যুদ্ধ ৪

274572

যুদ্ধ শব্দটা শুনলে বা পড়লে আমাদের মাথায় আসে হলিউডের বা বলিউডের কিছু সিনেমার ছবি। যেখানে দেশাত্মবোধের টগবগে আবেগে মাখামাখি হয়ে আমরা দুটো পক্ষ নিজের থেকেই ভাগ করে ফেলি, ভালো আর খারাপ। মজার ব্যাপার এই ভালোটা সর্বদাই নিজের দেশের উর্দি পরে যে অটোমেটিক রাইফেল হাতে শত্রুদেশের উর্দিপরাদের বিরুদ্ধে গুলি খেতে খেতেও এগিয়ে গিয়ে শেষে বিজয়ের পতাকা তুলে সবাইকে কান্নায় ভাসিয়ে নিজে মারা যায়। কিন্তু এই সোজাসাপটা কল্পনার গতিপথের মত বাস্তব এত সরল নয়। আর তাই একটা যুদ্ধের পিছনে প্রচুর জটিল গলিপথ থাকে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, কারণ আমজনতার পক্ষে ক্ষমতার অলিন্দের গোলোকধাঁধা বুঝতে পারা একেবারেই অসম্ভব।

১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত পাক্কা ছয় বছর একদিনের যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারল না সেই যুদ্ধের ফলে এক শ্রেণীর বৃহৎ ব্যবসায়ী ফুলে ফেঁপে বিকট আকার ধারণ করল। আর এদের অধিকাংশই সেই উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দা যারা পুরো যুদ্ধে নিজেদের গায়ে সাদা রঙের তকমা এঁটে রেখেছিল।

ঠান্ডা যুদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হয় নি, হয়েছিল অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক অলিন্দের নীলরক্তের মানুষদের বুদ্ধি আর কার্যকলাপের দ্বারা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের প্রথম দিন থেকেই তাকে ভেঙে ফেলার কূট ষড়যন্ত্র শুরু করার পিছনে সেই একই কারণ ছিল। উন্নত দেশগুলোর বাজারে তৈরী জিনিস বিক্রি এবং মুনাফা, যার রাস্তা সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্মধারেরা আটকে রেখেছিল। তাই বাইরে থেকে নানারকম নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সোভিয়েতের অন্দরমহলে একের পর এক ক্ষমতার কারবারীকে কিনে ফেলে ইউনিয়নকে ধ্বংসের চেষ্টা হচ্ছিল বহু শতক ধরে। ট্রটস্কি থেকে অনেকে বিফল হওয়ার পরে শেষ সুযোগ এসে গেল গোর্বাচভের হাত ধরে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আসার আগে আজকের অবস্থার আসার রাস্তায় দু একটা ঘটনার কথা বলি।

জন্মলগ্ন থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিতে নিজেদের মধ্যে বিবাদ চলছিল। এই বিবাদের পিছনেও ছিল উন্নত দেশগুলির ইন্ধন। ভারত – পাকিস্তান বা ভারত – চীনের মধ্যে যত বেশী বিবাদ হবে উন্নত দেশগুলোর তত বেশী অস্ত্র বিক্রি হবে, তত বেশী মুনাফা হবে এটা মূল বিষয়। তাছাড়া পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার নামে আমেরিকা ও চীন হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বিক্রি করে পাকিস্তানকে প্রায় দেউলিয়া করে দিয়েছে এটা পাকিস্তানের গরীব নাগরিক জানতে পারে নি। ভারত যেহেতু নিরপেক্ষ রাজনীতির অবস্থান নিয়েছিল প্রথম থেকেই, তাই ভারতকে দমিয়ে বাণিজ্য বাড়ানোর এই চেষ্টা বহু দশক সফল হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

জন্মলগ্নের পরেই ১৯৪৯ এ পাকিস্তানের দ্বারা ভারতের জমি দখল, ১৯৬২ তে চীন – ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৫ তে ফের পাকিস্তান – ভারত যুদ্ধ এসবের পিছনে ভারতের জমি আগ্রাসনের ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে বহু ডলার ও পাউন্ডের অস্ত্র বিক্রি করতে পেরেছিল উন্নত দেশগুলো। যদিও দেখানো হয়েছিল ভারত নাকি সোভিয়েতের অনুগামী এবং পাকিস্তান বা চীন আমেরিকার। কিন্তু আসল ঘটনা হলো মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ছিল পশ্চিমী দেশগুলোরই। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের এরকম আগ্রাসন ছিল না। আর তাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা ও নেতৃত্বে থাকা ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে নি, যতটা করেছিল উন্নত দেশগুলোর। মূলতঃ সোভিয়েত কে আটকানো ও ভাঙার প্রচেষ্টাতেই ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৪৯ এ ইউরোপের বারোটি দেশ নিয়ে আমেরিকা গঠন করেছিল NATO. এর উদ্দেশ্য বলা হয়েছিল সেই জোটের মধ্যে থাকা কোনো দেশের প্রতি আক্রমণ হলে তা প্রতিরোধ করা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল সদস্য দেশ দিয়ে অন্যের ভূমি দখল করতেও তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেই সময়ে এই কাজের বিরোধিতা করে আমেরিকার রোষে পড়ে ভারত। কিন্তু সোভিয়েতের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের কারণে ভারতের সরাসরি কোনো ক্ষতি করার সুযোগ পায় নি। যা পেল ১৯৭১ সালে।

পাকিস্তান তাদের অঙ্গরাজ্য তথা উপনিবেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি নষ্ট শুরু করল ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ এবং আচমকা ভারতের পশ্চিম প্রান্তে হামলা করে বসে তারা ডিসেম্বরে। এই মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েক কোটি শরণার্থী প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে যা পাকিস্তানের অপছন্দ ছিল। তাদের উসকে দিয়ে আমেরিকা ভারত আক্রমণ করিয়ে দিল যা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল ভারত এবং মাত্র তেরদিন চলার পরে ১৬ই ডিসেম্বর পরাজিত হলো পাকিস্তান। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হতো না। কারণ যুদ্ধ ঘোষণার পরেই পাকিস্তানের সাহায্যের জন্য আমেরিকা তথা NATO পাঠিয়ে ছিল তাদের যুদ্ধ জাহাজের সারি সপ্তম নৌবহর। সেদিন সত্যিই সেই নৌবহর এসে পৌঁছে গেলে আজ ভারত বা বাংলাদেশ নামে দুটো আলাদা দেশ থাকত না, সম্পূর্ণ একটা দেশ হয়ে যেত পাকিস্তান। এই দুর্ঘটনা থেকে সেদিন বাঁচিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের হুমকি দেয় সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে তারা ভারতের পিছনে আছে। এতে সাহস হারিয়ে পিছিয়ে যায় আমেরিকা। জন্ম হয় নতুন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ।

(চলবে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
যুদ্ধ ৪, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৫-০৩-২০২২ | ২১:০৯ |

    সোজাসাপটা কল্পনার গতিপথের মত বাস্তব এত সরল নয়। একটা যুদ্ধের পিছনে প্রচুর জটিল গলিপথ থাকে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, কারণ আমজনতার পক্ষে ক্ষমতার অলিন্দের গোলোকধাঁধা বুঝতে পারা একেবারেই অসম্ভব। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০৫-০৩-২০২২ | ২২:১৯ |

    যুদ্ধ নয় শান্তি চাই।

    GD Star Rating
    loading...