এদেশ ওদেশ ১৬

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ ষোড়শ পর্ব।)

ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জোর গলায় গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন অথচ তারপরেই ধর্ষিত হয়েছে সেই গণের জন্য, গণের দ্বারা, গণের কৃত তন্ত্র। পীড়িত নাগরিকের কাছে মূলত ক্ষমতা থেকে ক্ষমতার পরিবর্তনের সময়েই গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। আর গণতন্ত্রের ছত্রছায়াতে নিঃশব্দে রোপিত হয়েছে বিষবৃক্ষ। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে স্ব উদ্দেশ্য সিদ্ধির মারপ্যাঁচ এতটাই জটীল অঙ্ক যে তার জট খুলতে তাবড় চিন্তাবিদও হিমসিম খেয়ে যান।

১৯১০, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে, মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে এক তরুন কলকাতায় এলেন চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। কলকাতায় তিনি থাকতে শুরু করলেন শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী নামে জনৈক তরুনের বাসায়। এই শ্যামসুন্দর ছিলেন তৎকালীন সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সদস্য। স্বভাবতই মারাঠী আকৃষ্ট হলেন সশস্ত্র বিপ্লবের আদর্শে। সান্নিধ্যে এলেন বিখ্যাত বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের। ডাক্তারী পড়া শেষে নাগপুরে ফিরে যাওয়ার পরে কিছুদিন সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ইস্তফা দিয়ে ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৫ বিজয়া দশমীর দিন রোপণ করলেন এক চারাগাছ, পরবর্তীতে যা মহীরুহ হয়ে ঘন অন্ধকারের সৃষ্টি করল। সেদিনের সেই মারাঠী তরুনের নাম কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার, আর সেই চারাগাছটি হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।

ভয়ংকর অদ্ভুত উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারক এই দল, প্রথম থেকেই নিজেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে মান্যতা দিতে অস্বীকৃত হয়েছে। অথচ প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মসূচীকে সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল সঙ্ঘের অন্যতম কাজ। অর্থাৎ এই সময়ে এই সংগঠনের ভয়ংকর উগ্র হিন্দুত্ববাদকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রসারিত করছিল কংগ্রেস। অপরদিকে মুখে রাজনৈতিক অচ্ছুত বললেও কং রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম কে কাজে লাগিয়ে বড় হচ্ছিল বিষবৃক্ষ। মধুচন্দ্রিমা শেষ হল ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই সরাসরি অ্যাডলফ হিটলারকে সমর্থন করে বসল সঙ্ঘ। হিটলারের বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করল তারা। মজার ব্যাপারটা হল, এই সঙ্ঘই আবার অপরদিকে ছিল প্রবল ইহুদী সমর্থক, যারা আবার কিনা ছিল হিটলারের শত্রু। এই দ্বিচারিতার মধ্যেই প্রথমবার নিষিদ্ধ হল এই সংগঠন।

দ্বিতীয়বার এই সংগঠন নিষিদ্ধ হল ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ এ, বহু মহারথীর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সঙ্ঘের এক সদস্য নাথুরাম গডসে প্রকাশ্য প্রার্থনা সভায় যখন গুলি চালিয়ে খুন করলেন মোহনদাস করমচন্দ গাঁধি কে। এই হত্যার পেছনে প্রকাশ্যে যে মত প্রচারিত হয়েছিল, তা হল গাঁধির মুসলমান তোষণ, কিন্তু প্রচ্ছন্নে ছিল আরো মস্তবড় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের খেলা, যা বোঝার ক্ষমতা নাথুরাম সমেত বিরাট অংশের ক্যাডারদের তথা অশিক্ষিত ভারতবাসীর ছিল না।

এই উগ্র সঙ্ঘ কেই ভারত সরকার বারবার ডেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সঁপেছে। ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৭১ বারংবার কখনো আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, কখনো রাজধানীর যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, কখনো গুরুত্বপূর্ণ প্যারেডে অংশগ্রহণ করার জন্য সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছে এঁদের। আবার মতের অমিল হলে নিষিদ্ধকরণও হয়েছে বারবার। তৃতীয় দফায় সঙ্ঘ নিষিদ্ধ হল জরুরী অবস্থার সময়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একসারিতে। আর চতুর্থতম নিষিদ্ধকরণ তো এখন ইতিহাস।

কালো ছায়া ঘনিয়ে উঠছিল এক ভয়াবহ বিতর্কে। সেই প্রাগৈতিহাসিক রামের জন্মের স্থান নিয়ে ইচ্ছাকৃত বিতর্ক তুলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় জানপ্রাণ লড়িয়ে দিল সঙ্ঘ ও তার সহযোগী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি। হিন্দু সমর্থন হারানোর আশংকায় ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা নিল তৎকালীন কংগ্রেসী নরসীমা রাও সরকার। প্রচার তুঙ্গে তুলে ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ সকালেই হামলা হল উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ওপর। বাবরের আমলের ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল অন্ধ মৌলবাদের হাতুড়ির আঘাতে। আজকের সিরিয়ায় বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্যের ওপরে মৌলবাদী সংগঠন যে অন্ধ আঘাত করে চলেছে, সেদিনের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে তার কোনো পার্থক্যই ছিল না। সমগ্র উপমহাদেশে সেদিন সূর্য ওঠেনি, সকাল হয়নি, মানুষ পিছিয়ে গেছিল ফের অন্ধকার যুগে। লজ্জায় মুখ ঢেকে ছিল সভ্যতা।

(আবার আগামীকাল)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এদেশ ওদেশ ১৬, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৭-০৫-২০২২ | ৯:৪৫ |

    মৌলবাদী সংগঠন যে অন্ধ আঘাত করে চলেছে, সেদিনের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে তার কোনো পার্থক্যই ছিল না। সমগ্র উপমহাদেশে সেদিন সূর্য ওঠেনি, সকাল হয়নি, মানুষ পিছিয়ে গেছিল ফের অন্ধকার যুগে। লজ্জায় মুখ ঢেকে ছিল সভ্যতা।  https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...