অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুগে যুগে দাঁড়িয়েছে নারীরা। তাদের সাহস, দেশপ্রেম আর স্বাতন্ত্রবোধই জাগিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই দাঁড়িয়ে যাওয়ার সময় তাদের হাতে ছিল কখনো অস্ত্র, কখনো সেবার মন্ত্র, আবার কখনো শুধুই কলম। জোয়ান অব আর্ক থেকে এমনই কয়েক সাহসী নারীকে নিয়ে আজকের আলোচনা-
জোয়ান অব আর্ক
প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে ফ্রান্সের এক কৃষক পরিবারে জোয়ান অব আর্কের জন্ম। তখন প্রায়ই যুদ্ধ হতো ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে। ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল ফ্রান্সের অনেকাংশ। ফরাসিদের এই পরাজয় জোয়ানকে স্পর্শ করে। একদিন প্রার্থনার সময় জোয়ান এক অদ্ভুত কণ্ঠ শুনতে পায়, তার কানে ভেসে আসে- ‘সাহসী কিশোরী তৈরি হও। তোমার সময় এসেছে যুদ্ধে যাবার। তুমিই পারবে ইংরেজদের পরাজিত করে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে।’ অদ্ভুত এই কণ্ঠস্বরে জোয়ান ভীত হয়ে পড়ে। গ্রামের সবাইকে জানায়। এ নিয়ে হাসাহাসি শুরু হয়, তখন সে নিজেই যুদ্ধের জন্য মনস্থির করে এবং ফ্রান্সের প্রধান সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেনাপতির প্রহরীদের বাঁধা অতিক্রম করে জোয়ান সেনাপতির সঙ্গে দেখা করে বলে, ‘আমি ঈশ্বরের বার্তা পেয়েছি, আমাকে সাহায্য করুন।’ জোয়ানের চোখে ঐশ্বরিক দ্যুতি দেখে সেনাপতি জোয়ানকে রণসাজে সাজিয়ে রাজা চার্লসের কাছে পাঠান। রাজা চার্লস জোয়ানকে একটি ছোট সেনাদল দেন যুদ্ধের জন্য। জোয়ান উদ্যোগ নেন, ফ্রান্সের অরলিয়েন্স শহরকে মুক্ত করার। বীরের মতো সেনাবাহিনী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে জোয়ান পরাস্ত করেন ইংরেজদের। এ যুদ্ধে তিনি আহত হলেও মনোবল হারান না। এরপর একে একে তিনি বিভিন্ন শহর মুক্ত করেন শত্রুদের পরাজিত করে। শেষবেলায় তিনি ধরা পড়েন ইংরেজদের হাতে। বন্দি জোয়ানের ওপর চালানো হয় অমানুষিক অত্যাচার। নিজেকে ‘ডাইনি’ বলে প্রচার করার জন্য জোয়ানকে চাপ দেয়া হয়। জোয়ান রাজি না হলে, ইংরেজরাই জোয়ানকে ডাইনি বলে প্রচার চালায়। পরে তাকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে হত্যা করে। এ ঘটনার অনেক বছর পর ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চ ১৯২০ সালে ঘোষণা করেন, জোয়ান ডাইনি ছিল না, সে ছিল সত্যিকারের এক সিদ্ধ নারী। এরপর থেকেই জোয়ানকে ‘পুণ্যাত্মা জোয়ান’ বলে সম্বোধন করা হয়।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল
আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। জীবন কাটিয়েছেন মানুষের সেবায়। বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তা তাকে মানুষের সেবার জন্য পাঠিয়েছেন। জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্সে ১৯২০ সালের ১২ মে। ইউরোপ ভ্রমণের সময় জেনেভায় শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন দেখে সেবিকা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৫৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থায়ী ‘ক্রিমিয়ার যুদ্ধে’ অসামান্য সেবামূলক কাজের জন্য কিংবদন্তিতে পরিণত হন। এ সময় গভীর রাত পর্যন্ত একা-একা প্রদীপ হাতে যুদ্ধাহত যোদ্ধাদের তাঁবুতে হেঁটে বেড়াতেন, খোঁজ-খবর নিতেন, সেবা করতেন। তখন থেকেই তাকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে ডাকা হয়। ১৮৫৫ সাল থেকে তিনি শুরু করেন নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ। ১৮৫৯ সালের মধ্যেই তিনি সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। এরপর লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’। অসংখ্য পদক আর উপাধিতে ভূষিত ফ্লোরেন্সকে ১৮৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসেবে অর্জন করেন ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব। ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’ হিসেবে। যার মাধ্যমে সম্মান জানানো হয় এক নারীকে যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘নার্সিং পেশা নয়, সেবা’। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ
ভারতের উত্তরের ছোট্ট প্রদেশ ঝাঁসি। এই প্রদেশেরই রানী লক্ষ্মীবাঈ। জন্ম ১৮৩০ সালে। ঝাঁসির মহারাজ মৃত্যুর সময় যুবরাজ ছিলেন খুবই ছোট। তাই রাজা জানিয়ে যান, তার মৃত্যুর পর রাজ্য চালাবে রানী। সে সময় প্রায় পুরো ভারতবর্ষই শাসন করত ব্রিটিশরা। তারা ঝাঁসির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ‘আমার ঝাঁসি ওদের হাতে দেব না’ ঘোষণায় বিদ্রোহ করেন রানী লক্ষ্মীবাঈ। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন রানী। তিনি জানতেন, এজন্য ব্রিটিশদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়বেন, তাই প্রস্তুত করেন ১৪ হাজার স্বেচ্ছাসেনা এবং নতুন কামান। মজুদ করেন প্রয়োজনীয় খাবার। ২৩ মার্চ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ঝাঁসির দুর্গ ঘিরে ফেলে। দুর্গের ভেতরে থেকে রানীর নেতৃত্বে লড়তে থাকে বিদ্রোহীরা। রানী নিজে প্রাসাদচূড়া থেকে গুলি ছুড়তে থাকেন। ৩ এপ্রিল, সূর্য ওঠার আগে ব্রিটিশ সৈন্যরা দুর্গের দেয়াল টপকাতে সক্ষম হয়। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। রানী তার যোদ্ধাদের পাশে থেকে ঠেকিয়ে দেন ব্রিটিশদের। কিন্তু এ বিজয় ছিল সাময়িক। পরাজিত ব্রিটিশরা শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রিয় ঝাঁসিকে বাঁচাতে পারবেন না বুঝে রানী বর্ম, রিভলবার আর শিশুসন্তানকে নিয়ে একদিনে ১৬০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কালপি দুর্গে আসেন। এখানে মিত্রদের নিয়ে তিনি দখল করেন গোয়ালিয়র দুর্গ। কিন্তু খুব দ্রুত এখানেও আক্রমণ করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। রানী জানতেন, এটা নিজের শেষ যুদ্ধ। তাই, পুরুষের মতো চুল কেটে, হাতে নেন রত্নখচিত তলোয়ার। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে নিশ্চিত হয় দুর্গ বিদ্রোহীদের দখলে থাকছে না। দাঁতে ঘোড়ার লাগাম ধরে দুই হাতে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করার সময় এক ব্রিটিশ অশ্বারোহী সৈনিকের খাটো বন্দুকের গুলিতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন তিনি। লক্ষ্মীবাঈয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।
অ্যানা ফ্রাংক
অ্যানা ফ্রাংকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুন জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে। বাবা-মার দ্বিতীয় কন্যা অ্যানা ১৯৪২ সালে নিজের ১৩তম জন্মদিনে বাবার থেকে উপহার হিসেবে পান লাল-সাদা চেক প্রিন্টের কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট লক লাগানো অটোগ্রাফ খাতা। এই খাতাটিতে অ্যানা ডায়েরি লেখা শুরু করেন ১৯৪২ সালের ১২ জুন থেকে। অ্যানার ডায়েরির শেষ লেখার দিনটি ছিল ১৯৪৪ সালের ১ আগস্ট। আগস্টের ৪ তারিখে আমস্টারডামের একটি বাড়ির গোপন কুঠরিতে লুকিয়ে থাকা অ্যানাদের পরিবারসহ আটজনকে আটক করে জার্মান নাজিবাহিনী। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বার্গেন-বেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এখানেই মারা যান অ্যানা। অ্যানার ডায়েরিতে উঠে এসেছে নাজিবাহিনীর দখলদরিত্বে দুই বছরেরও বেশি সময় তাদের আমস্টারডামে লুকিয়ে থাকার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা। যুদ্ধ শেষে অ্যানার বাবা অটো ফ্রাংক ১৯৪৭ সালে অ্যানার ডায়েরিটি বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসেন। শুরুতে এখানে অ্যানা শুধু নিজের জন্যই লিখতেন। তাতে ফুটে উঠেছে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ ঘটনার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী ইহুদিদের জীবনযাপন, বিধিনিষেধ আর শোষণের কথা। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি অ্যানা নিজের অনুভূতি, বিশ্বাস যেমন বর্ণনা করেছেন, তেমনি যা অন্য কারও সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন না, সেগুলোও লিখছেন। লিখতে লিখতে অ্যানা ডায়েরিটিকে তার বন্ধু বানিয়ে ফেলেন, যাকে সম্বোধন করতেন ‘কিটি’ নামে। ডায়েরির প্রথমে দুইটি ভার্সন প্রকাশিত হয়, পরবর্তীতে ভার্সনে এবং ভার্সন-বিকে সম্পাদনা করে একটি ছোট ভার্সন দাঁড় করানো হয়, যা ভার্সন-সি নামে পরিচিত।
loading...
loading...
ইতিহাস এবং সংস্কৃতি ক্যাটাগরির সার্থক একটি পোস্ট। আমার ভালো লেগেছে।
loading...
এমন নিবন্ধ আমি ভীষণ পছন্দ করি। অভিনন্দন সুরাইয়া নাজনীন দি।
loading...
আপনার লেখা নিবন্ধখানা পড়ে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেইসাথে কিছু অজানা ইতিহাস জানা হয়ে গেল। ধন্যবাদ অজস্র। আশা করি ভালো থাকবেন।
loading...
ধন্যবাদ লেখিকার জন্য।
অনেক কিছু জানতে পারলাম।
loading...
অসাধারণ শেয়ারিং।
loading...
* স্যালুট সেসব নারীদের এবং লেখকের জন্যও শুভ কামনা…
loading...
যুগে যুগে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারিরাও সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে নিজেদের উতসর্গ করেছে। তারই কিছু ইতিহাস আপনি তুলে ধরেছেন। এই লেখায় আরো চাই প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, তারাবানু সহ আরো আরো মহিয়সীর জীবনী । আপনাকে স্যালুট।
loading...