আমরা সবাই কবি আমাদের এই নেটের রাজত্বে ...

না কেউ কেউ কবি নয়! সকলেই কবি! বিশেষত যদি বাঙালি হন, আর লগইন করেন ফেসবুকে! তবে স্ট্যাটাসে কীপ্যাড ওপেন করলেই কাব্যসরস্বতী আপনার অধীনস্ত! অক্ষর জুড়ে অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, দলবৃত্ত তছনছ হতে পারে! ধর্ষিত হতে পারে ছন্দ অনুপ্রাস কাব্যমাত্রা! কিন্তু কবিতাদেবীর শরীরের বিভঙ্গে শব্দযোজনা করলেই আপনি কবি! সম্পাদকের কাঁচি নেই! প্রকাশের জন্য অপেক্ষা নেই! বন্ধুবৃত্ত যত জোরালো তত লাইক! কমেন্টের হুল্লোর আছড়ে পড়বে আপনার পোস্টের মার্চপাস্টে, ট্যাগের মিসাইলে অধিকৃত করতে পারবেন যত বেশি বন্ধু দেওয়াল! শেয়ার বাটনে সৌরভ ছড়াবে আপনার কবিখ্যাতির নতুন দিগন্তে! শুধু একটা লগইনেই বঙ্গলক্ষ্মীর কাব্যভাঁড়ারের চাবি আপনার হাতে!

সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু যুগ পূর্বেই বলে গিয়েছিলেন, বঙ্গসন্তান যৌবনে কাব্যচর্চা করবে না, এ হয় না! বঙ্গজীবনে বাঙালির কাব্যচর্চার ধারার বিবর্তন হয়েছে নানান ভাবে, যুগ পরিবর্তনের নানা পর্বে! কিন্তু পরাধীন জাতির- বৃটিশের স্কুলে প্রবেশ করে কাব্যচর্চায় ঘটে গিয়েছিল এক বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আর কবিকৃতী যেন সমান্তরাল পদধ্বনী করে এগিয়ে চলছিল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আধুনিক পর্বে! হয়ত সেই কারণেই কবি জীবনানন্দ দাশকে উচ্চারণ করতে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক সাবধানবাণী; “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি” কবি যশ প্রার্থী বাঙালি অবশ্য তাতে কান দেবার পাত্র নয়! দেয়ও নি তাই কোনোদিন!

ছাপাখানার চৌহদ্দীর সেই যুগে জীবনানন্দ কল্পনাও করে যেতে পারেন নি- আজকের লগইন অনলাইনের এই যুগের কাব্যসুনামীর প্রলয়ের বর্তমান চিত্রটি! ইনটারনেট পত্তনের আগে, পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষার সেই যুগেই কবি অস্থির হয়েছিলেন অকবির সংখ্যাধিক্যে! আর আজ তিনি জীবিত থাকলে হয়ত দমবন্ধ হয়েই মমি হয়ে যেতেন আমাদের দাপাদাপিতে! কিন্তু আমরা বাঙালিরা কাঁটাতারের কী এপাড়ে, কী ওপাড়ে সেকথা ভেবে দমার পাত্র নই! আমাদের অফুড়ন্ত দম! সেই দমেই দমদমাদম কবিতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে অনলাইনে! কিন্তু কি লিখছি আমরা? কেন কবিতা! কবিতাই তো? কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়, সেই সীমারেখাটা কি ধুয়ে যায় নি ইনটারনেটের পক্ষ বিস্তারে? কবিতা আর অকবিতার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্যের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন কবি; ইনটারনেটে কাব্যচর্চার যুগে সে পার্থক্যের বিষয়ে আমরা কজনই বা আর খেয়াল রাখি? জীবনবোধের পরতে পরতে, অভিজ্ঞতা আর সজ্ঞান কালচেতনার যুগলবন্দীতে- সমাজ সভ্যতা ও ইতিহাস জ্ঞানের বিস্তারে; প্রাত্যহিক জীবনের পরিধিতে- শাশ্বত জীবনবোধের সুস্পষ্ট মায়াবী উদ্ভাসনের যে প্রবল সংঘটনের অন্যতম অভিমুখই হলো কবিতা; সে কথা আজকের এই লগইন সভ্যতায় কজনই বা আর অনুভব করি আমরা? কতগুলি মনের ভাবনা বা বক্তব্যের পরিস্ফূটনে আপাত অসংলগ্ন কিছু শব্দ বিন্যাসের মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক ছবির উদঘাটনকেই কবিতা বলে ভুল করে বসি অধিকাংশ সময়েই! জীবনযাপনের চর্চার মধ্যে নান্দনিক প্রত্যয় এবং ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্বন্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা ও দেশ আর জাতীয়তার শিকড়ের সাথে নিবিড় সংযোগ না থাকলে, যে কবিতা লেখা সম্ভব নয়, ভুলে যাই আমরা সেই মূল সত্যটাকেই! অনেক সময়! তাই বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ করে অনলাইনে- মূলত শব্দ বিন্যাসের কারিকুরিকেই কাব্যচর্চা বলে ভেবে বসি! কারণ জীবনযাপনের পরিসরে আমরা সাধারণত ভাসমান কচুরীপানার মতোই জীবনের উপরিতলে ভেসে বেড়াই! ফলে কোনো গভীর জীবনবোধের সামনাসামনি হতে আগ্রহী হই না আমরা!সেখানেই আমাদের কাব্যচর্চার পরিসর জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে! আর জীবন বিচ্ছিন্ন লেখা কখনোই হয়ে ওঠে না কবিতা!

জীবনবোধের অগভীর তল থেকে এই যে আমাদের প্রাত্যহিকতা, এই কারণেই সমস্ত কিছুর সাথেই আমদের সংলগ্নতা বড়োই আলগা হয়ে পড়ছে ক্রমশ! ক্রমশই আমরা নিজেদের জীবন প্রক্রিয়ার চারপাশে কখনো তৃপ্তি কখনো বা অতৃপ্তির আত্মগত একটি সংকীর্ণ বলয় তৈরী করে ফেলছি! যার মধ্যে থেকে সমগ্র জীবনবোধের গভীরে পৌঁছাতে পারছি না আমরা কিছুতেই! হারিয়ে ফেলছি বৃহৎ মানবজীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিজীবনের মূল প্রেক্ষিতটাকেই! আর ঠিক সেই কারণেই বিস্তৃতভাবে বাংলা কাব্যচর্চা আজ আর ঠিক সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতে পারছে না! হয়ে উঠতে পারছে না আমাদের জীবনযাপনেরই মূল অনুষঙ্গ! এর সাথেই যোগ হয়েছে নেটদুনিয়ায় “আমরা সবাই কবি, আমাদের এই লগ-ইনের দৌলতে!”-মানসিকতা! তাই তো আজ নেট দুনিয়ায় বাংলা কাব্যসাহিত্যে ঘটে গেছে কবিদের বিপুল বিস্ফোরণ! লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, যে পরিমাণে কবিতার সুনামি আছড়ে পড়ছে প্রতিদিন নেটের দেওয়ালে, তার সিকি ভাগও কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে না সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলিতে! একটু ভাবলেই কিন্তু কারণটা স্পষ্টতর হয়ে উঠবে আমাদের মানস পটে! গল্প প্রবন্ধ নাটক উপন্যাস লিখতে যে পরিমাণ সাহিত্যবোধ, পরিশ্রম, আর ধৈর্য্যের প্রয়োজন; আমাদের ধারণায়- কবিতা লিখতে গেলে সেই পরিমাণ সাধনার প্রয়োজন নেই! আমরা দেখেছি কবিতার আকারে কিছু বিশৃঙ্খল শব্দের সাময়িক বিন্যাসেই কবি বলে বাহবা পাওয়া যায় বেশ সহজেই! যে লেখা যত বেশি অবোদ্ধ, প্রিয় বন্ধুদের প্রীতিতে তাই তত বড়ো কবিতা!

আর এই ছবিটি দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জুকেরবার্গের ফেসবুকের দৌলতে! কী এক আশ্চর্য্য আলাদীনের প্রদীপ কবি যশ প্রার্থী বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছে কলেজ ড্রপআউট প্রতিভাধর এই ছেলেটি! হয়ত সে নিজেও সে বিষয়ে আদৌও অবহিত নয়! কবিতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে ব্যক্তিগত ওয়াল থেকে নোটের ভল্টে! না তাতেও রক্ষা নেই! ফেসবুক গ্রুপ আর পেজের সৃষ্টিতে বাঙালি যেন কাব্যসরস্বতীর বরপূত্র আজ! লক্ষ্য করার মত বিষয়, প্রায় প্রতি জনেরই এক বা একাধিক গ্রুপ রয়েছে আমাদের! যার বেশির ভাগটাই কবিতা কেন্দ্রিক! আর যার বন্ধুবৃত্ত যত প্রসারিত, এবং জনপ্রিয়তা যত বেশি, তার কবিতায় তত বেশি লাইক আর বাহবা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা! ফেসবুকের এই বন্ধুত্বের অলীক জগতে বাঙালি বিনা কাব্যচর্চায় কবি হয়ে ওঠার এক চমৎকার সুষোগ হাতে পেয়ে গেল! বন্ধুদের বাহবা পেলেই তার কবি খ্যাতির প্রসারে সে তৃপ্ত! ট্যাঁকে বাজে খরচের রেস্ত থাকলে তো কথাই নেই! “আপন হাত জগন্নাথ!” নিজের বা স্বামীর পয়সায় প্রকাশক ধরে বই ছাপিয়ে বইমেলায় একবার পৌঁছে গেলেই হল! বিক্রী হোক বা না হোক আত্মীয় বন্ধুদেরকে নিজের নাম স্বাক্ষর করে বই উপহার পাঠাতে পারলেই “আমি কবি!” বিভিন্ন কাব্যপাঠের আসর থেকে কবিতা প্রতিযোগিতার অনলাইন বিচারকের আসনটি পাকা! আর এদিকে ফ্রীতে বই উপহার পেতে তথাকথিত কবির বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপানো স্ট্যাটাসে কমেন্টের লম্বা মিছিল! বাঙালির কাব্যপ্রীতির নমুনা ঐ অব্দিই! ফেসের পার্সোনাল ওয়াল থেকে গ্রুপের ওয়ালগুলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে অধিকাংশ কবিতারই কোনো পাঠক নেই! ব্যক্তিগত ওয়ালে নিজের লেখা যারা বন্ধুদের ট্যাগ করেন নিয়মিত , সেখানেও অধিকাংশ সময়েই মাত্র তিরিশ শতাংশ মত বন্ধুরাই তাতে সাড়া দেন! এবং চুপি চুপি বলে রাখা ভালো তার মধ্যেও অধিকাংশই কবিতাটি না পড়েই লাইক ও কমেন্ট করে বন্ধুকৃত্য সারেন! সেটা তাদের কমেন্টের বহর দেখলেই অনুধাবন করা যায়! অসাধারন, অনবদ্য, অপূর্ব, চমৎকার, খুব ভালো লাগল, দরুণ লিখেছ- এর থেকে আর বেশি কিছু লিখে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার মত ভাষা খুঁজে পান না অধিকাংশ প্রিয় বন্ধুরাই! তাই কবিও জনে জনে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্টের কমেন্ট সংখ্যা বাড়িয়ে যান! এবং বন্ধুর লেখা কবিতা পড়ে ভালো না লাগলেও কিংবা নিজের কাব্যবোধের অভাবজনিত কারণে মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে না পারলেও আমরা লেখা ও লেখককে অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিতেই ভালোবাসি! কিন্তু অপরিচিত লেখক- যিনি আমার বন্ধুবৃত্তে নেই; তাঁর লেখা ভালো না মন্দ তা পড়ে দেখতেও যাই না, যদি না গ্রুপ এডমিন হই! অন্যের লেখা পড়ার থেকে নিজের লেখা সবাইকে পড়ানোর জন্যেই আমাদের তৎপরতা অনেক বেশি! তাই ফেসের পাতায়, সত্যি কথা বলতে কি, কবিতার পাঠকের থেকে লেখকের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি! আর ঠিক এই কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো কবিতা নিয়েই যথার্থ সাহিত্য সমালোচনার কোনো পরিসরই গড়ে ওঠে না অনলাইনের এই আত্মপ্রচারের জগতে!

ফলে আত্মপ্রচারের এই নেট দুনিয়ায়, যেখানে সম্পাদকের নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাঁচি নেই, প্রকাশের সীমাবদ্ধতাও নেই, যেখানে আমিই আমার সম্পাদক ও প্রকাশক; সেখানে যা লিখব তাই কবিতা, যদি আমার বন্ধুবৃত্ত বেশ শক্তিশালী হয়! আর তখনই ভাষা ও ভাবের উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়! যে কোনো ভাষার কাব্যচর্চার প্রেক্ষিতে যা সত্যিই অশনিসংকেত! তবুও এর বাইরেও এই কাব্য তিমিরের বলয়েও কবি ও কবিতার জন্ম হবেই! বাংলার মাটির শিকড় থেকেই পুষ্ট হয়ে উঠবে আগামীদিনের কবি প্রতিভা! অকবিদের মিছিলের পদধ্বনি ছাপিয়েও শোনা যাবে কবিকন্ঠে জীবনের বাণী, শাশ্বত মানবকন্ঠের বাঁশিতে! সেদিনের অভিমুখেই এগোতে হবে আমাদের তলায় তলায়!

শ্রীশুভ্র

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৯-১১-২০১৭ | ৬:৪২ |

    'অশনিসংকেত! তবুও এর বাইরেও এই কাব্য তিমিরের বলয়েও কবি ও কবিতার জন্ম হবেই! বাংলার মাটির শিকড় থেকেই পুষ্ট হয়ে উঠবে আগামীদিনের কবি প্রতিভা! অকবিদের মিছিলের পদধ্বনি ছাপিয়েও শোনা যাবে কবিকন্ঠে জীবনের বাণী, শাশ্বত মানবকন্ঠের বাঁশিতে! সেদিনের অভিমুখেই এগোতে হবে আমাদের তলায় তলায়!'

    আলোচ্য বিষয়বস্তুর সাথে নিঃসন্দেহাতীত সহমত পোষন করছি। সঠিক বলেছেন।  

    GD Star Rating
    loading...
  2. দাউদুল ইসলাম : ১০-১১-২০১৭ | ১৯:১২ |

    যাক!
    অবশেষে মনের কথা গুলো পড়লাম আপনার রচনায়।
    আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ এক মত।

    GD Star Rating
    loading...
  3. আনু আনোয়ার : ১১-১১-২০১৭ | ১৫:৫২ |

    ঠিক এই মুহূর্তের শব্দনীড়ের প্রথম পাতায় একটি ভিন্ন সবকটি কবিতা বিভাগের লিখা। ঐ একটা হল প্রবব্ধ, সেটিও আবার কবিতা নিয়ে লিখা। 

    বাঙালির অবস্থা যাই হোক, কাব্যের ভারে শব্দনীড়ের প্রাণ বুঝি যায় যায় অবস্থা। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বলি, আগে কবিতা সামলা! 

    GD Star Rating
    loading...