এদেশ ওদেশ ১০

শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ দশম পর্ব।)

নিজের শিকড় যদি অজানা থাকে, তাহলে বর্তমানের সংকটের স্বরূপ বোঝা যায়না। আমজনতা এমনিতেই এতরকম সমস্যায় জর্জরিত যে জন্মের আগের ঘটনা সম্পর্কে আগ্রহী হয়না। কিন্তু অসুখ যখন দুরারোগ্য আকার নেয়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ড জানা জরুরী হয়ে পড়ে নাহলে সঠিক চিকিৎসা জোটে না।

ইন্দিরা গান্ধী যেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন সে দিনটা ছিল ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১। ঠিক তার পেছনের বছরে ১৯৭০ থেকে সমস্যার শুরু হয়েছিল, যখন পাকিস্তানের নিম্ন পার্লামেন্ট কক্ষ মজলিস ই শুরা র ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৯ টিই জিতে নিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লিগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তারা যেই শাসন ক্ষমতার দাবীদারত্ব পেশ করল, ওমনি বেঁকে বসল হেরে যাওয়া জুলফিকার আলি ভুট্টো র নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি। পাকিস্তানকে তারা কিছুতেই নাপাক বাঙালিদের হাতে তুলে দেবেনা।

ভাবুন একবার, ভোটে এতদিন লড়াইয়ের সময়ে, শোষনের সময়ে যারা নাপাক ছিল না, ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার পরিস্থিতি আসতেই তারা অপবিত্র অধার্মিক হয়ে গেল! আসলে, পশ্চিমীদের এছাড়া অন্য উপায় ছিলো না। গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে তারা পরাজিত। পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া বিশেষ গর্হিত নয় এটা শিশুও জানে। তাহলে?

পাকিস্তান তখন নিজেই দুখানা বৃহৎ দুষ্কর্মে জড়িয়ে ছিল। প্রথম যেনতেনপ্রকারে পুর্বকে শোষণ আর তার নানা কৃৎকৌশল, ফন্দিফিকির। আপাত নিরীহ পূর্ব এটা জেনে গেলে বিপদ এতদিনের শাসকদের। তাই আপত্তি। আর দ্বিতীয় আপত্তি আরোও জোরালো কারনে, যার পেছনে আমেরিকা।

রাশিয়া সহ পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলোকে তাঁবে আনা আমেরিকার ব্যবসায়ী মহলের কাছে ছিল জরুরী এজেন্ডা। অথচ ক্রমাগত আরব ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছিল রাশিয়া। ধর্মীয় ছদ্মবেশে গেরিলা বাহিনী তৈরির জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করলো উদ্বিগ্ন আমেরিকা। জঙ্গীবাদের জন্ম সেই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানেই হলো। বার্থ সার্টিফিকেটে বাবা আমেরিকা, মা পাকিস্তান। এখন এই হাই প্রোফাইল গোপন তথ্য পূর্ব জেনে ফেললে সব পন্ড হবে এই আশঙ্কায় গড়ালো গভীর ষড়যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্বতে সৈন্য পাঠালেন, অস্বীকার করলেন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে।

নিত্য বনধ, আইন অমান্যের মধ্যেই ২৫শে মার্চ মাঝরাতে মুজিব কে গ্রেপ্তার করে উড়িয়ে আনা হল মূল পাকিস্তানের জেলে। ঘোষণা হল জরুরী অবস্থা। বিপুল সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরীহ জনতার ওপরে। একদল আওয়ামী লিগ নেতা পালিয়ে এলেন ভারতে। ভারত থেকেই তাঁরা গঠন করলেন মুক্তি যোদ্ধা নিয়মিত এবং গেরিলা বাহিনী। ত্বড়িৎ গতিতে কিছু পাক এজেন্ট ছাড়া প্রায় আপামর পূর্বীয় মানুষ এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন। সরকারি হিসেবে শুধু নিয়মিত যোদ্ধাই ছিলেন ১৭৬০০০। ভারতে থেকেই গঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এইসব ঘটনাক্রমে ভারত পাকিস্তানের চক্ষুশূল হয়ে উঠলো।

অন্যদিকে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন শরনার্থী পালিয়ে এল ভারতে। এই বিপুল শরনার্থীর ঢল সহ্য করার ক্ষমতা তখন নড়বড়ে ভারতীয় অর্থনীতির ছিল না। স্বভাবতই ভারত সাহায্য চাইল বিশ্বের। কিন্তু আমেরিকার চাপে একমাত্র রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ সাহায্যে রাজী হলো না।

পাক সেনা, আলবদর, রাজাকার যৌথ অত্যাচারে ও সরাসরি যুদ্ধে মারা গেল প্রায় ৩০০০০০০ বাংলাদেশী। প্রায় ন মাস পরে অধৈর্য পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাঁটির ওপরে হামলা চালালো। বাধ্য হয়ে ৩৬৫০০০ পাক আর্মির বিরুদ্ধে ৫০০০০০ সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলো ভারত।

৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ মাত্র তেরো দিন স্থায়ী হলো দুই প্রতিবেশীর লড়াই, যা গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী পৃথিবীর হ্রস্বতম যুদ্ধ। অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতির পরে নতি স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তান। বাংলাদেশে নামলো একচোখে স্বজন হারানোর জলের ধারা, অন্যচোখে স্বাধীনতার আনন্দের উচ্ছাস। মুজিব কে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো স্বৈরশাসক। কিন্তু নতুন ইতিহাস সূচনার মধ্যেও রয়ে গেল ভয়ংকর দানবের জন্মের বীজ।

(চলবে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এদেশ ওদেশ ১০, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৯-০৪-২০২২ | ১১:২৭ |

    ধর্মীয় ছদ্মবেশে গেরিলা বাহিনী তৈরির জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করলো উদ্বিগ্ন আমেরিকা। জঙ্গীবাদের জন্ম সেই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানেই হলো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ৩০-০৪-২০২২ | ২:৩৫ |

    সুন্দর কাব্য ভাবনার প্রকাশ
    পাঠ করে মুগ্ধতা অপরিসীম।
    শুভকামনা অবিরত।

    GD Star Rating
    loading...