাঙ্গা, হামলার প্রেক্ষিতে উভয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আরো সন্দেহ, আরো দূরত্ব, আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শত্রুতামূলক মনোবৃত্তি যতদিন তাদের মধ্যে বজায় রাখা যায় ততই সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুবিধা; তারা এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তেলসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটিকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যদি আমরা সত্যিই আমাদের দেশটিকে ভালোবাসি, আমরা উপলব্ধি করি যে এ দেশের মাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, এই মাটি দিয়ে হিন্দুরা মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আর মুসলমানেরা এই মাটি দিয়েই ইটের মসজিদ গড়ে নামাজ পড়ে। এই মাটির ফল-ফসল খেয়েই হিন্দু – মুসলমান উভয় জাতির মানুষ পুষ্ট হয়। আমাদের এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভিতরে বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব এখন প্রবল যা অবিলম্বে দূর করা জরুরি। যখন কোনো লোকালয়ে অগ্নিকা- হয় তখন কারো ভবনই রক্ষা পায় না, দেবালয় মসজিদ কিছুই এড়ায় না। যখন ইরাক আক্রান্ত হলো তখন সিরিয়ার লোকজন বারে গিয়ে ফুর্তি করেছে। কিন্তু কয়দিন পরে দেখা গেল সেই আগুন সিরিয়াকেও ছাড়ল না, এখন সিরিয়ার মানুষ ইউরোপে ভিক্ষা করে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা সহজ কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা অত সহজ নয়। ওটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সরকারগুলো চেষ্টা করে আইন দিয়ে, শক্তি দিয়ে, অর্থ দিয়ে কারণ সরকারের কাছে ওগুলোই আছে। সরকারের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান, ক্রন্দনরত মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত¦না দেন, ভাঙা উপাসনালয় সংস্কার করে দেন, ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগিয়ে দেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষের মন যখন ভেঙে যায় তখন সেটা জোড়া লাগানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেজন্য এখন দুই সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ম এক নম্বর ইস্যু, ধর্মকে ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই বিদ্বেষ বিভক্তি দূর করতে হলে উভয় সম্প্রদায়কে মুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করার জন্য তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে তাদের গোড়া কোথায়, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি কিনা, তারা আদৌ ঐক্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। ঐক্যবদ্ধ হতে হলে উভয়পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। তারা তাদের উভয়ের লালিত ধ্যানধারণা, সংস্কার থেকে কতটুকু ছাড় দিতে রাজি হবে। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় তাই ধর্মবিশ্বাসের মধ্য থেকে কতটুকু তারা বিসর্জন দিতে পারবে, কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, ঐক্যের স্বার্থে তারা কতটুকু উদারতা নিজেদের মধ্যে আনয়ন করতে পারবে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
আমরা দেখব হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হাজার হাজার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুটো ধর্মদর্শনের মৌলিক বহু বিষয়ের গোড়া এক জায়গায়, দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেবল ডালপালা নিয়ে। এখন এই দুটো ধর্মের মধ্যে কী কী বিষয় সামঞ্জস্যপূর্ণ সেদিকে আলোকপাত করব।
একেশ্বরবাদ: ওয়াহদানিয়াত বা একত্ববাদ। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসাবে মানা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। সনাতন ধর্মেরও মর্মবাণী একমেবাদ্বীতিয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১), একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে প্রভু ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো শরিক নাই।
এক বাবা-মা: এক পিতামাতা থেকে সমগ্র মানবজাতির উদ্ভব হয়েছে। এই বিশ্বাস সনাতন ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরাই লালন করেন। ইসলামে বলা হচ্ছে তাঁরা হচ্ছেন বাবা আদম ও মা হাওয়া। সনাতন ধর্মে তাঁদেরকে বলা হচ্ছে আদম ও হব্যবতী (ভবিষ্যপুরাণ)। চলমান … পর্ব দুই
loading...
loading...
জানিনা কিভাবে আপনি ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্মের মধ্যে কম্পেয়ারিজম আনতে চান। তারপরও অক্ষোয় থাকলাম। পড়তে চাই সালজার সাবু ভাই। ভালোবাসা।
loading...
অক্ষোয় থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ…
loading...
ইনশাআল্লাহ অবশ্যই আপনার (বাকি সব দেশ গুলোতে কিভাবে মুসলমানদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে জানাবেন। কেনই বা করা হচ্ছে। ) এ বিষয় জানানোর চেষ্টা করবো । এই পর্ব গুলো শেষ হলে। পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
loading...
আপাতত পড়ে রাখলাম। আলোচনাটি কতটুকু টেনে নিয়ে যান জানতে চাই।
loading...
পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আশা করি সাথেই থাকবেন ।
loading...
ধর্ম নিয়ে লেখা আমি পড়তে রাজী আছি। যথেষ্ঠ অজ্ঞানতার কারণে মন্তব্য করতে হয়তো পারবো না।
loading...
ধর্ম হলো বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান, ধর্ম জীবনের, ধর্ম উন্নতির নাম , ধর্ম প্রগতির নাম। ধর্ম কোন নিদিষ্ট আনুষ্ঠানিকতার নাম নয় । তাহলে যাবতীয় কল্যাণের জন্য যা কিছু করেন সেটাই কি ধর্ম নয় ?
loading...
মানব সভ্যতার সেই আদিকাল থেকে শুরু হয়েছে। পড়ে রাখলাম। অপেক্ষা …
loading...
শ্রদ্ধা জানবেন
loading...
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ মন্তব্য দিবো সর্বশেষ পর্বে। চালিয়ে যান, সাথে আছি।
loading...
ধন্যবাদ আপনাকে সাথে থাকার জন্য।
loading...
আলোচনা ভালোই লাগছে । শেষের দিকটা ভাল লাগছে । সকল ধর্মের সুর প্রায় একই । হিন্দু মুসলিম মূলত এক স্রষ্টার কথাই বলে ।
অপেক্ষায় রইলাম – পরের পর্বগুলার জন্য
loading...
অপেক্ষায় থাকার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবা।
loading...