সাম্যবাদী করোনার চরিত্রের অধঃপতন

১.
বলা হয়ে থাকে, করোনা ভাইরাস সাম্যবাদী। ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সমান চোখে দেখে। চরিত্রের বিবেচনায় করোনা ভাইরাসকে তাই সমাজতান্ত্রিক বলেও চিহ্নিত করা যায় বৈকি! একথা সত্যি বটে ভাইরাস আক্রান্তের বেলায় ধনী গরীব মানছেন। এক্ষেত্রে শ্রেণি নিরপেক্ষ বলা যেতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো ও সমাজ ব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়।

২.
করোনা ভাইরাস বিষয়ে জনসচেতনতামূলক সরকারি-বেসরকারি প্রচার-প্রচারণাগুলো আমরা সবাই দেখছি। সব জায়গাই বলেছে, ঘরে থাকুন। বেশি করে প্রোটিন-জাতীয় খাবার আর ফল-মূল ও শাক-সবজি খান। মানে এগুলো খেলে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। শরীরের প্রতিরোধের কাছে ধরাশায়ী হবে এই আলোচিত ভাইরাস।

প্রোটিনের উৎস মাছ-মাংস-ডিম-দুধ-বাদাম। দামী খাবার। উচ্চবিত্তের খাবার। ধরে নিচ্ছি, নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও মোটামুটি প্রোটিনের ব্যবস্থা করতে পারলো। কিন্তু গরীবের উপায় কী? গরীবদের শুধু ডাল। ডালে প্রোটিন আছে। তা বটে! মোটা চালের ভাত আর ডাল। ডালই শেষ আশ্রয়।

গরীবের টাকা নেই। সিস্টেম মতো সন্তানের জন্য উচ্চশিক্ষা নেই; ভালো চাকরী নেই; বড় চাকরী নেই, বড় বেতন নেই। ভালো বাসস্থান নেই এবং ডাল ছাড়া পুষ্টিকর খাবার নেই; রোগ-বালাইয়ের শেষ নেই; বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তাতো যাবেই। তাইতো? তাহলে করোনাও ধনীর প্রতিরোধে অসহায়। আর গরীব প্রতিরোধের ঢালস্বরূপ ডালের আর ক্ষমতাই কতটা? গরীব ধরাশায়ী।

৩.
রাষ্ট্রের বড় মাথা। বড় ভাবনা। রাষ্টযন্ত্র দখল করে আছে বড় বড় ব্যবসায়ীরা। সংসদের ভিতর কতজন বণিক শ্রেণীর জানা আছে তো? তাই বড় মাথায় বড় বড় বণিকের কথা থাকে। তাদের জন্য প্রণোদনা আসে। ডুবে যাওয়া লঞ্চকে টেনে তুলতে যায় উদ্ধারকারী জাহাজ। আর লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পপতিদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ।
এসব প্রণোদনার অর্থ আসে কোত্থেকে? বাণিজ্যের পেছনে ঢেলে দেয়া হয় রাষ্ট্রের কোষাগারে থাকা কৃষক-কামার-কুমার-তাঁতি-জেলের অর্থ। এভাবেই বণিকেরা লাভ গুলো গচ্ছিত রাখে নিজেদের একাউন্টে। আর লোকসানের ভারটুকু চাপিয়ে দেয় জনতার কাঁধে।

এভাবে চক্করে পরে গরীব হয় প্রতারিত। করোনা মহামারির এই দিনে গরীব শ্রেণী নাভিশ্বাস উঠে মরছে। কিন্তু রাষ্ট্রের মগজ ব্যবসায়ীদের দখলে। তারা লুটপাটে মেতে উঠেছে।

৪.
এই দুর্দিনে কীভাবে চলে কৃষক-শ্রমিক-কুলি-মজুর-তাঁতি-জেলে-কুমার-দেহপসারিনী-গৃহপরিচারিকাদের সংসার? উবার-পাঠাও চালিয়ে, টিউশনি করে, কাপড় আয়রন করার দোকান দিয়ে, পার্ট-টাইম সেলসম্যান এর কাজ করে যারা চলতো, কী করে চলছে তাদের?

বিদায় ঢাকা: করোনায় কাজ হারিয়ে ঢাকা থেকে অনেকেই পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন, শিবচরের কবির নামে একজন ছোট ব্যবসায়ী রাজধানী থেকে বিদায় যাত্রা করেছেন এ মিনি ভ্যানে করে। ছবিটি পোস্তগোলা থেকে তোলা : (নূর হোসেন পিপুল)

মানুষ ঢাকা ছাড়ছে, ছাড়ছে অন্য শহরও। খবরের কাগজ আর ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ভাসছে মাল-বোঝাই ট্রাকের ছবি ও খবর। বহু মধ্যবিত্তের জীবনও প্রকাশ করতে না পাড়ার বোবা কান্নায় নীরব হাহাকার। একেবারে গরীবের তো মাথা ঢাকলে পা উদাম। কাজ নেই। আয়-রোজগার নেই। সঞ্চয়ও কারো শেষ, কারো বা তলানিতে।

৫.
প্রতিদিন এক ভদ্রমহিলাকে দেখি করোনার নানা তথ্য নিয়ে আসে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত নারী-পুরুষের অনুপাত জানিয়ে দেয়। বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানও রসিয়ে রসিয়ে বলেন যেন কত সুখকর কাহিনী বলে যাচ্ছেন। আমার তো মাঝে মাঝে এক বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রীর মতো বলতে ইচ্ছা করে -রাবিশ। আপনারা কি ভাবেন? যা খুশি ভাবুন। কিন্তু আক্রান্তদের শ্রেণি-পরিচয় জানতে পান কি?

আমরা খবর পাই আক্রান্তদের অধিকাংশই অভিজাত শ্রেণির বাসিন্দা। বেদনাক্রান্ত হয়ে শুনতে পাই চীন থেকে এয়ার এম্বুলেন্সে ডজন খানিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এনেও বাঁচানোই যাচ্ছে না অভিজাতদের। বাস প্রমাণ হয়ে গেল করোনা ধনীদের শত্রু, আর বলা হয়- গরীব খেটে খায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাই তারা তেমন আক্রান্ত হয় না, মরে না।
ব্যাস হয়ে গেল! কথা কি এখানে শেষ?

অভিজাতদের চিকিৎসার সুযোগ ও সামর্থ্য বেশি। কিন্তু গরীবের মধ্যেও যারা একেবারে গরীব, অজপাড়াগাঁ, দুর্গম চর বা হাওরাঞ্চলে যারা থাকে অথবা মফস্বলে ও উপজেলা অঞ্চলে যে গরীব জনগোষ্ঠী আছে, চিকিৎসার সামান্যতম সুযোগ না থাকায় তারা যে স্বাস্থ্য পরীক্ষাই করাতে পারছে না, বেহুদা মরে যাচ্ছে বেখবরে তার তদন্ত বা পরিসংখ্যান হাসিমুখে বর্ণনা করে কি কোন অভিজাত সংবাদ পাঠক?
সোজা হিসাব তাদের পরীক্ষাই হয় না, তাই তারা আক্রান্তও হয় না।

৬.
সরকারি কর্তাদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণা এসেছে। সরকারি প্রাণ চলে গেলে পরিবার পাবে অর্ধ কোটি টাকা। আর করোনা হলে দিবে এক মিলিয়ন। দামী প্রাণ ওদের। সরকারতো ওদেরই, লাগে টাকা দেবে করদাতাগণ।
হায়! বেসরকারি প্রাণ। আহা! আধমরা হয়ে কেবল বেঁচে থাকা। মুড়ি -মুড়কির চেয়েও সস্তা। ধনতন্ত্রের উৎসবের অকাতরে বলি হয় এইসব প্রাণ।

৭.
উন্নয়ন বহু যুগ উপর থেকে নিচে চুঁইয়েছে, এবার নিচ থেকে উপরে যাবার বন্দোবস্ত করে দেখুন। গাছের শেকড় থেকে যেভাবে কাণ্ড ও পাতায় যায় প্রাণ রস, সেইভাবে উন্নয়নকেও চালনা করুন। এই আহ্বান জানিয়ে লেখাটি শেষ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি জানি এভাবে হয় না কিছুই। অধিকার কেউকে দেয় না, আদায় করে নিতে।

কোথায় সেই প্রচেষ্টা?

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৭ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০৭-২০২০ | ১২:৪৭ |

    সাম্যবাদী করোনায় আমাদের আম-মানুষের চরিত্রে বিশেষ পরিবর্তন না পেলেও, সমাজপতিদের অধঃপতন ঠেকানো যায় নি। ভুড়িভুড়ি উদাহরণ দেয়া যায়। দলীয় লেবাসের একদম সেই তৃণমূল নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অভিজাত পর্যায় পর্যন্ত কাহিনী থেমে থাকে নি। প্রতিযোগিতা চলছে সুবিধা আদায়ের। উন্নয়ন দুরস্ত। প্রচেষ্টা অকার্যকর।

    রাষ্ট্রের জন-সেবক যখন জনতার ধন চুষে খেয়ে ছোবড়া বানিয়ে ফেলে; সেই রাষ্ট্রকে অন্তত জনতার রাষ্ট্র বলা যাবে না। এলিটের রাষ্ট্র, ক্ষমতালিপ্সু এক শ্রেণীর দালালের সম্পত্তি। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • থার্ড আই : ১৯-০৭-২০২০ | ১৪:৩৯ |

      that's the point. 

      You mentioned the  right subjects.  

      GD Star Rating
      loading...
  2. আলমগীর সরকার লিটন : ১৯-০৭-২০২০ | ১৪:১২ |

    সুন্দর লেখেছেন ———-

    GD Star Rating
    loading...
    • থার্ড আই : ১৯-০৭-২০২০ | ১৪:৪৪ |

      Also you write good.   

      GD Star Rating
      loading...
  3. ফয়জুল মহী : ১৯-০৭-২০২০ | ১৫:০৬ |

    অনন্য, সুললিত ভাবনা । 

    GD Star Rating
    loading...
    • থার্ড আই : ১৯-০৭-২০২০ | ১৫:১১ |

      অনেক ধন্যবাদ।   

      GD Star Rating
      loading...
  4. ফকির আবদুল মালেক : ২০-০৭-২০২০ | ০:৩৪ |

    আপনার সাথে একমত- কোথায় সেই প্রচেষ্টা?      

    GD Star Rating
    loading...