(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে একটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ দ্বাদশ পর্ব।)
১৯৭২। সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে এই বছরের আর কোনো প্রভাব এখন আর নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনো চমকে ওঠেন এই সালের কথা মনে পড়লেই। সদ্য পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর মনোবল তখন তুঙ্গে। আর সেই গর্বিতচারণ তারা চারিয়ে দিচ্ছে আম জনতার মধ্যে। আসলে এই কৌশল সারা পৃথিবীর সব দেশেই রাজনৈতিক দলেরা কাজে লাগায়। যখনই দেশের অবস্থা টলোমলো হয়, ক্ষোভ ঘনিয়ে ওঠে তখনই দুটো কৌশল কাজে লাগানো হয়। এক, জাতীয় আবেগ, দুই, খেলা। মজার ব্যাপার, এই দুই কৌশলেই আমাদের উপমহাদেশের পেটেন্ট নেওয়া। অতীতে বারবার দেখা গেছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু, ভারতের রাজনৈতিক দলেরা পাক জুজু আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু বা পাক জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষের স্বাভাবিক ক্ষোভকে অন্যদিকে চালিত করে তাৎক্ষণিক ভোলানোর চেষ্টা করেন। আর এই জুজুর ভয়ের ওপরের মোড়কটাই হলো ধর্মীয় বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত ভয়। অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষ বিদেশী ভাষায় লিখিত ধর্মগ্রন্থের সদভাবটুকু আত্মস্থ করতে পারেন না না জানার ফলে, আর সেখানেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধি ও ক্ষমতা দখলের জন্য চলে কিছু অসৎ মানুষের বিকৃত ব্যাখ্যা। সম্প্রতি খেলার মত নির্দোষ আমোদেও এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থর চেষ্টা লক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এই তিন দেশের সাধারণ মানুষ ধান্দাবাজ নন। তারা সহজ, সরল, অমায়িক, অতিথিবৎসল। এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষকে কাছে পেলে বুকে জড়িয়ে ধরেন আত্মীয়স্বভাবে। তাদের মধ্যে বিদ্বেষের লেশমাত্রও পরিলক্ষিত হয়না।
৭২ এর নির্বাচন হয়েছিল সমগ্র ভারত ও বঙ্গের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে। আগেই বলেছি সদ্য পাকিস্তান যুদ্ধ জয় হয়েছে। ভারতের আম মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা এবং আত্মপ্রসাদ। স্বয়ং বিরোধী দলের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী সংসদে প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরাকে আখ্যা দিলেন ‘দেবী দুর্গা’। অথচ এই জনসংঘী বাজপেয়ীরই জনক দলের নাথুরাম গডসে একদিন গুলি করে হত্যা করেছিল ইন্দিরার ধর্মপিতা মোহনদাস করমচন্দ গাঁধিকে। যুদ্ধজয়ের উন্মাদনাকে কি সুন্দর কাজে লাগানো যায় এই ঘটনা তার উৎকৃষ্ট প্রমান।
যাইহোক,১৯৭২ এর জুলাইএর সিমলা চুক্তির আগেই সমগ্র ভারত যখন উত্তেজনায় ফুটছে, সেই স্বর্ণসময় কাজে লাগিয়ে ইন্দিরা রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের ডাক দিলেন। আজকের মত তখনকার নির্বাচন কমিশন এত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। তখন কেন্দ্রের শাসকের অঙ্গুলিহেলনেই তারা কাজ করতে বাধ্য হত। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালেন ইন্দিরা। ইতিমধ্যেই সারা ভারতে মাথাচাড়া দিয়েছে গরীবি, বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারী, ভূমির অনৈতিক বন্টন প্রমুখ সমস্যা। আর এর বিরুদ্ধে পূর্ব ভারতে দানা বেঁধেছে যে ক্ষোভ তা অচিরেই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা। সব মিলে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে খানিক অনুকূল করার প্রয়াস।
১৯৬৭ তে যখন ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বর্দ্ধমান প্লেনামে পাল্টা দলিল পেশ হয়েছিল, তখনই ঘনীভূত হয়েছিল আশংকা। মাত্র কয়েক বছর আগে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে বেরিয়ে আসা নেতারা এই ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারেন নি। যে তরুনেরা এই পাল্টা দলিল পেশ করে বলতে চেয়েছিল যে তখনকার আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ধনীদের করায়ত্ত, তাদের কথা না শুনেই, তাদের পার্টি থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। পরিণামে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালের নেতৃত্বে তরুনেরা ভুল পথে পা বাড়াল। আগুন জ্বললো পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতে। বাংলার উত্তরভাগের এক গ্রাম নক্সালবাড়ীতে সামান্য এক জমির লড়াই ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রদেশে। ১৯৬৯ সাল, সিপিআই-এম তখন যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায়, সে সময়েই কেন্দ্রে জেএফআর জেকব এর নেতৃত্বে পরিকল্পনা হল “Operation Steeplechase” এর। নীল নক্সা অনুযায়ী সেনাকেই কাজে লাগানোর সবকিছু ঠিকঠাক। যদিও তখনও তরুনদের আন্দোলন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছয়নি। কিন্তু ’৬৯ এ হিড়িক পড়ে গেল বহু সাংবিধানিক দলত্যাগের। নক্সালবাড়ীর নামে সাধারণ মানুষ পুরো দলটার নামই দিয়ে ফেললো ‘নক্সাল’।
(আবার আগামীকাল)
loading...
loading...
অতীতে বারবার দেখা গেছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু, ভারতের রাজনৈতিক দলেরা পাক জুজু আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু বা পাক জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষের স্বাভাবিক ক্ষোভকে অন্যদিকে চালিত করে তাৎক্ষণিক ভোলানোর চেষ্টা করেন। আর এই জুজুর ভয়ের ওপরের মোড়কটাই হলো ধর্মীয় বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত ভয়।
loading...