হারিয়ে যাওয়া মসলিন

হারিয়ে যাওয়া মসলিন

মসলিন কিংবদন্তির কোন শেষ নেই। ম্যাচ বাক্সে পুরে ফেলা যেত আস্ত একটা শাড়ি। মসলিন শব্দের উদ্ভব মসুল থেকে। ইরাকের এককালের ব্যবসা কেন্দ্র মসুলে তৈরি হতো সূক্ষ্ম সব কাপড়। ইংরেজরা মসলিন কাপড় দেখে এর নামকরণ করে মসলিন হিসেবে। ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। মসলিন রফতানি হতো ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে। শুধু তাই নয়, ইউরোপ-আফ্রিকাতেও মসলিনের চাহিদা ছিল। তেমনি মসলিন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন বিদেশি পর্যটকরা।

ঢাকাসহ আশপাশের এলাকাতে মুঘল আমলে সপ্তদশ শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল। প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই মসলিন কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেও সেখানে এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় এক শ’ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর ওখানে জন্মাতো উঁচুমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে ২শ’ বছর আগেও বিদেশি বণিকরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রফতানি করত। ওখানকার প্রায় দেড় হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করত ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে যখন মসলিনের ওপর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ হারিয়ে যাওয়ার পথে। অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনো সাতশ’ ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এ কাজে। মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা ও ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে।

সাধারণত, মহিলারাই সুতা কাটা আর সূক্ষ্ম সুতা তোলার মতো পরিশ্রম এবং ধৈর্যের কাজে নিয়োজিত ছিল। সুতা তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকেলের পরে এ কাজ করা হতো। আর্দ্রতার খোঁজে অনেক সময় এমনকি নদীতে নৌকার ওপর বসে সুতা কাটার কাজ চলত। একজন মহিলা এভাবে প্রতিদিন সুতা কেটেও মাসে মাত্র আধা তোলা সুতা তুলতে পারতেন। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজের কারণে দক্ষ সুতা কাটুনির সংখ্যা অনেক কমে আসতে থাকে উনিশ শতকের শুরু থেকেই। জানা গিয়েছে, এই রকম সূক্ষ্ম সুতা কাটার কাজ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও এতটা ভালো হতো না। এর কারণ ধরা হয় দু’টো- ঢাকার ফুটি কার্পাস আর শ্রমিকের দক্ষতা ও পরিশ্রম।

বিভিন্ন সূত্র হতে যা জানা যায়, ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ঢাকা হতে কিছু মসলিন পাঠানো হয়। সেখানে এক পাউন্ড সুতা দেখানো হয়েছিল যা প্রায় আড়াইশ’ মাইল ছিল!! আরো মসলিন সম্বন্ধে, ‘মর্নিং ক্রনিকল’ পত্রিকায় লেখা হয়- হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখণ্ড মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স!! মসলিন তৈরির কাজটি ছিল খুবই জটিল, কঠিন, সময়সাধ্য- তার চেয়েও বড় কথা হলো সেটা তৈরির জন্য দরকার হতো অসামান্য নৈপুণ্য আর আসুরিক ধৈর্য। মোটামুটি যে কয়েক ধাপ পেরিয়ে তৈরি হতো মসলিন। সেগুলো হলো- সুতা নাটানো, টানা হোতান, সান বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু-বাঁধা, আর সবশেষে কাপড় বোনা। এসব শেষে একজন তাঁতি আর তার দু’জন সহকারীর লাগত কমপক্ষে দু’তিন মাস। মসলিন ছিল নানা রকমের। এর পার্থক্য নির্ণীত হতো সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশা বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। ‘মলবুস খাস’ ছিল সবচেয়ে নামি, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন।

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার বর্তা হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রফতানি করত। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিল প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশি ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সে আমলে ঢাকা আর বাংলাদেশ থেকে রফতানির জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন। পরবর্তী সময়ে মসলিন রফতানির ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রফতানি হতো মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগপর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করত। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। মসলিন তাঁতিরা দিশেহারা হয়ে ওঠে এই গোমাস্তাদের অত্যাচারে। খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি কোম্পানির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল এ দেশেরই দালাল, পাইকার আর গোমস্তারাই। লোকশ্রুতি রয়েছে, ইংরেজরা নাকি মসলিন তাঁতিদের আঙ্গুল কেটে ফেলত।

চার-পাঁচশ’ বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শ’ বছরের মধ্যেই তা হারিয়ে গেল। মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী- কেউই এ শিল্প রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং চেষ্টা করেছেন কীভাবে কৃষক-তাঁতিদের শোষণ করে নিজেরা লাভবান হতে পারে। ধীরে ধীর হারিয়ে যেতে থাকে মসলিনের স্বর্ণযুগ, হারিয়ে যায় মসলিন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১২-১০-২০১৮ | ১৩:২৩ |

    চার-পাঁচশ’ বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শ’ বছরের মধ্যেই তা হারিয়ে গেল। আমাদের কারু সম্পদ বিলীন হয়ে গেছে। ফিরবে না আর। Frown

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ১২-১০-২০১৮ | ১৭:১২ |

    বাব্বাহ্ ভাল একটি ইতিহাস জানা হয়ে গেলো দেখছি। ঢাকাই মসলিনের নাম অনেক শুনেছি দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১২-১০-২০১৮ | ২১:৪৯ |

    মসলিন ঐতিহ্য দুঃখজনকভাবে আজ অতীত হয়ে গেছে। Frown

    GD Star Rating
    loading...