যৌনতার পরিসর

নরনারীর যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলাপ আলোচনার চর্চার পরিসরটিই আমাদের সমাজে আজও গড়ে ওঠেনি। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরেই এই বিষয়টিকে আমরা সঙ্গপনে বহুজনের আড়ালে নিভৃত নিরালায় গুপ্ত রাখতেই অধিকতর স্বচ্ছন্দ। আর সেই নিভৃত গঙ্ডীর বাইরে বেড়িয়ে এড়লেই গেল গেল রবে আমরা কোলাহল করি সমাজ রসাতলে গেল বলে। কিন্তু কেন এই লুকোচুরি মানসিকতা? কেন এইভাবে অনিবার্য একটি প্রবৃত্তিকে সব কিছু থেকে আড়াল করতে হবে? শুধু তো অনিবার্যই নয়, বিশ্ব জগতের মূল চালিকা শক্তিইতো যৌন উদ্দীপনা। যেটা না থাকলেই সৃষ্টি হয়ে যেতো মরূভুমি। সেটা জেনেও জীবনের মূল বিষয়টিকেই সব কিছুর তলায় চাপা দিয়ে আড়াল করার এই মন মানসিকতাই কি সভ্যতার মূল আভিশাপ?

আধুনিক সভ্যতাকে বুঝতে হবে, যৌন প্রবৃত্তিকে যত বেশি করে দিনের আলো থেকে দূরে লুকিয়ে রাখা যায় তত বেশি করে একটি সুন্দর প্রবৃত্তি অসুন্দরের অভিমুখে বদলে যেতে থাকে। এখন আমাদের দেখতে হবে সেই অমঙ্গল থেকে আমরা নরনারীর যৌনতাকে রক্ষা করবো কি করে। আসলে নারী পুরুষের যৌনতাকে আমরা যখনই শুধু মাত্র সন্তান উৎপাদনের পদ্ধতি হিসাবে দেখি, তখনই বিষয়টি নিতান্তই জৈবিক একটি প্রক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়ে যায় শুধু। যে প্রক্রিয়া সকল জীবজগতের মূল বৈশিষ্ট। কিন্তু সেই মূল বৈশিষ্ট মানুষের ক্ষেত্রে এসে নতুন একটি পরিসর পেয়ে যায়। যে পরিসর জীবজগতের অন্যান্য প্রজাতির ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না কোন ভাবেই। যৌনতা যখন কেবলই সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া, তখন যৌন সংসর্গের আগে পরে পরস্পর বিপরীত লিঙ্গের দুটি সত্ত্বা যে যেখানে যেমন ছিল, সেখানেই রয়ে যায়। তাদের মধ্যে সত্ত্বাগত কোন মিলনই সম্ভব হয় না। দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই একই সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। যেখানে রতিক্রিয়ার আগে পরেও যে যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে যায় সে। ঘটে না কোন সত্ত্বাগত মিলন। নিতান্তই জৈবিক একটি প্রক্রিয়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে নিয়মিত যৌন সংসর্গ।

আর এই ঘটনা সম্ভব হয় তখনই যখন যৌনতা কেবল শারীরীক একটি বাহ্যিক প্রক্রিয়ার নামান্তর। যার মূল উদ্দেশ্যই সন্তান উৎপাদন। জীবজগতে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে সবচেয়ে পরে। আগের সকল পর্ব থেকে সকল দিক থেকেই এই বিবর্তন অভিনব সন্দেহ নাই। সেই বিবর্তনের প্রায় প্রতিটি ধারাতেই জীব জগতের অন্যান্য সকল প্রজাতির থেকেই মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে গিয়েছে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য। আর সেইটা হলো মানুষের অনুভব শক্তি। যা থেকে জন্ম নেয় উপলব্ধির দিগন্ত। যে দিগন্ত জন্ম দেয় বিশ্লেষণী শক্তির। আর এইখানেই প্রকৃতিতে মানুষই অভিনব। অনেকেই বলতে পারেন, অবশ্যই। আর ঠিক সেই কারণেই তো জীবজগতের সকল প্রজাতির ক্ষেত্রে যৌনতা দিনের আলোর মতো খোলামোলা হলেও মানুষের বেলায় তাকে নিভৃত নিরালায় একান্ত অনুভবে পেতে হয়। আর ঠিক সেই কারণেই যৌনতার চর্চাটি জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মতো প্রকাশ্যে সংঘঠিত হওয়ার নয়। এইখানেই মানুষের বৈশিষ্ট। যা তাকে জীবজগতের সকল প্রজাতি থেকে উন্নত করে তুলেছে।

না বিষয়টি আবার ঠিক এইরকম একরৈখিকও নয়। নারী পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত রতিক্রিয়ার নিভৃত নিরালা নির্জন বাসরের প্রয়োজন নিয়ে বিতর্ক নেই। বিতর্ক আমাদের চিন্তা চেতনায় মন মননে জীবনের উদযাপনে যৌনতা নিয়ে যে রাখঢাক আড়াল অবডাল চাপা স্বরে আকারে ইঙ্গিতে ইশারার আয়োজন, সেইটির উপযোগিতা নিয়েই। যে বিষয়টি এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে, সেটিকে এড়িয়ে চলার মানেই মরুভুমির চর্চা করা; সেই বিষয়টি নিয়েই এমন একটা ভাব করা যেন ওটিই সভ্যতার অন্তরায়। ওটিকে আড়ালে লুকিয়ে রাখলেই সমাজ সংসারের একমাত্র মঙ্গল।

বস্তুত নরনারীর যৌনতা নিয়ে চর্চার পরিসরটি যত বদ্ধ থাকবে ততই পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নটি দূর্বল হয়ে ওঠে। সেটাই স্বাভাবিক। যৌনতা চর্চার অভাবেই যৌন মিলনের মাধুর্য্য থেকে বঞ্চিত হয় অধিকাংশ মানুষ। একটি সম্পূর্ণ সত্ত্বাগত মিলন প্রক্রিয়া পর্যবসিত হয় শারীরীক মিলনে। এই যে শরীর সর্বস্বতা, এইখানেই মানুষ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট হারিয় ফেলে নিতান্তই জৈবিক হয়ে ওঠে। আর সেইটা হয় যৌনতার সঠিক চর্চার পরিসরটিকে অবরুদ্ধ রাখার জন্যেই।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৮-১০-২০১৭ | ২২:১৯ |

    দারুণ শুদ্ধভাবে আলোচনাটি করেছেন। বিষয়বস্তু সমকালীন সময়যোগী মনে করি মি. শ্রী শুভ্র। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...